সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

`এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি' ! কবির আগাম ‘ব্যাজস্ত্ততি’ কি? # ১৪২

`এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি' ! কবির আগাম ‘ব্যাজস্ত্ততি’ কি? 
বাংলা অলঙ্কারশাস্ত্রের অন্যতম একটি অনুসঙ্গ হচ্ছে ‘ব্যাজস্ত্ততি’, যার মানে হচ্ছে ‘ছলপূর্ণ কথা’ বা ‘নিন্দাচ্ছলে প্রশংসা’ কিংবা ‘স্ত্ততিচ্ছলে নিন্দা’। ‘ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটির ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ চরণটি ছোটবেলা থেকেই শুনে শুনে এর ‘যথার্থ অর্থ’ উদ্ধারে লেখক এখন ‘প্রকৃত সংকটে’ নিমজ্জিত। এখনকার বাংলাদেশের চরম ‘নেতিবাচক’ সামাজিক বাস্তবতায় তাহলে কি কবি ‘ব্যাজস্ত্ততি’ রূপকার্থে এ চরণটি লিখে গেছেন? ‘ভবিষ্যত দ্রষ্টা’ কবির উপর্যুক্ত বাক্যটি পর্যালোচনা করা যাক আজকের পত্র-পত্রিকার শিরোনামগুলো থেকে।

একটি দৈনিকের গা শিউরে ওঠা শিরোনাম হচ্ছে, ‘‘হা পা ও পুরুষাঙ্গ কেটে বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করা’’। খবরে প্রকাশ, এ চক্রটি বর্ণিত কাজ ছাড়াও, অপহৃত শিশুদের এ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে ৬-মাস বন্ধী রেখে, পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করে ভিক্ষাবৃত্তির বাণিজ্যিক কাজে নিয়োগ করে। উপরের খবরের চেয়েও এক ডিগ্রী ‘ভয়াবহ’ হচ্ছে, ‘‘বর্ণিত ঘটনায় পুলিশের সহায়তা চেয়েও না পাওয়া বরং পুলিশ কর্তৃক বাধার সম্মুখীন হওয়া’’। হায়! ত্রিশ লাখ মানুষের রক্তে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশ! একই পত্রিকার আরো ‘ইতিবাচক(?)’ খবরগুলো হচ্ছে - দুলাভাই কর্তৃক শ্যালিকাকে ধর্ষণ ও হত্যা, দখলের কারণে তুরাগ নদী এখন সরু নালা, চুল কেটে গৃহবধুকে গ্রামছাড়া, নার্স এখন নবজাতক চোর-চক্রের প্রধান, মাদ্রাসা শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওচিত্র বাজারে, ঘুষ না দেয়ার কারণে শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জমাকৃত দরখাস্ত হারিয়ে যাওয়া, অর্থ আত্মসাতের দায়ে সাবেক ষ্পিকার জমির উদ্দিন সরকার, সাবেক ডেপুটি ষ্পিকার আখতার হামিদ ও সাবেক চী হুইফ খন্দকার দেলোয়ারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা। হায়!(২য় বার)।

বর্ণিত শিরোনামগুলো একদিনের একটি পত্রিকার। সাম্প্রতিক সময়ের আরো বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত এ প্রেক্ষেতে উদ্ধৃতির অবকাশ রাখে। প্রেম ভালভালবাসা পৃথিবীর সকল দেশে সকল মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকলেও, সম্ভবত বাংলাদেশেই ‘প্রেমে ব্যর্থ হলে’ আক্রোশ বসত এসিডের মত একটি মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয় আধুনিক ঘৃণ্য অস্ত্র হিসেবে। এদেশের ‘ইভ নিজিং’ও এই শ্রেণীর নিম্নরুচির পরিচয় দেয় সর্বত্র। মানুষের খাবার আর জীবন রক্ষাকারী ঔষধে ভেজাল এবং জেনেশুনে কেবল অধিক কমিশনের আশায় সর্বত্র অবাধে বিক্রি সম্ভবত বিশ্বের এদেশটি ছাড়া আর কোথাও চোখে পড়বে না। এদেশের মানুষ এখনো বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে কেন ১৫ টাকার পিয়াজ ৫০ টাকায় উঠে যায় এবং তা নামতে বেশ সময় লাগে! যাত্রীরা এও জানেনা, পুলিশ কন্ট্রোল রুমের নম্বর দেয়া থাকলেও, টেক্সিগুলো কেন মিটারের চেয়ে ২/৩ গুণের কম ভাড়ায় যেতে চায়না এবং পুলিশ সব জেনেও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে যায়! অনরূপভাবে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া নির্ধারিত থাকলেও, বাসগুলো কেন ৫ কিলো দূরত্বের জন্যে ১৫ কিলোর ভাড়া আদায় করে দিন-দুপুরে সবার সামনে! শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা যে প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজে পায়না তা হচ্ছে, ইসলামে নরহত্যা মহাপাপ ও আত্মহত্যাকারী ‘জাহান্নামী’ হবে জেনেও, কেন ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের জন্যে(?) 
 
জেএমবি কিংবা এই জাতীয় চিন্তাধারার লোকেরা নিজে আত্মহত্যা করে এবং অন্য মুসলমানদেরও হত্যা করে অবলীলায়! মাওয়া ঘাটের যাত্রীরা বুঝতে পারে না, ষ্পীডবোটে ওঠার জন্যে কোন ‘ঘাট’ না থাকলেও, কেন যাত্রীকে ভাড়ার সঙ্গে ‘ঘাটভাড়া’ অতিরিক্ত ২০ টাকা দিতে হয়। মাংস ক্রেতা ধরতে পারেনা, কসাই ১-কেজির নামে প্রকাশ্যে সবার সামনে তাকে ৮৫০ গ্রাম ‘হাড্ডিগুড্ডি’সহ মাংস ধরিয়ে দেয় সর্বত্র! হরতালবিরোধী ব্যক্তি কখনোই মনকে বোঝাতে পারেনা, তার ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার বলে কেন তিনি হরতালের দিন নিজের দোকান খুলতে পারবে না কিংবা কেন রাস্তায় নামানোর ‘অপরাধে’ তার গাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়া হলো। যানজটে ২-ঘন্টা আটক বিরোধীদলের সমর্থকও ঠিক মেলাতে পারেনা, কেন বিরোধীদল বিশাল খোলা ‘প্যারেড স্কোয়ার’ বা স্টেডিয়ামের ভেতরে মিটিং না করে, ‘জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য’ মহাব্যস্ত মহাসড়কে মিছিল করে ২-ঘন্টার যানজটকে ৫-ঘন্টায় উন্নীত করে জনগণের অধিকার হরণ করছে! বিদেশ প্রত্যাগত ‘পানাসক্ত’ বাঙালির কাছে কোন যুক্তিই নেই, কেন বাঙালি ‘স্বাস্থ্য নিরাপদ’ আধুনিক বিয়ার বা স্যাম্পেনের বদলে কাশির ঔষধ ‘ফ্যান্সিডিল’ বা ঝুকিপূর্ণ ‘আইকা-গাম’ নেশার জন্যে ব্যবহার করবে দেশের সর্বত্র! এটিও বুঝতে পারেনা এদেশের গ্রামীণ মক্কেল, কেন ‘আইনের রক্ষক ও পরামর্শক’ উকিলবাবু তাকে পেশকার মুহুরীকে ঘুষ দেয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন ও পরামর্শ দেয় অবলীলায়! আবার সচেতন অভিভাবকগণও বুঝতে অক্ষম যে, কেন প্রতিবছর সৃজনশীলতার বদলে ‘কমনপড়ার নামে’ নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক প্রশ্ন পর্যায়ক্রমে পরীক্ষায় আসবে এবং ‘কমন না পড়ার’ অযুহাতে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা হল ‘ভাঙচুর’ করবে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়, আর আইনপ্রয়োগে দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তা চেয়ে চেয়ে দেখবে! 

রাজনৈতিক বাংলাদেশের ‘একমাত্র নোবেলজয়ী’র নামেও এদেশে কেন দেদার-সে ‘সুদখোরের’ অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে, তা শুধু এদেশের চিন্তাশীল মানুষদেরই নয়, খোদ সুইডিশ নোবেল কমিটিকেই মহাচিন্তায় নিপতিত করেছে এখন! একুশ শতকে লেজার বিম ও সেলফোনের যুগে এসেও, এদেশের মানুষ কেন ধনেশ পাখির তেল, আর ‘জোঁকের’ টোটকা চিকিৎসা নিচ্ছে, সাপে কামড়ে ওঝার কাছে যাচ্ছে, তা নিয়ে এ দেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণও কোন ‘থিসিস’ লিখতে পারছেন না! চাকুরী দাতা ও প্রার্থীরাও জানেনা, কোন দেশে বাংলাদেশের মত ‘পস্নানওয়েতে’ চাকুরীর আগাম প্রশ্নপত্র ও তা ‘সলফ’ করার ‘সিওর সাকসেস’ মার্কা কোচিং সেন্টার তৈরী করে রীতিমত আরেকটি ‘ডিপেস্নামা’ দানের  কার্যকরী ব্যবস্থার ‘ধন্বন্তরি সিস্টেম’ বিশ্বের কোন দেশে আবিস্কৃত হয়েছে কিনা! বিশ্বের তরুণ তরুণীরা এখনো এটি বুঝতে পারেনি যে, সেলফোনে আধুনিক ডিজিট্যাল প্রেম করে, প্রেমিককে ‘ডেটিংয়ের নামে’ বিশেষ স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে, তাকে বিশেষ বাহিনী কর্তৃক ‘ধোলাইর’ পর, ঐ মোবাইলে-ই (যেটি দিয়ে প্রেমের শুরু হয়েছিল) পরিবারের কাছে বড় অংকের ‘মুক্তিপণ’ দাবী কিভাবে করা যায়? এদেশের ঝানু ‘শেয়ারু’-ও এখনো ঠিক বুঝতে পারছে না, কোন যাদুমন্ত্রবলে ১ম আইসিবি মি.ফান্ডের ১০০টাকা ফেইসভেল্যুর শেয়ারের দাম কেন এখন দশ হাজার ত্রিশ টাকা প্রতিটি! সাংসদ তারানা হালিম কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেত্রীবৃন্দের মাথায় ঢুকছে না, কেন সড়কপথে প্রতিদিন কয়েক’শ মানুষ হত্যার পরও হত্যাকারীর শাস্তির জন্যে কঠোরতর আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না! ভাষার জন্যে বায়ান্নতে রক্ত দেয়া সালাম, জববার, রফিকের আত্মা হয়তো কষ্ট পাচ্ছে এটি দেখে যে, দেশাত্মবোধ আর অনৈক্যের কারণে এদেশে বাংলা ভাষা কম্পিউটারে লেখার জন্যে ডজন খানেক সপ্তপদী ‘কি-বোর্ড’ ফ্রি-স্টাইলে ব্যবহৃত হচ্ছে যত্রতত্র, নেই কোন রাষ্ট্রীয় নিয়স্ত্রণ। হায় (৩য় বার)! 

এদেশের দেশপ্রেমিক ও অপচয়বিরোধী বাঙালি মুসলমানগণ বুঝতে অক্ষম, যেখানে সৌদি আরবে বছরে ২-দিন ২-ঘন্টা ঈদের নামায আদায়ের জন্যে কোন ‘ঈদগা’ নেই, সেখানে ১৬-কোটি জনবহুল এতো মানুষের ঠাসাঠাসির এদেশে (যেখানে কোটি কোটি মানুষ ভূমিহীন ও ঘরহারা) কেন এত ঈদগা, প্যারেড স্কোয়ার, মাঠ, স্টেডিয়াম? জনাধিক্যের কারণে যেখানে ফুটপাত আয়তনে ছোট ও পথচারীদের ধারণ করতে পারছে না, সেখানে কেন তা দখল করে দোকান-পসরা বসানো হয়েছে তা বুঝতে অক্ষম ‘বোকা’ পথচারীরা! এদেশের লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষেরা হয়তো জানেনা যে, গভীর নলকূপের জন্যে বরাদ্দকৃত পাইপ চুরি করে, তাদেরকে অগভীর নলকূপ বসিয়ে দিয়েছে কন্ট্রাকটর আর ‘জনস্বাস্থ্যের’ জন্যে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ, যে কারণে তারা আর্সেনিক আক্রান্ত হচ্ছে আগের মতই! শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ মানতে পারছেন না, একই দেশের শিশুরা কেন বিভিন্নমুখী শিক্ষা লাভের কারণে কেউ সাম্প্রদায়িক আবার কেউ ভিনদেশীপন্থী হবে! এদেশের সমাজবিজ্ঞানীর কাছেও পরম বিস্ময় যে, এমন দেশকি কোথাও আছে কি, যেখানে কোটি মানুষ উৎপাদনশীল কোন কাজে সম্পৃক্ত না হয়েই কেবল চাঁদাবাজী, দালালী বা এই জাতীয় কাজেই তাদের জীবন চালাচ্ছে? আর চমৎকার অত্যাশ্চার্য এদেশটির আরেকটি ‘চিত্রকল্প’ হচ্ছে, দেশটির কোটি কোটি কৃষক যারা দিনরাত পরিশ্রম করে খাদ্য ফলায়, তাদের অনেকেরই ন্যুনতম মৌলিক চাহিদা পুরণের সঙ্গতি নেই! নেই আধুনিক চিকিৎসা বা শিক্ষা! আর স্বাধীনতাপ্রিয় এদেশ ও বিদেশী লক্ষ-কোটি মানুষ বুঝতে অক্ষম, যে লোকটি একটি জাতির জন্যে আজীবন সংগ্রাম করলো, তাদেরকে একটা ঐকতানে এনে স্বাধীনতার চেতনা জাগালো, তাকে বাঙালি নামধারী ‘কিছু লোক’ হত্যা করলো কিন্তু তাদের প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে জাতি এগুলো না বরং জাতির একটি ‘বিশেষ অংশ’ হত্যাকারীদের পক্ষে গিয়ে তাদের পুরস্কৃত করলো ও ‘ইনডেমনিটি’ দিল! হায়! হায়! 

বর্ণিত হাজারো ঘটনার খন্ডিত তথ্যাদি বিশেস্নষণে লেখকের মনে হচ্ছে উলিস্নখিত ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ গানকি গীতিকার ‘ব্যাজস্ত্ততি’ অর্থে ব্যবহার করেছেন ‘ভবিষ্যত দ্রষ্টা’ হিসেবে। সেক্ষেত্রে আজকের বাঙালির প্রত্যেকের উচিত বর্ণিত গানটির যথার্থতা অনুধাবন করা সময়ের প্রেক্ষাপটে! ধন্য গীতিকার! ধন্য বাংলাদেশ!
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন