সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

গরিব আসলে কারা, বাঙালি না ভুটানীরা # ১৩৬

গরিব আসলে কারা, বাঙালি না ভুটানীরা
দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দু’টো গরিব রাষ্ট্রের নামের তালিকায় সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় ভুটান আর বাংলাদেশের নাম। যদিও ভুটান পর্বতমত চলাচল অনুপোযোগী সমুদ্রবন্দরহীন শিল্পকারখানা বর্জিত একটি আমদানী নির্ভর দেশ, যারা বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে। বিশ্ব পরিচিতি, শিক্ষা, জাতীয় আয়, যোগাযোগ, শিল্পোপণ্য উৎপাদন কোন কিছুতেই দেশটি বাংলাদেশকে টপকাতে পারেনি কখনো কিন্তু সম্প্রতি এমন একটি অনুন্নত দেশে বেড়াতে গিয়েও আমার দেশের বর্তমান অবস্থার সাথে তুলনা করতে চমকিত ও বিচলিত হতে হয় একজন বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে, যার কিছুটা তুলনামূলত তথ্যচিত্র নিমণরূপ।

রাজতান্ত্রিক ভুটানের ‘রাজা’ মূলত ইচ্ছে করেই কয়েক বছর আগে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন জনগণের হাতে অর্থাৎ কোনরূপ হরতাল, আন্দোলন, জ্বালাও-পোড়াও ছাড়াই তিনি নামে মাত্র সাংবিধানিক ‘রাজা’, আর দেশ পরিচালনা করছেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। ভুটানের বর্তমান রাজা বিয়ে করেছেন অত্যন্ত সাধারণ কৃষক পরিবারের মেয়ে, যাকে নিয়ে সে বসবাসও করছেন অত্যন্ত সাধারণ পরিবেশে, যে কারণে ভুটানের মানুষরা তাকে শ্রদ্ধা করে ‘দেবতা’ তথা মহামানবের মতো। নির্বাচন কিংবা অন্য কোন প্রচারের জন্যে মাইকিং ও যেখানে সেখানে পোস্টার লাগানোর কোন ব্যবস্থা নেই ভুটানে, কেবল নির্দিষ্ট বোর্ডেই লাগাতে হয় পোস্টার। আর আমাদের নির্বাচন, মাইকিং, মারামারি এবং পোস্টারিং এর কথা সবাই জানি বিধায় আর বললাম না। সদাচার ও সহিষ্ণুতা ভুটানী জাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমাদের বর্তমান অসদাচরণ, দুর্নীতি ও অসহিষ্ণতা এখন বিশ্ব রেকর্ড ভাঙতে পারবে নি.সন্দেহে। ভুটানীরা মারামারি, ঝগড়াঝাটি, খুনোখুটি করেনা বললেই চলে, যা আমাদের প্রাহ্যাহিক ডাল-ভাত এখন। বছরে সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে, তবে পাহাড় থেকে গাড়ি নিচে গড়িয়ে পড়ে ২-৩টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে প্রতি বছর কিন্তু আমাদের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রত্যহ গড় মৃত্যু প্রায় ৫০-জন। ভুটানের প্রত্যেকটি নাগরিক জাতীয় পোশাককে শ্রদ্ধা ও তা পরিধান করে স্কুল, অফিস ও সরকারি কাজকর্মে যায়, আমাদের জাতীয় পোশাক কি আমরা জানি কি? থাকলেও কেউ পড়তো কিনা জানিনা! যদিও তথাকথিত ‘অভিজাত’ হওয়ার জন্যে আমরা চৈত্র মাসের প্রচন্ড গরমেও বিলেতী ‘কোট-টাই’ পড়ে অফিসে যাই প্রায়ই। ভুটানে অত্যন্ত সংকীর্ণ রাস্তা বিধায় ড্রাইভারগণ থেমে কিংবা পেছনে ব্যাক গিয়ারে গিয়ে অন্যকে যাওয়ার পথ করে দেয় কোনরূপ বাক-বিতন্ডা কিংবা হর্ন না বাজিয়ে, যদিও এজন্যে কোন ট্রাফিক সিগন্যাল বা ট্রাফিক পুলিশের কোন নির্দেশনা দিতে হয়না তাকে কিন্তু আমাদের ঢাকায় প্রশস্ত সড়ক সত্বেও, ডজন ডজন ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্ট-এর সামনেই বাসগুলো অসম প্রতিযোগিতায় রাস্তা বন্ধ করে সড়ক আটকে ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটের সৃষ্টি করে, চালকগণ ‘তথাকথিত অহমিকা’য় কেউ কখনো পেছনে সরে কাউকে পথ দিতে চায়না। 
ভুটানে শিক্ষার্থীরা ৫-৭ কি.মি. হেঁটে হেঁটে পাহাড়ী পথে তাদের স্কুলে যাওয়া-আসা করে, যা তাদের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে অনুকুল হলেও, বাংলাদেশের শহুরে শিক্ষার্থীরা কেউ গাড়ি, অটো, রিক্সা বা নিদেনপক্ষে বাসে স্কুলে যায়, হাঁটার সিস্টেম এদেশে নেই বললেই চলে এখন, ২/১ জন হাতে গোনা ছাড়া। প্রত্যেকটি টেক্সি প্রায় নতুন, ভাড়া নির্ধারিত, দরকষাকষিহীন কিন্তু আমাদের টেক্সিগুলো এখন চলাচলের অনুপযোগী-ভাঙাচোরা, অটোগুলোর ভাড়া নিয়ে প্রত্যহ ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, গালাগালি লেগেই আছে রাস্তায়। ভুটানীরা বৌদ্ধ ধর্মানুসারী ও যে কোন প্রাণি হত্যার বিপক্ষে বিধায়, তাদের পাহাড়ী নদীতে যে প্রচুর মাছ সহজপ্রাপ্য, তাও তারা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের কারণে ধরেনা কখনো। এমনকি পাহাড়ে প্রচুর গরু ও অন্যান্য প্রাণির বসবাস হলেও, কোন প্রাণিকেই হত্যা করেনা তারা। সাধারণত শাক-সব্জি ও ভারত থেকে আমদানীকৃত কিছু মাছ ও মাংস আহার করে। পক্ষান্তরে সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে আমরা প্রত্যহ আমাদের নদীগুলোর নলা, ডিমওয়ালা, জাটকাসহ সকল শ্রেণির মাছ ধ্বংস ও সকল শ্রেণির প্রাণি (নিষিদ্ধসহ) হত্যা করছি, আমদানী করছি প্রচুর বিলাসদ্রব্য গরিব দেশ হওয়া সত্বেও। কোন নৈতিকতা তথা আইন কানুনের ধার সাধারণত ধারে না স্বাধীন বাঙালি!

একটি গরিব দেশ হওয়া সত্বেও ভুটানের কাঁচাবাজার বেশ উন্নত। দোকানগুলো পরিচ্ছন্ন, কর্দমহীন, মশা-মাছি ও দুর্গন্ধমুক্ত। পাহাড়ে উৎপাদিত কৃষি পণ্য যাতে কৃষকগণ সরাসরি সরকারি রেটে ভোক্তার কাছে কোন মধ্যসত্বভোগীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই বিক্রি করতে পারে, এ জন্যে আছে থিম্পুতে সরকার প্রতিষ্ঠিত তৃ-তল বিশিষ্ট কৃষি মার্কেট। কিন্তু আমাদের অভিজাত এলাকাসহ সকল কাঁচাবাজারগুলো অপরিচ্ছন্ন, কর্দম, ময়লা ও দুর্গন্ধময়। সরকার আমাদের কৃষকদের জন্যে সরাসরি বিক্রয়ের জন্যে কোন কৃষি মার্কেট স্থাপন করতে পারেনি, এমনকি আমাদের একমাত্র ‘‘কৃষিতারকা’’ শাইখ সিরাজও অদ্যাবধি নিজ উদ্যোগে ঢাকায় একটি কৃষি মার্কেট করেননি, যার প্রত্যাশা ছিল আমাদের মতো কৃষি সচেতন সকল নাগরিকদের। অবাক ব্যাপার ভুটানের কৃষি মার্কেটে সকল জিনিসপত্রের দাম লেখা বোর্ড সকল পণ্যের উপর লাগানো এবং সকলের দাম প্রায় একই, কেবল পণ্য গুণগত-মানের কারণে সামান্য কমবেশী কিন্তু কোনরূপ দরকষাকষিহীন।

দুর্নীতিমুক্ত ও ভোগবাদী চিন্তণহীন ভুটানী মানুষেরা ‘বখশিশ’ ‘ঘুষ’ গ্রহণে নিতান্তই অনাগ্রহী, এমনকি একজন ড্রাইভারকে ব্যাগ পৌঁছে দেয়ার কারণে অতিরিক্ত বখশিশ দিতে চাইলে তারা সাধারণত নেয়না কিংবা লংরুটে যাত্রীর খরচে হোটেলে খেতে চায়না, যা আমাদের চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। দেশটি গরিব হলেও, সেখানের প্রায় সকল হোটেলের মান মোটামুটি মধ্যমমানের, খাবারের দাম প্রায় একই ও পরিবেশ উন্নত মানের, যা নিয়ে দরকষাকষি করতে হয়না। প্রত্যেকটি হোটেলে ডাকাডাকি-চিল্লাচিলিস্নার বদলে মেন্যু দেখে কাস্টমার থেকে নোটবুকে অর্ডার লিখে নেয়া হয়, বাসি খাবারের পরিবর্তে তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রস্ত্তত করে পরিবেশন করার রীতি ভুটানে। ভুটানের বাস ভাড়া ও টাইমিং খুবই যাত্রীবান্ধব তথা আধুনিক। যেমন ‘পারো’ থেকে ‘ফুল্টসোলিং’ প্রায় ৬-ঘন্টার পাহাড়ী পথ, যার বাসভাড়া মাত্র ১৯৩ টাকা। সবচেয়ে চমকপ্রদ হচ্ছে বাস-টাইমিং। 
যেমন সাড়ে আটটার বাস একদম ৮-৩০টায়-ই ছাড়া হয়, যার টিকেটে লেখা থাকে রিপোর্টিং টাইম-৮টা, লাগেজ গ্রহণ-৮.১৫টা এবং ছাড়ার টাইম-৮.৩০টা। বাংলাদেশে যত বাসে উঠেছি, কোন বাসই তার টাইম মত কখনো ছাড়েনি, কোন কোন বাস ছাড়ার সময়ের ২-৩ ঘন্টা পর স্টেশনে উপস্থিত হয়েছে এবং টিকেটের টাকা ফেরত চাওয়াতে প্রতিবাদী যাত্রীকে বাসের লোকেরা মারধর করেছে, যার প্রত্যক্ষদর্শী কমবেশী আমরা সবাই। ভুটানের প্রায় জনবসতিপূর্ণ সকল পাহাড়ে সরকার তৈরী করেছে স্কুল, যার পড়ালেখা একদম ফ্রি। আর ইতোমধ্যেই সরকার পাহাড়সহ সকল বিচ্ছিন্ন বাড়িতে সরবরাহ করেছে বিদ্যুৎ। ২০১৩ সালের মধ্যে একটি বাড়িও থাকবে না ভুটানে বিদ্যুৎ সংযোগহীন, তা যত দূরের পাহাড়েই হোকনা কেন! প্রায় প্রত্যেকটি পাহাড়ী বাড়ির সঙ্গে আছে সংযোগ সড়ক বা সড়ক যোগাযোগ, আর অবাক ব্যাপার ভুটানে সকল নাগরিকের জন্যে চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ঔষধ সম্পূর্ণ ফ্রি, এ জন্যে প্রাইভেট ফার্মেসী খুব একটা দেখা যায়না ভুটানে। আর আমাদের শহুরে বিদ্যুতের অবস্থা, হাজারো বিদ্যুৎবিহীন গ্রাম ও বেহাল চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলে পাঠকদের আর ধৈর্যের পরীক্ষায় ফেলতে চাইনা। তা ছাড়া আমাদের অনেক গ্রামে, চরাঞ্চলে এখনো স্কুল না থাকাতে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা নামক প্রধানতম মৌলিক অধিকার থেকে।

সম্ভবত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভুটানেই ‘ধুমপানের ব্যাপারে’ গৃহীত হয়েছে কঠোর আইন। সেখানে তামাকজাত দ্রব্য নিয়ে প্রবেশ করতে চাইলে তা প্রকাশ করতে হয় এট্রি পোর্টে যথাযথ ব্যাখ্যাসহ, যত্রতত্র কিংবা বাংলাদেশের মত মুদি দোকানে সিগারেট কিনতে পাওয়া যায়না, কেবল সরকার থেকে ‘স্মোকার’ হিসেবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিই সর্বোচ্চ ট্যাক্স লাগানো ‘টোবাকো হাউস’ থেকে কিনতে পারে সিগারেট, যার দাম অত্যন্ত বেশী। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী অনেক জিনিস কিনতে কড়াকড়ি হলেও, অত্যন্ত ক্ষতিকর সিগারেট কিনতে কোনই সমস্যা নেই এদেশে, এমনকি ছোট শিশুরাও কিনতে পারে যে কোন মুদিখানা থেকে। স্বল্পোন্নত দেশ ভুটানের পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীরা লালসাহীন, কম সম্পদে সন্তুষ্ট বিধায় তাদের আচরণ ও সততা আমাদের কাছে ঈর্ষণীয় মনে হতে পারে। পক্ষান্তরে আমরা এখন জাতি হিসেবে যে কোন ভাবে অর্থ কামানোর ধান্ধায় বিভোর ও প্রতিযোগী বিধায়, দুর্নীতিকে বাঙালিরা এখন ‘ভোগবাদের’ একমাত্র উপকরণ এবং সমাজে বেঁচে থাকার অন্যতম ‘হাতিয়ার’ হিসেবে গ্রহণ করছে বিধায়, দেশটি বিশ্ব সমাজের তুলনায় সত্যি কি এগিয়ে যাচ্ছে? হয়তো গার্মেন্টস শিল্পে কিংবা জনশক্তি রপ্তানীতে আমাদের আয় বিশ্বে উলেস্নখযোগ্য হতে পারে। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থান, মূল্যবোধ, মর্যাদা তাতে বাড়ে কি বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে? বাংলাদেশের চেয়ে নানাদিকে ‘অনুন্নত’ হয়েও আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভুটান নামক ক্ষুদ্র দেশটির মানুষের দিকে তাকালেও প্রশ্ন জাগে নিজের দেশ আর নেতিবাচকতাকে লালনকারী মানুষের ব্যাপারে, ‘‘চিন্তা আর মননে এখন গরিব দেশ আর জাতি আসলে কারা, ভুটানীজ না বাংলাদেশীরা’’?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন