শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমার ভাষা বিষয়ক চিন্তন প্রপঞ্চ # ১ : ভাষা প্রবন্ধ # ৫৪

আমার ভাষা বিষয়ক চিন্তন প্রপঞ্চ # ১
(বাঙলা ভাষার আধুনিকায়ন তথা সংস্কার বিয়ষক ১০-টি পোস্টের সিরিজ)

পৃথিবীতে ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে তথা আত্মিক প্রেমের কারণে যে জাতিটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পৃথক একটি ভাষিক অঞ্চলের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে আলাদা একটি রাষ্ট্র নির্মাণে সক্ষম হয়েছিল, সে জাতিটির নাম বাঙালি, আর ভাষাটি নিঃসন্দেহে ‘বাংলা’। 

শুনলে হয়তো বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় যে, এ ভাষাটির পৃথক কোন আধুনিক ব্যাকরণ নেই, রচিত হয়নি অদ্যাবধি, ভাষাটিও নানা প্রপঞ্চে অব্যাকরণিক জটিল আবর্তে নিমজ্জিত। ব্যাকরণ হচ্ছে ‘ভাষা বিশ্লেষণ শাস্ত্র’ কিংবা বলা যেতে পারে, ‘শুদ্ধ শব্দ নির্মাণ বিদ্যা’। হাজার বছরের মধুর, কোমল, দ্রোহী গ্রামীণ প্রাকৃত নদী তীরের মানুষের ভাষা হচ্ছে এ ‘বাংলা’। এ ভাষায় কোন ধর্মীয় পুস্তক তথা পূণ্যশ্লোক রচিত হয়নি কখনো কিংবা এ দেশীয় শাসকের ভাষাও ছিলনা কখনো ‘বাংলা’। বাংলাভাষী বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মীয় কিতাব তথা ত্রিপিটকের ভাষা হচ্ছে ‘পালি’, হিন্দুদের বেদ-পুরাণের ‘সংস্কৃত’, খ্রিস্টানদের বাইবেলের ‘হিব্রু’, আর মুসলমানদের পবিত্র কোরানের ভাষা হচ্ছে ‘আরবি’। যে কারণে বাংলা লক্ষ-কোটি সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত মাতৃভাষা হলেও, তা চিরদিনই ছিল অবহেলিত আর অবাঞ্ছিত ভাষা গোত্রীয়। 

বাঙালির সপ্তপদী বিষ্ময়কর ঘটনার মতই আরেক বিষ্ময় হচ্ছে, এ ভাষাটির জন্যে প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন ‘অবাঙালি’ একজন ধর্মযাজক মানুয়েল দ্য আসসুম্পসাঁও, যা প্রকাশিত হয় লিসবন থেকে ১৭৪৩ সনে রোমান হরফে ‘ভোকাবুলারিও এম ইদিওয়া বেনগল্লা ই পর্তুগিজঃ দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস’ নামে! এরপর ন্যাথেনিয়েল ব্র্যাইসি হ্যালহেড ‘বাংলা হরফে’ প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচণা করেন ১৭৭৮ সনে। উইলিয়াম কেরী ১৮০১ সনে রচনা করেন A Grammar of the Bengali Language নামে ‘বাংলা ব্যাকরণ’। বাংলাসহ পূর্ব ভারতীয় ভাষার মিশ্র ব্যাকরণ রচনা করেন হেরাসিম লেবেদেফ ১৮০১ সনে। ১৮২০ সনে জিসি কীথের বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়। ১৮২১ সনে প্রকাশিত হয় জিসি হাউটনের Rudiment of Bengali Grammar নামে বাংলা ব্যাকরণ। এর আগে ১৮১৬ সনে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বাঙলা ব্যাকরণ’ প্রকাশিত হয়, যিনি ছিলেন মূলত ‘বাঙালি’। এরপর বীমস, ফার্গুসন থেকে গ্রীয়ারসন পর্যন্ত অনেকেই রচনা করেছেন ‘বাংলা ব্যাকরণ’, যা মূলত সংস্কৃত ও ইংরেজী ব্যাকরণের ঢং-এ রচিত কৃত্রিম ‘বাংলা’ ভাষিক ব্যাকরণ মাত্র। 

পাটিলিপুত্র রাজাদের অভিবাসিত ও পুরস্কৃত বিদ্যাজীবী ‘পাণিনি’ বিবৃতিমূলক সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করেন যিশুর জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে। উপর্যুক্ত ব্যাকরণ রচয়িতাগণ ‘পাণিনীয়’ ব্যাকরণিক ধারাকে গ্রহণ করে অবৈজ্ঞানিকভাবে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও, যার মূলত জন্ম বাংলা ভাষার জন্মের অনেক আগে! বাঙালির ব্যাকরণ হচ্ছে, প্রথাগত সংস্কৃত ব্যাকরণের বিধিবিধান আর সূত্রগুলোকে বাংলায় প্রচার আর প্রকাশ মাত্র। এ ব্যাকরণ পাঠে তুলনামূলক কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, অর্থতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব বিশ্লেষণের পরিবর্তে বর্ণনামূলক কিছু সূত্র শেখা সম্ভব। এগুলো বিদ্যালয়পাঠ্য প্রথাগত ব্যাকরণ পুস্তক নিঃসন্দেহে কিন্তু আধুনিক বাংলা ‘ভাষা বিশ্লেষণ শাস্ত্র’ নয়। সংস্কৃত ব্যাকরণ কাঠামোতে বর্ণিত হয়েছে প্রায় সকল বাংলা ব্যাকরণ। সংস্কৃত ব্যাকরণ হচ্ছে বেদ-নির্ভর। এ ব্যাকরণ আনুশাসনিক ও শব্দকেন্দ্রিক। 

বাংলা ব্যাকরণ কখনো ইংরেজি ও সংস্কৃত ব্যাকরণের বাইরে যেতে পারেনি। যদিও বাংলা ভাষা ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষা থেকে পৃথক একটি ভাষা। আসলে সঙ্কর বাঙালি জাতির মত ল্যাটিন, ইংরেজী ও সংস্কৃত ব্যাকরণের সঙ্করে সৃষ্ট বাংলা ব্যাকরণ পুস্তকরাজিগুলো। আমাদের প্রচলিত প্রথাগত ব্যাকরণের শব্দ বিশ্লেষণ সর্বাংশে আবার অসংস্কৃত অনুসারী। এর কারকতত্ত্ব সংস্কৃত, উদ্দেশ্য-বিধেয়ভিত্তিক বাক্যতত্ত্ব আবার ইংরেজি বাক্য অনুসরণে রচিত। আমাদের উল্লিখিত ব্যাকরণবিদগণ কেবল ‘প্রথাগত ব্যাকরণে’র মধ্যেই আবদ্ধ থেকে হাবুডুবু খেয়েছেন, আধুনিক রূপতত্ত্বের আলোকে বর্ণিত কোন ব্যাকরণেই আলোকপাত করেনি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে। এ থেকে মুক্ত হয়ে বের হতে পারেননি ড. সুনীতিকুমার তাঁর ‘ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণে’ কিংবা ড. শহীদুল্লাহ তাঁর ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ নামক পুস্তকেও। প্রায় আড়াইশো বছরের প্রথাগত বর্ণনামূলক ধ্রুপদী সংস্কৃত ব্যাকরণের সূত্র পর্যালোচনাই হচ্ছে ‘আধুনিক’ বাংলা ব্যাকরণচর্চা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন