রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত মানুষদের আত্মত্যাগ কি অকথিত-ই থাকবে? # ১০৬


 
হাজার বছরের চির পরাধীন এবং অবশেষে একাত্তরে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মহান বিষয়ের ৪৩-তম দিন পালনে আমরা এখন সবাই উদগ্রিব। স্বাধীনতা অর্জনে ত্রিশ লাখ শহীদ, অগণিত মা-বোনের ইজ্জত এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ খেতাব ও কমবেশী সুযোগ সুবিধাও আমরা দেয়ার চেষ্টা করছি স্বল্প সম্পদের এদেশে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা এখন বংশানুক্রমে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং নাতিপুতিদের দেয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। ৭-জন বীর শ্রেষ্ঠর সম্মানে এদেশের মানুষ এখনো আপ্লুত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে আমরা জাতীয় স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করেছি। শোনা যাচ্ছে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদেশীদেরও সরকার সম্মানিত করবেন এবং সে লক্ষে একটি তালিকাও নাকি তৈরী হচ্ছে। যা সবই প্রশংসার দাবী রাখে।

কিন্তু একটি ব্যাপার এদেশের অসাম্প্রদায়িক ‘কৃতজ্ঞ’ বাঙালিকে ‘দহন’ করছে প্রতিনিয়ত সেই একাত্তর থেকেই। আর তা হচ্ছে, একাত্তরে আমাদের চরম বিপদের সময় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল, তার স্মরণে কিংবা তারা কিভাবে কতটুকু আমাদের সহায়তা করেছিল তা সুষ্পষ্টভাবে সকল জাতির মাঝে কখনো ব্যাপক প্রচার না হওয়া। দীর্ঘদিন এদেশের মানুষ নানা প্রচার মাধ্যমে শুনে এসেছে, যুদ্ধের পর ভারত নাকি এদেশের অনেক সম্পদ ‘পাচার’ করে তাদের দেশে নিয়ে গেছে। এর সত্যা-সত্যও প্রকাশিত হওয়া দরকার ৪৩-তম এ বিজয়ের প্রাক্কালে এ জাতির সামনেই।

যারা নিজ চোখে একাত্তর দেখেছে তারা কমবেশী জানে, পাকিস্তানীদের ভয়ে প্রায় কোটি শরণার্থী বাংলাদেশের ৩-দিকের বর্ডার দিয়ে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের দেয়া হয়েছিল আশ্রয়, খাদ্য, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র। কত মানুষের জন্যে ভারতের কত আশ্রয় কেন্দ্র ছিল সেখানে তার হিসেব কি আমরা কখনো করেছি? সরবরাহকৃত খাদ্য, ক্যাম্প আর অস্ত্রের পরিমাণ কি ছিল? এ ক্ষেত্রে ভারতের জনগণ কি ত্যাগ স্বীকার করেছিল এ জাতির স্বাধীনতায় বা ট্যাক্স দিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্যে? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটিও কি ভারত সরকার বাংলাদেশকে দান করেছিল বিনে পয়সায়? তার মূল্য ছিল কত? এ ছাড়া যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ডাকটিকেট, পোস্টার, মুদ্রা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছিল ভারত থেকেই। সরকারি দফতরও ছিল সেখানে। সেগুলো কিভাবে হয়েছিল?

একাত্তরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে সরাসরি ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন সেক্টরে যুদ্ধে নামে। পাকিস্তানের মত একটি ‘যুদ্ধবাজ’ মার্কিন ও চীনের সহায়তাপুষ্ট শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে ভারতের কি কোন ক্ষতি হয় নি? আমাদের জানা ও বোঝা দরকার, এ ক্ষেত্রে এ যুদ্ধে (বাংলাদেশ যুদ্ধে) ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে মোট কত সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছিল? যার আর্থিক মূল্য কত? মানুষ ছাড়াও এ যুদ্ধে ভারতীয় সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর ধ্বংসপ্রাপ্ত অস্ত্র, বিমান, নৌ-জাহাজ ইত্যাদির পরিমাণ ও তার আর্থিক মূল্যমান কি আমরা বলতে পারবো? যুদ্ধে ভারতের মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কি খুব নগণ্য ছিল?

ভারত ছাড়াও এ যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন কি প্রকারে আমাদের সহায়তা দিয়েছিল? মানে অস্ত্র, অর্থ, কূটনৈতিক কিংবা অন্য আর কি কি ভাবে? যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানীদের রক্ষায় যখন বঙ্গোপসাগরে মার্কিন ‘সপ্তম নৌবহর’ এলো বাংলাদেশের উপর আক্রমন চালাতে, তখন তা প্রতিরোধে সৌভিয়েত ৪০-জাহাজের পারমাণবিক নৌ-বহর ও ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ ‘ভিক্রান্ত’ কিভাবে তার মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছিল, তার ইতিহাস কি এদেশের শিশুরা জানবে না? স্বাধীনতা লাভের পরও বাংলাদেশ বিমান ও নৌবাহিনী গঠনে ভারত কি কি বিমান ও নৌযান বাংলাদেশকে দান করেছিল, তাও প্রকাশিত হওয়া দরকার সত্য ইতিহাস সামনে আনার প্রয়াসে। আরো জানা দরকার, আত্মসমর্পনের প্রাক্কালে চট্টগ্রাম বন্দরকে অচল করার লক্ষে, পাকিস্তান নৌবাহিনী কর্তৃক পুরো বঙ্গোপসাগরে ‘অসংখ্য ভাসমান মাইন’ ছড়িয়ে দেয়ার গল্প এবং স্বাধীনতার পর তা উদ্ধারে এসে মাইন বিস্ফোরণে সৌভিয়েত নাবিকদের পতেঙ্গা সৈকতে নির্মম নিহত হওয়ার কাহিনি। নিহত এ সোভিয়েত সৈনিকরা হয়তো জন্ম নিয়েছিল লেনিনগ্রাদ বা ভারখয়োনস্কের কোন প্রত্যন্ত গ্রামে, যারা অন্য এক অচেনা জাতির ‘মুক্তি সংগ্রামে’ এসে নিজের জীবনটি দান করলেন পতেঙ্গা সৈকতে! এদের স্বজনদের কি সম্মাননা জানাবো না আমরা বাংলাদেশে এনে? এদের সাহসের গল্প আমাদের না শোনালে, এ বীরত্বের কাহিনি আমাদের না জানালে, এদের স্মৃতিতে স্মৃতিশৌধ আমরা না বানালে, এদের আত্মত্যাগকে এ জাতি ‘স্যালুট’ না করলে, আমরা দিনের পর দিন ‘অকৃতজ্ঞ’ জাতি থেকে একটি ‘কৃতঘ্ন’ জাতিতে পরিণত হবো না কি? আর এটি হলে কি ভবিষ্যত প্রজ্ন্ম আমাদের ক্ষমা করবে? কারণ ‘অকৃতজ্ঞ’ ব্যক্তিকে নাকি আল্লাহ-ও পছন্দ করেন না। আর যাকে আল্লাহ পছন্দ করেনা, তাকে কি বিশ্বের মানুষরা পছন্দ করবে?

--------------------------------------------------------------------------------------------------------
[শরনার্থীদের ছুটে চলা বিষয়ক অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতার বাংলা অনুবাদ]

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড

শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল,
যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ী দেশ,
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ।
শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে।
সময় চলেছে রাজপথ ধরে যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল,
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, গরুগাড়ী কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে, লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়,
ঘরহীন ভাসে শত শত লোক লক্ষ জননী পাগলের প্রায়।
রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু, পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে
এইটুকু শিশু এতবড় চোখ দিশেহারা মা কারকাছে ছোটে।
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, এত এত শুধু মানুষের মুখ,
যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ।

কার কাছে বলি ভাতরূটি কথা, কাকে বলি করো, করো করো ত্রান,
কাকে বলি, ওগো মৃত্যু থামাও, মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রান।
কাঁদো কাঁদো তুমি মানুষের দল তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা,
জননীর কোলে আধপেটা শিশু একেমন বাঁচা, বেঁচে মরে থাকা।
ছোটো ছোটো তুমি মানুষের দল, তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া,
গুলিতে ছিন্ন দেহ মন মাটি, ঘর ছেড়েছোতো মাটি মিছে মায়া।
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, ঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে,
যশোর রোডের দুধারে মানুষ এত এত লোক শুধু কেনো মরে।


শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত শিশু মরে গেল,
যশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ী দেশ,
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ।
শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে॥



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন