সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমাদের খাদ্যাভ্যাস, ভেজাল ও ১০০% ঔষধভোগী মানুষ # ১২০

আমাদের খাদ্যাভ্যাস, ভেজাল ও ১০০% ঔষধভোগী মানুষ 
৩-সদস্যের ছোট পরিবার আমার, ঢাকায় বসবাস করি। শিক্ষিত পরিবার হিসেবে খাবার ইত্যাদির ব্যাপারে ‘স্বাস্থ্য সচেতন’ মনে করি নিজেদের। কিন্তু তারপরও স্ত্রীকে দৈনিক ১৬-প্রকার, নিজেকে প্রত্যহ ৩-প্রকার এবং একমাত্র কন্যাকেও কোন না কোন ঔষধ খেতে হয় প্রায়ই। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামি আমি। প্রথমে ১০টি আত্মীয় পরিবারের উপর এবং পরবর্তীতে ১০০০ সহকর্মী, পরিচিত জনের তথ্য সংগ্রহে জানতে পারি যে, বর্তমানে বাংলাদেশের ১০০% মানুষ (২-১টি ব্যতিক্রম থাকলেও তার তথ্য পাইনি) কোন না কোন রোগে আক্রান্ত এবং প্রায় সবাই এ্যালোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক, ইউনানী, হার্বাল, ফকিরী কিংবা অলৌকিক অর্থাৎ যে কোন ধরণের চিকিৎসা নিচ্ছে। নিদেন পক্ষে তেলপড়া, পানিপড়া, তাবিজ ব্যবহার করছে মারাত্মক হাঁটু (আর্থারাইটিজ) কিংবা কোমর ব্যথার জন্যেও।
 
সপ্তপদী মোট ১৩৫ পরিবারের ১০০০ জনের তথ্যানুসন্ধানে জানতে পেরেছি, ৮০ থেকে উপরের বয়সী প্রায় সবাই ডায়াবেটিস, হাঁটু ও কোমরে ব্যথা, চুলকানি, ছানী পড়া, দাঁতের ব্যথা, কানের সমস্যা, অনিদ্রা, কিডনী, হার্ট, পঙ্গুত্ব, হাঁপানী, মাথা ঘুরানীসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে বেশ ক’জন শয্যাশায়ী বিছানায়। ৫০-৭৯ বছর বয়সীদের মধ্যেও ডায়াবেটিস, জন্ডিস, নানা প্রকার ব্যথা, এ্যাঞ্জাইমা, অনিদ্রা, গ্যাসট্রিক, কিডনী, হার্টের সমস্যা, মহিলাদের নানাবিধ গাইনী সমস্যা, চোখের সমস্যা, কানের সমস্যা, দাঁতের সমস্যা, রিউমেটিক ফিভার, আর্থারাইটিজ ইত্যাদি এক বা একাধিক রোগে আক্রান্ত কেউ না কেউ। ৩০-৪৯ বছরের মধ্য বয়সীরাও উপর্যুক্ত প্রায় সব রোগেই আক্রান্ত ছাড়াও নানাবিধ প্রদাহ, চর্মরোগ, মাইগ্রেন, গলা ও পেটের নানাবিধ রোগ ইত্যাদিতে ভুগছে। ১৫-২৯ বছরের তরুণ-তরুণীরা তুলনামূলক কম রোগে আক্রান্ত হলেও, সবাই কোন না কোন রোগের শিকার। কারো পেটে ব্যথা কিংবা মাথ্য ব্যথা। কিডনী-হার্ট-ক্যান্সারের মত জটিল রোগে আক্রান্ত এইসব অল্প বয়সী তরুণ-তরুণীরাও। টিউমার, হাই প্রেসার, ভাসকুলার ডিজঅর্ডার, গ্যাংগ্রীন, বেলস পলসিতে আক্রান্ত কেউ কেউ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ১ দিনের শিশু থেকে ১৫ বছরের নিচের শিশুরাও আক্রান্ত নানাবিধ ছোট-বড় জটিল রোগে। ৬-মাস বয়সী যমজ ২-ভাইর একটি মারাত্মক কিডনী রোগে আক্রান্ত এখনই। ২-মাস বয়সী শিশুকেও নিয়মিত খাওয়াতে হয় প্যারাসিটামল, নানা নামের এন্টিবায়োটিক, কাশির ক্যাফিন আর মেট্রানিডাজল সিরাপ। সপ্তপদী চুলকানী ও ডায়াবেটিস প্রায় সব ঘরেই। অনেক ঘরেই শিশুদের নিয়মিত ঔষধ খাওয়ানোর কারণে সিরাপের বোতল সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেকটা মিনি ফার্মেসীর মত।

অনুসন্ধান চালানো ঘরগুলোতে কাউকেই রোগ তথা ‘ঔষধহীন’ পাওয়া যায়নি। উচ্চবিত্তরা বাংলাদেশের বড় ডাক্তার ও ক্লিনিক ছাড়াও সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক নিদেন পক্ষে ভারতে চিকিৎসা করাতে যাচ্ছেন নিয়মিত। মধ্যবিত্তরা ঢাকা ছাড়াও প্রায়ই ভারত যান সস্তা ও তুলনামূলক ‘ভাল’ চিকিৎসার আশায়। নিম্নবিত্তরা বাংলাদেশের এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় অনেকে ‘বিফল’ হয়ে হোমিওপ্যাথিক, বনাজী, আয়ুর্বেদিক, ইউনানী তথা সস্তা চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত নির্বিশেষে বেশ ক’জন বাংলাদেশের ঔষধ ও চিকিৎসার উপর ‘আস্থা’ হারিয়ে তাবিজ, স্বপ্নেপ্রাপ্ত ঔষধ, পীর-ফকিরের দ্বারস্থ হয়েছেন। জোঁকের তেল, ধনেশ পাখির তেল, গ্রাম্য লতা-পাতার চিকিৎসা নিচ্ছেন কেউ কেউ। তবে প্রায় সবাই কোন না কোন কোন ডাক্তারের ‘তত্ত্বাবধানে’ আছেন, যদিও এ ক্ষেত্রে কারো কারো ‘ডাক্তার’ মূলত তাবিজ, পানিপড়া, লতাপাতা প্রদানকারী তথাকথিত কোয়াক ‘ডাক্তার’।

অধিকাংশ পরিবারেই এখন চাল-ডাল-তেল-নুনেন মত ঔষধ কেনেন নিয়মিত। ফার্মেসী এখন মুদি দোকানের মত যত্রতত্র দেশের সর্বত্রই, যাতে ভিড়ও মুদী দোকানের মতই। গ্রাম ও শহরের প্রায় প্রত্যেকটি ফার্মেসী এখন সজ্জিত বিভিন্ন আকর্ষণীয় রং, ঢং, গেটআপ, মোড়ক আর প্যাকিংয়ের ঔষধে। সম্প্রতি গ্রামে গিয়ে বড় ভাইর ‘এ্যাটজ সিনিয়র’ নামে ৭-দিনের ১টি মাল্টিভিটামিনের পাতা দেখে আমি রীতিমত বিস্মিত। নানাবিধ কালারের ৭টি ট্যাবলেটকে প্রথমে দামী বিদেশী এ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে ব্লিস্টার প্যাকেটজাত করার পর, পাতাটিকে আবার অন্য আরেকটি দামী মোড়কে পুন. র‌্যাপিং করা হয়েছে। পাতাটির গায়ে প্রত্যেকটি ট্যাবলেটকে ৭-দিনের ‘বার’ দিয়ে আবার চিহ্নিত করা হয়েছে শনি, রবি, সোম ইত্যাদি হিসেবে। অথচ আমেরিকার তৈরী ‘এস্ট্রাফ্লেক্স’ কিংবা ভারতে প্রায় সব দামি ঔষধ খোলা হিসেবে ১০০-টির বোতলে পাওয়া যায় তুলনামূলক সস্তা দামে। প্রায় নিয়মিত কিনতে হয় ‘রেনিটেডিন’ ২ টাকা প্রতিটি হিসেবে। বক্সের গায়ে ১০০ ট্যাবলেটের দাম ২০০ টাকা লেখা থাকলেও, ‘ফামের্সীর জন্যে’ বলে পাইকারী হিসেবে ‘এডরুক’ কোম্পানীর ১০০ ট্যাবলেট কিনলাম মাত্র ৬৩ টাকায়, যার খুচরা দাম লেখা ২০০ টাকা!

কেন এতো রোগ ঘরে ঘরে? কিছুদিন আগে ভারতীয় জনৈক ডাক্তারের হার্ট বিষয়ক একটি সেমিনারে অংশ নিয়ে জানতে পারি, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস বিশেষ করে তেলযুক্ত (তাও আবার ভেজাল তেল) খাবারের কারণে ঘরে ঘরে এতো হার্টের রোগের ছড়াছড়ি। অনেকবার চীন ভ্রমনের সুবাদে দেখেছি, চীনারা পালনশাক, ফুলকপি বা বরবটি মাত্র ২-মিনিট বাষ্পে সিদ্ধ করে সামান্য লবন বা সস দিয়ে খেয়ে ফেলছে অন্য কোন মশলা ছাড়াই। মোট খাবারের ৫ ভাগের ১ ভাগ ভাত সামান্য বাটিতে, আর ৪ ভাগ ঐ জাতীয় বিনা তেলের সামান্য সিদ্ধ হরেক রকম সবজি-মাছ! ব্যাংককের হোটেলগুলো ‘হাইজিনিক’ খাবার ছাড়াও, সন্ধ্যার পর সকল ফুটপাতে বসে ‘মোবাইল খাবার হোটেলের’ মেলে। তাজা শাকসবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদি নিয়ে মহিলারা বসে ফুটপাতে। কাস্টমারের চাহিদামত অল্প সময়ে তারা তৈরী করে দেয় ‘তাজা’ অথচ গরম গরম যে কোন প্রকার খাবার। ফুটপাতে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে উচ্চবিত্তসহ সবাই বসে খেতে পারে সে খাবার।

কিন্তু দুঃখজনক সত্য, অন্য অনেক জিনিসের মতই আমরা আমাদের খাবার তৈরী, পরিবেশন, খাবার রীতিতে পরিবর্তন আনতে পারিনি। ঢাকাসহ দেশের সকল বাণিজ্যিক হোটেল-রেস্তোরায় মাছ-মাংস এতো মশলা দিয়ে তৈরী করা থাকে যে, কোনটি কি মাছ বা কিসের মাংস বোঝা কষ্টকর। তা ছাড়া রেস্তোরার একদিনের তৈরী করা খাবার অধিক তেল ও মশলাযুক্ত হওয়ায় পরের দিন সহজেই তা ‘তাজা’ বলে পরিবেশন করা এদেশে একটি স্বাভাবিক রীতি। বিয়ে-সাদিসহ সকল সামাজিক অনুষ্ঠানে সাধারণত কোন শাক-সব্জি থাকে না, সবই মাছ-মাংস-তেলজাত ‘রিচফুড’। ফুটপাতের নিম্নমানের হোটেলের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বাদই দিলাম, ঢাকার তথাকথিত ‘ভদ্র’ শ্রেণির হোটেল- রেস্তোরার কিচেন ও তার ‘পাক প্রণালী’ দেখলে অনেক মানুষই আর কখনো হোটেলে খাবেনা বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তথাকথিত ফুটপাতের ‘মিনারেল ওয়াটারের’ সাথে আমরা আর কি কি জীবন্ত প্রাণি পান করছি, তা ‘আল্লা-মালুম’। আর ভেজালের কথা কি বলবো? দেশের খাবারের অধিকাংশ ভেজালে সয়বাল। চমৎকার মোড়কে প্যাকেটজাত আটা কিনে রুটি মুখে দিতে পারিনা, গাছের গুড়ার গন্ধে। 

৮০ টাকা কেজি হিসেবে  ‘খেজুরের পাটালী গুড়’ কিনে ভেঙে দেখি তার ভেতরের রং অন্য রকম। চাপাচাপিতে দোকানী বললো, চিনির সঙ্গে চিটাগুড় ও রং মিশিয়ে এ পাটালী তৈরী করা হয়েছে। বিশেষ কারণে ‘চিরতা’ পাতা কিনে বুঝতে পারলাম, পাতাটি আসল চিরতা নয়, অন্য গাছের পাতায় কিছুটা তেতো কেমিক্যাল দিয়ে চিরতা বানাতো হয়েছে। এভাবে সর্বত্রই আমাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র ভেজালে পূর্ণ। ঘি, সেমাই বা মাছ কিনে নিজেরা কখনো ভেজাল ধরতে পারলেও, বাংলাদেশের অনেক কোম্পানীর ‘চমৎকার’ মোড়কে সজ্জিত ঔষধের ভেতরে কোনটি আসল, আর কোনটি শুধু ‘ময়দা বা পাউডার’ দেয়া তা সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা বুঝবো কি করে? প্রায়ই পত্রিকায় দেখি, ঢাকা পাইকারী ঔষধের বাজার মিটফোর্টে র‌্যাব কর্তৃক নকল ঔষধ ধরা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের ঘরে ঘরে নানারোগে আক্রান্ত প্রায় সকল মানুষের একই কথা, ‘ঔষধে রোগ সহজে সারছে না’। তাই তারা এক ডাক্তার থেকে অন্য ডাক্তারের কাছে, এক সিস্টেম থেকে অন্য সিস্টেমে, এমনকি তাবিজ কবজের দিকে ঝুকে পড়ছে অন্যন্যপায় হয়ে!

এ থেকে এ জাতির উত্তোরণ কি ঘটবে না? ঘটা দরকার একটি জাতিকে বাঁচানোর জন্যেই! তা না হলে একটি জাতির ১০০% মানুষই কি কোন না কোন রোগে আক্রান্ত থাকবে চিরকাল এবং মুড়ি-চিড়ার মতই প্রত্যহ ঔষধ খেতে থাকবে সকাল-বিকেল? একটি রোগমুক্ত সুস্থ্য জাতির জন্যে আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, হোটেল রেস্তোরার মান কঠোরভাবে বজায় রাখা, সামাজিক অনুষ্ঠানে শাকসব্জির মত সাধারণ খাবার পরিবেশনের রীতি প্রবর্তন, ঔষধের উৎপাদন ও বিপণনকে ভেজালমুক্ত করা অত্যাবশ্যক বলে মনে করি। তাহলে হয়তো জাতিটি বাঁচলেও বাঁচতে পারে সুস্থ্য জাতি হিসেবে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন