সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

পুরনো সংস্কৃতি রক্ষণ কি বাঞ্চনীয়? # ১২৭

পুরনো সংস্কৃতি রক্ষণ কি বাঞ্চনীয়?
 
হুজুগে জাতি হিসেবে বাঙালিদের বেশ পরিচয় আছে দেশে ও প্রবাসে। অনেক সময় এ জাতি কিছু কিছু কাজ করে না জেনে ও না বুঝে অনেকটা ‘গড্ডলিকা প্রবাহে’র মত। ‘গড্ডলিকা’ মানে হচ্ছে ভেড়া। কোন একটি ভেড়া যেদিকে চলতে শুরু করে, পেছনের গুলোও তাকে অনুসরণ করে কিছু না বুঝেই! আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোর প্রাত্যহিক ‘টক-শো’, বিভিন্ন পার্বন উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশ-সেমিনার ইত্যাদিতে প্রায় সব আলোচকগণই ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ (ঁহধহরসড়ঁংষু) বলে থাকেন যে, আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ইত্যাদিকে লালন করতে হবে যে কোন ভাবেই। অনেকেই তুলনা করেন প্রাচীন সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের, যদিও আলোচকগণের কেউই প্রাচীন সংস্কৃতিতে বসবাস করেন না এবং প্রায় সবাই বসবাস করেন ও লালন করেন বর্তমান সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। তবে কি এ কথাগুলো ‘কেবলই কথার কথা’? আসলেই কথার কথা। যা বর্তমানে লালন করেতে চাওয়াও অনেকটা নিজের সাথে প্রতারণার সামিল, এমনকি সম্ভবও নয়! দেখা যাক, পুরণো সংস্কৃতি লালনে ও বর্তমান সংস্কৃতি পালনে প্রকৃতপক্ষে আমাদের লাভ-ক্ষতিটা কার কত?
 
এ অঞ্চলের দ্রাবিড় ও আর্য জাতিগোষ্ঠীর মিশ্র ‘বঙাল’ নামধারী নিরীহ মানুষগুলো একসময় পোশাক হিসেবে ‘ধূতি’ পড়তো। এটি আমাদের বেশ পুরণো ঐহিত্য ও সংস্কৃতি। এখন বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার প্রায় সকল মানুষই ধূতিটি ছেড়ে ‘ভদ্র পোশাক’ হিসেবে ‘প্যান্ট-সার্ট’ বেছে নিয়েছে, যার উপযোগিতা এখন বিশ্বজনীন। আর ধূতি একটু বাতাসেই উড়ে যেতে পারে, খুলে যেতে পারে। কঠোর শ্রমসাধ্য কাজ ধূতি পড়ে করা প্রায় অসম্ভব। আর ধূতি পড়ে কেউ পানিতে ডুবলে বাচার সম্ভাবনা ক্ষীণতর। সে ক্ষেত্রে ‘সার্ট-প্যান্ট’ একটি বিজাতীয় পোশাক হলেও, তার উপযোগিতার কারণে ধূতি পরিত্যাজ্য নয় কি?
 
সাজ-সজ্জার উপকরণ হিসেবে এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হচ্ছে মেয়েরা আলতা, চোখে কাজল, মাথায় তেল মাখবে। পুরুষরা চোখে সুরমা ছাড়াও হুক্কা টানবে। কিন্তু কাজল যেমন চোখের জন্যে ক্ষতিকর, মাথার তেল বিছানা-বালিশ নষ্ট ছাড়াও উকুনের জন্যে চমৎকার খাবার ও বসবাসের যায়গা সৃষ্টিতে সহায়ক। আলতা এক শ্রেণির সসত্মা রং, যা শরীরে ব্যবহার স্বাস্থ্য সম্মত নয়। তার বদলে এখন সকলেই শ্যাম্পু, সাবান, প্রয়োজনে স্বাস্থ্য সম্মত তেল ব্যবহার করছে, যা আমাদের সংস্কৃতিতে ছিলনা। আর তামাক কেটে, চিটাগুড় মাখিয়ে, কলকেতে রেখে, হুক্কার মাধ্যমে ঐতিহ্যগত ধুমপানের চেয়ে ‘ফিন্টার সিগারেট’ অন্তত কিছুটা নিরাপদ। কিন্তু সিগারেটটি হচ্ছে বিরাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি।
 
কৃষি প্রধান এদেশে ধান কাটার পর ঐহিত্যগতভাবে তা মাড়াই করা হতো গরু বা মহিষের সাহায্যে। গৃহবধুরা পায়ে মাড়িয়ে বা পিটিয়েও ধান বা ফসলের দানা ছাড়াতো। সারারাত ধরে এ কাজের পর, ধান সেদ্ধ ও শুকানো পর্বের পর তা ‘হাসকিং’ বা ছাটাই করা হতো ‘ঢেকি’-তে, আটা করা হত যাতা’য়। ঢেকি বা যাতা-য় কোন ‘বল বা বেয়ারিং’ সিস্টেম না থাকার কারণে মনকে মন ধান বানার জন্যে গৃহবধুদের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস রাত জেগে কষ্টকর কাজ করতে বা ধান বানতে হত। পান থেকে চুন খসলে জুটতো স্বামীর পাচনের মার কিংবা তালাক। পশ্চিমারা আনলো ‘হাসকিং’ মেশিন, মানে ধান থেকে চাল ও আটা বানানোর যন্ত্র, যা এদেশের মহিলাদের শ্রম সাশ্রয় করলো অনেকগুণ। ধান বানার গ্রামীণ মেয়েরা এখন পোশাক কারখানায় কাজ করে, ইউরোপ-আমেরিকা তথা বিশ্বের নামকরা মলগুলোতে তাদের বানানো ড্রেস পাঠাচ্ছে, যা পড়ছে বিশ্বের প্রায় সকল মানুষ। 
 
যাতায়াতাদের জন্যে এদেশের ঐহিত্য ছিল পালকী, নৌকা, গরুর গড়ি ইত্যাদি। পালকিতে ৪-জন মানুষ অন্য আরেক জনকে কাধে করে নিয়ে যাবে, বিষয়টি মানবিক নয়। নৌকা ধীর গতির ও নদীপথে বিপদজনক, বসার তেমন ব্যবস্থা ছিলনা। গরুর গাড়িও একই প্রকৃতির। আমাদের বর্ণিত ঐতিহ্যগত বাহনের বদলে, এখন আমরা ভিনদেশী বাহনকেই বেশী নিজের বলে ভাবতে শিখেছি। ব্যাটারী চালিত চায়নিজ মোটর বাইকে গ্রামীণ কুলবধু চলতে ভয় পায়না এখন, বেশ আনন্দ অনুভব করে।
 
এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রোমান্টিক কাহিনী হচ্ছে ‘রূপবান-রহিমের’ কিচ্ছা। তা ছাড়া ‘ইয়াজিদ বধ’ বা এই জাতীয় যাত্রা সারা রাত জেগে দেখতে হয় ঘুম নষ্ট করে। এই রূপবান বা যাত্রার জীবন বোধের চেয়ে আধুনিক মননের মঞ্চ নাটক, উচ্চ মার্গের সিনেমা, ব্যালে বা অপেরা আধুনিক বাঙালির মনোরঞ্জন এবং চিন্তনকে নাড়া দেয়। যা দিতে পারেনি আমাদের ঐহিত্যগত যাত্রা, রূপবান বা গাজীর গান। জারী-সারি-লীলার গীতের চেয়ে ভূপেন হাজারিকা বা নচিকেতার গণসঙ্গীত হৃদতন্ত্রীকে জাগিয়ে তোলে। পঁুথিপাঠের চেয়ে জীবনানন্দ বা বিষ্ণু দের কবিতা মনকে আন্দোলিত করে, দেশপ্রেম জাড়ায় মননে।
 
এদেশের মানুষ এক সময় হোগলা, চাড়াই, সুপারি গাছের চৌকি, পিড়িতে বসতো, ছেঁড়া কাপড় দিয়ে সেলাই করা কাঁথা গায়ে দিত। এখন চেয়ারে বসে, খাটে ঘুমায়, কম্বল গায় দেয়, সবই বিদেশ থেকে আগত। আমাদের ঐহিত্যগত সের, মন, পন, কাঠী, হাত, নল ইত্যাদির পরিবর্তে কেজি, লিটার, মিটার ইত্যাদি আধুনিকায়ন অবশ্যই আমাদের জীবন বোধকে উন্নততর করেছে। ভূত-পেত্নী, পানি-পড়া, লতা-পাতার চিকিৎসার বদলে আধুনিক পশ্চিমা চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মজবুত করেনি কি? গ্রামীণ গৃহবধুদের কলসী কাখে নদী বা পুকুরের ঐতিহ্যগত জল আনার দৃশ্যটি এখন ‘গভীর নলকূপ’ চাপানো কিশোরীর হাতে। কিশোরীর পানিটি পানের যোগ্য, আর কলসী দিয়ে আনা নদী-পুকুরের পানিটি পান অযোগ্য, অস্বাস্থ্যকর।
 
এরকম হাজারো উদাহরণ উপস্থাপন করা যেতে পারে এখানে। হতে পারে ব্যাপক বিতর্কও। হ্যা, সময়ের সাথে সাথে মানুষের বোধ ও চেতনাকেও পাল্টাতে হবে পেন্ডুলামের চলমানতায়। গ্লোবাল বিশেব প্রাচীন ঐতিহ্যের নামে পুরনো ‘ধূতি’ কে পোশাক হিসেবে আনা, কিংবা ‘পান-সুপারী’ খেয়ে দেয়ালে ‘পিক’ ফেলায় কোন ‘ঐতিহ্য বা মূল্যবোধ’ খুঁজে পাইনা। আজকের পৃথিবীর কল্যাণ ও মঙ্গলজনক সব কার্যক্রম ও ঐহিত্যকে মনে করতে হবে নিজের ঐতিহ্য হিসেবে। ‘ইয়াহু’- ল্যাপটপ বা সেলফোনের আবিষ্কারক কোন ইসরাইলী-ইহুদী হলেও ক্ষতি নেই, কারণ এটি এখন বিশ্ব ঐহিত্যের অংশ। আর ‘পাটের বংশগতি আবিস্কারকে’ও করতে হবে আমাদের নতুন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অংশরূপে। এভাবে ‘ইয়াহু’ ঐহিত্য ও ‘পাটের বংশ গতির’ ঐহিত্য মিলে যে আধুনিক ‘নতুন সাংস্কৃতিক ঐহিত্য’ সৃষ্টি হবে, তাকেই লালন করতে হবে মনপ্রাণ দিয়ে। তাহলেই আধুনিক গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারবো আমরা, নতুবা গ্রামীণ গৃহবধুর কাখের ‘কলসীর পুকুর ও নদীর জল খেয়ে’ আক্রান্ত হতেই থাকবো নানাবিধ ‘পেটের পীড়ায়’! বিশ্ব যেখানে এখন অনেকটা ‘পেটের পীড়ামুক্ত’ (কেবল হাইতি ছাড়া)! 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন