শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমার ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধমালা # ২ : ভাষা প্রবন্ধ # ৬১



আমার ভাষা বিষয়ক চিন্তন প্রপঞ্চ # ২
(বাঙলা ভাষার আধুনিকায়ন তথা সংস্কার বিয়ষক ১০-টি পোস্টের সিরিজ)

প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরণো অনাধুনিক ব্যাকরণ আমরা ব্যবহার করছি বিধায়, আমাদের ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে ব্যাকরণের অনেক কিছুতেই মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ ব্যাকরণটি রচিত হয়েছিল ভাষাটি জন্ম বা ব্যবহারের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে! বর্ণিত ব্যাকরণের ণ-ত্ব/ষ-ত্ব বিধান, সন্ধি প্রকরণ, বিসর্গ ও ব্যঞ্জন সন্ধি, কৃৎ-তদ্ধিত-সংস্কৃত প্রকৃতি-প্রত্যয় (-তা, -ত্ব, -ইমা ইত্যাদি), কারক-বিভক্তি, উপসর্গ-অনুসর্গ, ক্রিয়ার কাল, ধাতুর রূপ, ক্রিয়ামূল-ধাতু, দ্বন্দ্ব-বহুব্রীহি-দ্বিগু সমাস ইত্যাদির বিভাজন, সূত্র ইত্যাদি সবই সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে ধার করা। যে কারণে সংস্কৃত থেকে আগত ‘‘√বচ্+তি=উক্তি’’ কিংবা ‘‘√ক্ষে+ত=ক্ষীণ’’ আবার ‘‘ইহ+ইক=ঐহিক’’ কিংবা ব্যঞ্জন সন্ধিতে ‘উৎকৃষ্+ত=উৎকৃষ্ট’, ‘যজ্+ন=যজ্ঞ’ কেন কিংবা কিভাবে হয়েছে, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিন্তু বাঙালি শিক্ষার্থীরা ঠিক বুঝতে পারছে না কেবল ‘মুখস্ত করা’ ছাড়া। আর বিজ্ঞান ও যৌক্তিক শিক্ষার এ যুগ কি ‘মুখস্ত বিদ্যা’র যুগ হবে বোধগম্যতা বাদ দিয়ে? একইভাবে ‘খাওয়া’ ক্রিয়াপদ অতীতকালে ‘খাইছিলাম’ হলেও, ‘যাওয়া’ ক্রিয়াপদে কেন ‘যাইছিলাম’ না হয়ে ‘গিয়েছিলাম’ হচ্ছে, তারও কোন সদুত্তর শ্রদ্ধেয় ‘পাণিনি’র ব্যাকরণে নেই। এই ‘অপারগতা’কে ঐ ব্যাকরণ বলছে ‘নিপাতনে সিদ্ধ’।

তা ছাড়া আধুনিক রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বকে সময়োপযোগি তথা আধুনিক কম্পিউটার-ইন্টারনেটে ব্যবহার উপযোগি করার জন্যে এর বর্ণগুলোকে ল্যাটিন-ইংরেজি হরফে ব্যবহারের চিন্তাও করা যেতে পারে। এর কারণ হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় সকল জীবন্ত ভাষায় একটি শব্দ গঠনে বর্ণ (ধ্বনি) বিন্যাসের গঠন প্রক্রিয়া হচ্ছেঃ VCVCVC (স্বব্যস্বব্যস্বব্য) কিংবা CVCVCV (ব্যস্বব্যস্বব্যস্ব), মানে শব্দের প্রথম বর্ণটি স্বরধ্বনি হলে, পরবর্তীটি ব্যঞ্জনধ্বনি হবে কিংবা প্রথমটি ব্যঞ্জন দিয়ে শুরু হলে, পরবর্তী ধ্বনিটি হবে স্বরধ্বনি। যেমন amar(VCVC) nam(CVC) golap(CVCVC) (আমার নাম গোলাপ)। এ বাক্যে গঠিত ৩-টি শব্দই ল্যাটিন-ইংরেজী হরফে খুব সহজে উপর্যুক্ত গঠন সূত্র পাঠযোগ্য হলেও, বাংলা শব্দ গঠনে স্বরবর্ণগুলোর ব্যঞ্জনের সঙ্গে সংক্ষিপ্তাকারে চেহারা পরিবর্তনের কারণে সূত্র বিভাজন পাঠ কিছুটা জটিলতর বটে, অন্তত ল্যাটিন-ইংরেজি হরফের তুলনায়। তা ছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেটের জ্ঞানের সমুদ্রে অবগাহনের জন্যে ল্যাটিন-ইংরেজি হরফে ‘সার্জ-ইঞ্জিন’ (Google, Yahoo) ইত্যাদির বিকল্প নেই। যে কারণে আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়েই ‘ফেইসবুক’ বা অন্যান্য চ্যাটিং সাইটে ‘ল্যাটিন-ইংরেজি হরফে’ বাংলা চ্যাটিং করছে অহরহ। মালয়শিয়া, ফিলিপিন আর ইন্দোনেশিয়ানরা হয়তো এ বিষয়টি উপলব্দি করে তাদের নিজস্ব ভাষায় এখন ব্যবহার করছে ‘ল্যাটিন-ইংরেজি হরফ’। মানে তারা ল্যাটিন-ইংরেজি হরফে তাদের নিজস্ব ভাষা লিখছে। যে কারণে তারা ইন্টারনেটেও বেশ পারদর্শী।

বাঙালির লিখিত ও কথিত ভাষায় যত প্রভেদ, তা বিশ্বের কম ভাষায়ই বিদ্যমান। প্যাঁরীচাঁদ কিংবা বঙ্কিম একই ভাষিক বাঙালি, এ কথা মানতে অভাষিক বাঙালির কষ্ট হবে অবশ্যই। আসলে আমরা ‘লিখি সংস্কৃত রীতিতে, উচ্চারণ করি বাংলায়’ এ এক আশ্চর্য রীতি বাঙালি মননের। এর থেকে বের হওয়া দরকার। অত্যাবশ্যক ‘বাংলা’ নামক ভাষাটির সংস্কার তথা আধুনিকায়ন। সংস্কার মানে হচ্ছে ভিত্তি ঠিক করে শৃঙ্খলা তথা উৎকর্ষসাধন। এ ভাষায় সন্ধি, কারক, সমাস, কৃত. তদ্ধিত, বিশেষ্য, বিশেষণ, লিঙ্গ, বচন, পুরুষ, কাল, বাচ্য ইত্যাদি সংস্কৃত রীতিতে বিদ্যমান। কিন্তু বাঙালিরা কি সংস্কৃত ভাষিক জাতি? বাংলা সংস্কৃত ভাষা নয়। সংস্কৃততে প্রত্যেক বর্ণের উচ্চারণ নির্দিষ্ট। সংস্কৃত ভাষিক পন্ডিতগণ দন্ত্য থেকে ‘স’ উচ্চারণ করতে পারে, আবার পারে তালু থেকে ‘শ’ এবং ‘ষ’ কিংবা ‘ণ’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে ‘মূর্ধা’ থেকে, যা পারেনা বাঙালি। ভাষায় যতগুলো উচ্চারণ রীতি, তার সবই সংস্কৃত বর্ণমালায় স্থান পেয়েছে। যেমন শ,স,ষ,ণ,ন। বাঙালিরা ‘‘আলটিমেটাম দেয়া, স্মার্ট হওয়া, টেক ইট ইজি, এনি-ওয়ে, ওয়াপদা, ডাকসু, ওয়াসা, বিসিক, ভোকেশনাল ট্রেনিং, গেজেটেড অফিসার’’ জাতিয় বিদে শব্দকে ‘হুবহু বাংলা’ করে উচ্চারণ করলেও, তারা বর্জন করে চলে ঞ, ঢ়, য, ড়, ঘ, ঝ, ঢ, ধ, ভ, শ, ৎ, ং,ঃ, ষ, ণ,ঁ ধ্বনিগুলো। কারণ বাঙালির কাছে এগুলো কষ্টসাধ্য কিংবা অপ্রয়োজনীয় ধ্বনি। বাংলা লিপি আরো জটিল। কারণ বাংলা লিপি আবার এসেছে ব্রাহ্মী, খরোষ্টী লিপি থেকে। বাংলা বর্ণমালার বিন্যাস ও চেহারা দেবনাগরী বর্ণমালার অনুরূপ।

ভাষা বিষয়ে জানতে আগ্রহি? তো পড়ুন পর্ব # ৩







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন