সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ওজনে কম দেয়ার এ দেশে ‘কত অজানারে’ ! # ১২৩

ওজনে কম দেয়ার এ দেশে ‘কত অজানারে’ ! 
প্রতারণাপূর্ণ এদেশে মাপে কম দেয়া এখন অনেকটা ‘বৈধ’ বলেই মনে করেন অনেক বিক্রেতা। আগে শুনতাম ‘মাংস বিক্রেতা’ মানে কসাইরা মাপে কম দেয়। তারা নানা কারসাজিতে ১-কেজির বদলে ৮০০ গ্রাম মেপে দিয়ে ‘ফাও’ হিসেবে পরিত্যক্ত হাড়-হাড্ডি দিয়ে এক কেজি পুরণের চেষ্টা করে। যেন কেউ চ্যালেঞ্জ করলেও ‘ফাও’ দেয়া জিনিসে মাপ ঠিক থাকে। লিচু কিনতে গেলে ১০০-টির বদলে ৭০-৮০-টি পাওয়া যায়। কেউ ১০০টি কিনে প্রকৃতপক্ষে ১০০টি পেয়ে থাকলে নিজেকে ভাগ্যমান মনে করতে হবে। আম-কমলা কিনলেও বিক্রেতা চোখে ধুলো দেয়ার মত ২-৩টি পচা আম বা কমলা অজান্তে দিয়ে দেয় ক্রেতাকে। পত্রিকায় ১৪৬০ বর্গফুটের ফ্লাটের বিজ্ঞাপন পেয়ে সরেজমিনে দেখতে গিয়ে পেলাম ১০৮০ বর্গফুট। ডেভলপার প্রথমে বোঝালেন, লিফট ও ‘কমন-স্পেস’সহ ১৪০০-বর্গফুট। হিসেবে লিফট ও কমন স্পেসের যায়গা ধরেও ১২০০ বর্গফুটের বেশী না হলে পরবর্তীতে জানালেন যে, ভবনের চারপাশে রাজউকের বিধিমোতাবেক যে যায়গা ছাড়া হয়েছে এবং রেকর্ড-এর চেয়ে বাস্তবে যে যায়গাটুকু কম আছে, তা ধরেই নাকি প্রথম বর্ণিত হিসাব। কিন্তু ডেভলপার প্রতারকের মত বানানো ফ্লাটের কক্ষগুলোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ইত্যাদি কাগজপত্রে লিখে রাখলেও ফ্লাটের ‘নিট-আয়তন’ জানাতে পারলো না।

বাজারে বর্তমানে নাকি বাটখারা ২-প্রকারের। একটি হচ্ছে ১০০০ গ্রামের কমের কেজি, যা দিয়ে বিক্রেতা মেপে বিক্রি করে, আর একটি হচ্ছে ১০০০ গ্রামের কিছু বেশী, যার মাধ্যমে দোকানী অন্য কারো থেকে মাল কিনে রাখে। এই বাটখারাগুলো আবার উৎপাদন করে ‘রাম-রহিম-যদু-মধু’ নামের যে কেউ যে কোন স্থানে। এর নিচে থাকে এক বা একাধিক ‘হোল’। ঐ হোলের ভেতরে ‘সিসার টুকরো’ ঢুকিয়ে সহজেই ওজন বাড়ানো যায় বাটখারার। আবার খুলে নিয়ে কমানোও যায় একই প্রক্রিয়ায়। আসলে টাকা যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক ছাপে, তেমনি ‘বাটখারা’ উৎপাদন করা উচিত কেবল ‘বিএসটিআই’-এর। তবে কেবল কি বাটখারার মাপেই মুদি দোকানী আমাদের ঠকায়? লঞ্চ বা বাসযোগে কোথাও যাবেন, প্রকৃত দূরত্বের চেয়ে বেশী দূরত্ব দেখিয়ে ভাড়া আদায় করবে আপনার থেকে অনেক বেশী। ঢাকা থেকে বরিশাল সড়ক পথে আরিচা হয়ে আগে দূরত্ব ছিল ২৭৭-কিমি। এরপর পাটুরিয়া ও মাওয়া সংক্ষিপ্ত নতুন রুট হল, পথ কমলো। কিন্তু ভাড়া এখনো ২৭৭-কিলোমিটারেই আদায় করা হয়, ওভাবে চার্টও টানানো আছে। আবার মাইলেজ ঠিক রেখেও নতুন পদ্ধতির ‘আধুনিক ডিজিট্যাল চুরি’ করে মানুষ ঠকাচ্ছে ঢাকার ‘সিটিং’ সার্ভিস নামক বাস গুলো। তারা প্রায় প্রত্যেক স্টপেজে টিকেট রাখে ‘অনেক আগের স্টপেজে’র। উদাহরণ হিসেবে উত্তর বাড্ডা থেকে বৈশাখী বাসে যাবেন আগারগাঁও। 

আপনাকে ২৫ টাকার যে টিকেট দেয়া হবে তাতে লেখা থাকবে ‘নতুন বাজার থেকে টেকনিক্যাল’ মানে আগে-পিছে প্রায় ৫-কিমি মাপে কম দেয়া। আবার গুলশান-১ এ গেলে দেবে মহাখালীর টিকেট ভাড়াও নেবে মহাখালীর। এবং এই প্রকাশ্য চুরি এখন ঢাকার প্রায় সব ‘সিটিং’ নামক ‘চিটিং’ বাস সার্ভিস করে থাকে। সিএনজি ও টেক্সিক্যাবগুলো প্রথমে ভাড়ার মিটারগুলোকে ‘ট্যাম্পারিং’ করে প্রতি ইউনিটে ৩-৪ টাকা বাড়িয়ে চুরি আরম্ভ করে, এমনকি কোন কোন সিএনজিতে রাস্তায় চলার চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ‘ওয়েটিং চার্জ’ মিনিটে লাফিয়ে লাফিয়ে ২-টাকা পর্যন্ত ওঠার কারসাজির ট্যাম্পারিং করার পরও তাদের লোভ তথা ‘খায়েশ’ এতো বেড়েছে যে, তারা প্রায় দ্বিগুণ/তিনগুণের নিচে আর কোথাও যেতে চায়না, মানে কোথাও যেতে চাইলেই যাত্রীকে গুণতে হবে ‘মিনিমাম’ ১০০-টাকা, যদিও মিটারে ২৫ টাকা ওঠার কথা। এইসব ‘ছিঁচড়ে’ চোর ছাড়াও আবার বড় বড় বিলিয়ন ডলারের মোবাইল কোম্পানীগুলো কিভাবে মাপে কম দেয়, তা কি চিন্তা করেছেন? তারা চুরি করে ‘পালস’-এর নামে ও বিজ্ঞাপন কারসাজিতে। ৬০ সেকেন্ড কথা বললেই মোবাইল কোম্পানী চার্জ কাটবে ২-মিনিটের ৬০-সেকেন্ড পালস-এর নামে। এখানেও মুদি দোকানীর মত ওজনে কারচুপি। আর চমৎকার বিজ্ঞাপনে মোহিত করে বলছে যে, ‘‘---’’ কলের প্রতি মিনিট চার্জ মাত্র ০.৭৯ টাকা। আর নিচে খুব ছোট অক্ষরে লিখে রাখলো ‘‘প্রথম মিনিটে আরো অতিরিক্ত চার্জ ০.৩০ টাকা যোগ হবে’’। আসলে তাদের প্রকৃত চার্জ হচ্ছে ১.০৯+ভ্যাট। আর ‘গ্যারান্টিযুক্ত’ মোবাইলগুলো যখন কোন সমস্যা করে, তখন তা বদলাতে গেলে প্রথমে ৫-৭ দিন পরের একটি তারিখ দেয়া হয়, তারপরও মেরামতের নামে ‘পার্টস’-এর দাম চেয়ে বা নানাভাবে আদায়ের প্রচেষ্টা করে, যাতে সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আমরা আসলেই একটি প্রতারক বা প্রতারক পর্যায়ের জাতি। পল্টনে অনেক ব্যানারে বিজ্ঞাপন ঝুলছে ৫০০-ভিজিটিং কার্ড মাত্র ২০০-টাকা। যোগাযোগ করলে বলা হয়, কম্পোজের জন্যে অতিরিক্ত চার্জ লাগবে ৫০-৬০ টাকা। আসলে প্রকৃত চার্জ হচ্ছে ২৫০/৬০ টাকাই। আর দাম চাওয়া-চাওয়ি, দর কষাকষি, ভাল ‘স্যাম্পল’ দেখিয়ে খারাপ মাল প্যাকেট করে দেয়া ইত্যাদি নানাবিধ দুর্নীতির কথা আর কি বলবো।

এই যে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ওজনে কম দেয়া বা মানুষ ঠকানো এ জাতির একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটানো দরকার এবং এ কাজটি শুরু করতে হবে সরকারকেই। পারিবারিক নির্যাতন বা এসিড সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশে বর্ণিত দু’টো অপরাধের দ্রুত বিচারের জন্যে কঠোরতর আইন করা হয়েছে। আমাদের ওজনে কম দেয়ার বর্ণিত প্রবণতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে কঠোরতর আইন প্রণয়ন করা জরুরী নয় কি?     
      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন