শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

১৫ আগস্টের দু:খগাঁখার কাব্য # ৪ : প্রবন্ধ # ৪৮

একটি ঋণাত্মক স্লোগান “হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ মুজিবের বাপের নাম” এবং এর স্বরূপ সন্ধান
:
বিগত ২০০৮ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম ভোট দিতে। ধর্মান্ধতায় ঘেরা কুসংস্কার আর জামাত-হেফাজত-বিএনপি সমর্থিত এলাকাটিতে একটি স্লোগান ধর্মান্ধ অনেকের মুখে মুখে ভাসছিল, আর তা হচ্ছে “হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ মুজিবের বাপের নাম”। বাজারের ব্যানারেও স্লোগানটি লেখা দেখলাম প্রকাশ্যে! এলাকায় একটি প্রপাগান্ডাও ছড়ানো হয়েছিল প্রবলভাবে যে, ‘শেখ মুজিব হিন্দু পরিবারের সন্তান’, যে কারণে বিগত নির্বাচনে নৌকার প্রবল বাতাসেও বিএনপি প্রার্থী সংসদ নির্বাচিত হন ঐ আসনে। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আলেম সমাবেশে তার পরিবারের ব্যাপারে ঐরূপ নেতিবাচক সমালোচনার ব্যাপারেও তাঁর দু:খবোধ ও আক্ষেপ প্রকাশ করতে দেখলাম! টুঙ্গীপাড়ার শেখ পরিবারের ধর্ম বিষয়টা কিছুটা ধোঁয়াশা থেকে সুষ্পষ্ট হলো বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠে। নিরাভরণ সত্য কথনের সহজ সরলতার বর্ণনা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’কে অনেকটা তৃপ্তির সমাপ্তি দিয়েছে, দিয়েছে শেখ পরিবারের ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়টির স্বচ্ছতর মিমাংসাও অনেকটা।
:
এ পরিবারের ইতিহাস খুঁজে নানা সূত্রে জানা যায়, সূদুর ইরাকের বাগদাদ থেকে এসেছিলেন হযরত বায়েজিদ বোস্তামী এদেশে। মুসলিম দর্শনের এক বিখ্যাত ওলী তথা আল্লাহর খাস বান্দা ছিলেন তিনি। এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারের এক অগ্রনায়কও বটে। শেখ পরিবারের পূর্ব পূরুষ শেখ আউয়াল ছিলেন হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর সুযোগ্য শিষ্য ও প্রচারক। দীর্ঘকাল পর তাঁর বংশধর শেখ বোরহান উদ্দীন বসবাস শুরু করেন টুঙ্গিপারায়। তখন থেকেই তাঁদের পরিবারকে লোকে টুঙ্গিপাড়ার ধার্মিক শেখ পরিবার হিসেবে চিনতো। সেই ঐতিহাসিক শেখ পরিবারের সুযোগ্য সন্তান “শেখ মুজিবুর রহমান”, নিরাভরণ নির্লিপ্ত আবেগ বর্জিত ভাষায় বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের পুরো ঘটনা প্রবাহ লিখতে গিয়ে বলেন, “তাঁর বংশের গোড়াপত্তনকারী শেখ বোরহান উদ্দিন কবে থেকে পুর্ববাংলায় লেখকের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় এসে বসবাস করতে থাকেন, তার কোন আদি ইতিহাস পাওয়া যায় না, যে টুকু স্মৃতি অবশিষ্ট ছিল, তা হচ্ছে প্রায় দুইশত বছরের পুরাতন কিছু দালান। যার ৪-টি ভবন নির্মিত হয়েছিল মোঘল আমলে”, পার্শ্ববর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী কাজীরাও ছিলেন মুসলিম বনেদী পরিবার। যাদের সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমায় ধনবান শেখ পরিবার ধনহীন পরিবারে রূপান্তরিত হন নানা পথ-পরিক্রমায়, যার ইতিহাসও পাঠক জানতে পারেন এ আত্মজীবনী থেকে।
:
সুতরাং বাংলাদেশে বসতি স্থাপনকারী কোন পরিবারই টুঙ্গীপাড়ার শেখ পরিবারের চেয়ে বেশী ধার্মিক ছিলেন, এ কথা ইতিহাস স্বীকার করেনা। কিন্তু প্রগতি বিরোধী, ধর্মীয় কুসংস্কার আর অন্ধকারে বসবাসকারী স্বার্থবাদী মোল্লাদের আর কি অস্ত্র আছে এ ধর্মান্ধতা ছাড়া? যে অস্ত্রটি তারা আবার প্রয়োগ করেন পাকিস্তান বিরোধী অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনের প্রাক্কালেও। যা নিজেই বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনে বর্ণনা করেছেন চমৎকার সহজ ভঙ্গিমায়। নিজ ইউনিয়নের মাওলানা, শর্ষিণা, বরগুনা, শিবুপুর আর রহমতপুরের আলেমরা একযোগে ফতোয়া দিলেন, “মুজিবকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না”, যদিও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য মুসলিম লীগে সমর্থন করে আন্দোলন করেছিলেন অনেকদিন, পরে সেই মুসলিম লীগের অত্যাচার এবং দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিরোধী দল গঠন করলেন এবং হলেন মুসলিম লীগ আর পাকিস্তানের সর্বোচ্চ শত্রু! তারাই অপপ্রচার চালালো “মুজিবকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না”।
:
যদিও বঙ্গবন্ধু তার প্রায় সব কথাবার্তা ও বক্তৃতায় ‘ইনশাল্লাহ’ বলতেন। প্রমাণস্বরূপ আমরা তার ৭ই মার্চের ভাষণ তুলে আনতে পারি যেখানে তিনি বলেছিলেন “--এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ”, বঙ্গবন্ধু বলতেন, “আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আরেকটা হল আমরা বাঙালি”, এই বাঙালি হওয়াই তার অপরাধ ছিল এবং এই অপরাধেই তাকে ও তার পরিবারকে কম্যুনিস্ট, নাস্তিক, “হরে কৃষ্ণ হরে রাম, শেখ মুজিবের বাপের নাম” ইত্যাদি ঋণাত্মক অভিধায় ভূষিত হতে হয়েছিল।
:
এবং বিস্ময়করভাবে এ ২০১৫-সনেও ধর্মের ঐ ভোঁতা অস্ত্রটি এখনো প্রয়োগ করতে চাইছে ধর্মব্যবসায়ীরা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রতি। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ২-নেত্রীর তুলনা করলে নিরপেক্ষবাদীরা অবশ্যই শেখ হাসিনার পাল্লা ভারী দেখলেও, জামাত-শিবির-হেফাজত আস্তিকতা খুঁজে পান বিএনপি নেত্রীর কাজকর্মে, আর নাস্তিকতায় ভরপুর দেখেন মুজিবকন্যার ফজরের নামাজ পরবর্তী কোরান তেলাওয়াত করে দিনের কর্মসূচির সূচনাকে! সচেতন পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম ধার্মিকতা আর অধার্মিকতার ব্যাপারে সত্যাসত্য নির্ণয়ের এ সুনিপুণ সূত্র!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন