শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমার ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধমালা # ৭ : ভাষা প্রবন্ধ # ৫৭

আমার ভাষা বিষয়ক চিন্তন প্রপঞ্চ # ৭
(বাঙলা ভাষার আধুনিকায়ন তথা সংস্কার বিয়ষক ১০-টি পোস্টের সিরিজ)

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন প্রচলিত শব্দ ভাঙলে চলবে কেন? দেখুন বাংলা ভাষার প্রাথমিক ও মধ্যযুগীয় শব্দগুলো কিভাবে রূপান্তরিত হয়েছে অব্যাহতভাবে। অন্ধকার>অন্ধআর>আঁধার, জিহবা>জিব্ভা>জীভ>জিব, মৃত্তিকা>মট্টিঅ>মাটি, মক্ষিকা>মচ্ছিঅ>মাছি, ভৌমিক>ভৌবিঅ>ভুঁইয়া, যুগল>জুঅল>জোড়া, মনুষ্য>মুনিস্স>মানুষ, শৃগাল>সিআল>শিয়াল, তন্ত্রী>তমত্মী>তান্তি>তাঁতী, হসত্মী>হথথী>হাথী>হাতি, চর্মকার>চর্মআর>চামার, ক্ষুরিকা>ছুরিআ>ছুরি, ঘৃত>ঘিঅ>ঘি, পেচক>পেচঅ>পেঁচা, জ্যেষ্ঠতাত>জেট্ঠাঅ>জেঠা, ভ্রাতৃজায়>ভাউজাঅ>ভাউজ>ভাজ, অষ্ট>অট্ঠ>আঠ>আট, পাষাণ>পাহাণ>পাহাড়, মাতা>আআ>মা, পুস্তিকা>পুত্থিআ>পুথি, মস্কক>মথ্থঅ>মাথা, কথনিকা>কহনিআ>কাহিনী, একাদশ>এগ্গারহ>এগার, হস্ত>হত্থ>হাত, মধ্য>মজ্ঝ>মাঝ, লএ=লয়, কুআ=কুয়া, যাএ=যায়, ণই=নদী, ণাদ=ধ্বনি, ণাবী=নৌকা, ণিঅড়=নিকট, কটুয়া=কৌটা, মউলিত=মুকুলিত, বিআ=বিয়ে, বিআধ=ব্যাধ, ভুঅণ=ভুবন, কণআ=কনক বা স্বর্ণ। বাএ>বাজায়, নই>নদী, জাওঁ>যাও) (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)। উপর্যুক্ত উদাহরণ মধ্যযুগের বাংলায় থাকলেও, বর্তমান বাঙালি কি তার পাঠোদ্ধার করতে পারছে না?

বাংলা ভাষা যে কখনো সংস্কার হয়নি তা কিন্তু নয়। ১৯৩৬ সনে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলা বানান সংস্কার সমিতি’ গঠন ও বাংলা বানানের নিয়ম প্রবর্তন করেন। ড. সুনীতি কুমার, ড. কুদরত-ই-খোদা বর্ণিত সমস্যা বিবেচনায় বহু আগেই বাংলা হরফের বদলে রোমান-ল্যাটিন হরফ ব্যবহারে পক্ষপাতি ছিলেন। কারণ তাঁরা বলেছিলেন, বাংলা হরফ আমাদের নিজস্ব হরফ নয় (যেমন নয় রোমান), বাংলা হরফ ধার করা এবং বেশ দোষত্রম্নটি যুক্ত। রোমান হরফে লেখন-পঠন বাংলার চেয়ে গতিশীল। রোমান-ল্যাটিন হরফ আন্তর্জাতিক এবং বর্তমানে ইন্টারনেট ভিত্তিক ও গতিশীল।

আসলে ভাষা জেগে ওঠে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পেলে। আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্ণধারগণ তথা পাল, সেন, পাঠান, মোঘল শাসকগণ কেউ এক কলম বাংলা লেখেননি। বাংলা জানতেন কিনা সন্দেহ। বাংলা সব সময় ছিল সাধারণের ভাষা। তাই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে সৃষ্ট ‘শতম’ ভাষার পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনের মাধ্যমে ‘আর্য’ থেকে ‘সংস্কৃত’ হয়ে প্রাচীন প্রাচ্য, গৌড়ী প্রাকৃত, অপভ্রংশ, বঙ্গ কামরূপীর মাধ্যমে নানা ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে আজকের বাংলাকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা রূপে। অনেক কষ্টে অর্জিত এ ভাষার আধুনিকায়নের দিকেও তাকাতে হবে আমাদেরই। রচনা করতে হবে এ ভাষাটির আধুনিক একটি ব্যাকরণ। বর্ণগুলোকে করতে হবে সুসংহত, বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক ও সহজতর। এ ভাষাটির ভাষিক গোষ্ঠী শুধু আমরা একা নই, আমরা আর পশ্চিম বাংলার মানুষ ছাড়াও ত্রিপুরা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম এমনকি ভুটান (ফুল্টসলিং)-এর মানুষেরাও এ ভাষাটি ব্যবহার করে।

আমরা বাঙালিরা অতীতে কোন কর্মকান্ডে একক ঐকমত্যে না পৌঁছতে পারলেও, কেবল এ ভাষাটির প্রতি মমত্ববোধের কারণেই বায়ান্নতে আমরা একত্র হয়েছিলাম এবং তার পরিণতিতে আমরা একাত্তরে স্বাধীনতার মত একটি বীরত্বসূচক যুদ্ধেও অংশ নিয়ে দেশটিকে স্বাধীন করেছি সম্ভবত ভাষাটির মর্যাদাবোধ রক্ষার্থেই। রক্ত দিয়ে অর্জিত দ্রোহী বহমান এ ভাষাটিকে আমরা কি সুসংবদ্ধ পূর্ণবিকশিত সুস্থিত ভাষায় রূপান্তরের চেষ্টা করবো না? আমরা কি অঁাকড়ে থাকবো প্রথাগত খন্ডিত ব্যাকরণের সূত্র ধরে? বহুস্তরিক বহমান বাংলা ভাষাকে বিশৃঙ্খলতা থেকে বের করতে হবে আমাদেরই, যেমন আমরাই ভাষার জন্যে জীবন দিয়েছিলাম বায়ান্নোতে এবং তা এখনই।
ভাষা বিষয়ে জানতে আগ্রহি? তো পড়ুন পর্ব # ৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন