সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বিশ্বের চরমতম স্বাধীন দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’ # ১৩১

বিশ্বের চরমতম স্বাধীন দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’ 
আজকের পৃথিবীতে জাতিসংঘের অধিভূক্ত ১৮০-টির অধিক রাষ্ট্র এখন নানা অনুষঙ্গে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃত। তবে কোন কোন রাষ্ট্র বিশেষ কোন বৃহৎ রাষ্ট্রের আনুগত্য মেনে চললেও, ঐ সব দেশের নাগরিকগণ মূলত কোন না কোন বিচারে স্বাধীনই বলা যায়। কোন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নাগরিকগণকে স্বাধীন বলা হলেও, পৃথিবীর সকল দেশ এবং নাগরিকগণই আসলে ‘সীমিত স্বাধীনতা’ই ভোগ করে। কারণ স্বাধীনতার নামে তাকে রক্ষা করতে হয় অপর দেশ ও নাগরিকের স্বাধীনতা। যেমন বৃটেন স্বাধীন দেশ বলে দখল করতে পারেনা ফ্রান্স কিংবা জার্মানী। আবার কানাডার কোন নাগরিক স্বাধীনতার নামে জোরে মাইক বাজিয়ে প্রতিবেশি রোগী বা পরীক্ষার্থীকে বিরক্ত করতে পারেনা তার ইচ্ছেমত। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য অনেক স্বাধীন দেশই এ ক্ষেত্রে কিছুটা ‘পরাধীন’ হলেও, সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে এদেশের অনেক নাগরিকই ভোগ করে বিশ্বের ঈর্ষণীয় ‘‘নিরঙ্কুশ ফ্রিস্টাইল স্বাধীনতা’’। সে বিচারে ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক বেশি স্বাধীন কিংবা বলা চলে চরমতম স্বাধীন। চলুন দেখা যাক বিষয়টি কিভাবে?

বিশ্বের প্রায় সকল রাজধানী শহরে চলাচল অযোগ্য কিন্তু ঢাকা শহরের ২০-বছরের পুরণো ৬নং রুটের লক্কর ঝক্কর বাসেও Executive Super Class Every Where লিখে মানুষকে ‘হতভম্ব করার স্বাধীনতা’ কি ভোগ করতে পারে অস্ট্রিয়া বা বৃটেনের এ জাতীয় কোন বাসে? একটি দেশের রাজধানী শহরের বাসে টিকেট ছাড়া ইচ্ছেমত ভাড়া দাবী ও তা আদায় করার স্বাধীনতা কি আছে নিউইয়র্কের বাস কোম্পানীর? স্টপেজ ছাড়া যেখানে সেখানে বাস দঁাড়িয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর স্বাধীনতা বেলজিয়ামের মত স্বাধীন দেশের আছে কি? সড়ক পথের স্বাধীনতার নামে কি হয় এদেশে, দেখুন একটু পরীক্ষা করে। পাবলিক টেক্সিতে মিটার অগ্রাহ্য করে ইচ্ছেমত ভাড়া নেয়ার স্বাধীনতা ভোগ করে বাংলাদেশের ট্যাক্সিচালকগণ, যা ভোগ করতে পারেনা সিঙ্গাপুরের মত উন্নত দেশের  চালকগণও। এদেশে রিক্সাচালকেরা বিনা প্রশিক্ষণ বা লাইসেন্সে রাজপথে স্বাধীনভাবে রিক্সা/ভ্যান চালাতে পারে ও ইচ্ছেমত ভাড়া হাঁকার স্বাধীনতা আছে তার, যা নেই স্বাধীন দেশ বেলজিয়ামের। রাসত্মার মোড়ে মোড়ে দঁাড়িয়ে রাসত্মা বন্ধ করে দঁাড়ানোর স্বাধীনতা কি হলান্ডের বাসের আছে? ফুটপাত দখল করে দোকান বসানো, হঁাটার ফুটপাথে গাছ, লোহালক্কর রাখার স্বাধীনতা আর কে ভোগ করতে পারে বাংলাদেশের মত? স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক্তারগণ ইচ্ছেমত সরকারি চাকুরী করেও নিজ খুশীমত চেম্বার ও ভিজিট আদায় করতে পারেন, হাসপাতালে ৮টার বদলে ১০টায় উপস্থিত হয়ে আবার দেড়টায় হাসপাতাল ত্যাগ করে রাত ১২টা পর্যন্ত নিজ চেম্বারে অগণিত রোগী দেখার যে স্বাধীনতা ভোগ করে সে, তা পারেনা গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার জনক খোদ গ্রীসের চিকিৎসকগণ।

পত্রিকায় যে কোন সংবাদ প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা আছে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের, হোক তা কা’বাঘরের গেলাফ পরিবর্তনের ট্যাম্পারিং করা ছবি। কিন্তু স্বাধীন দেশের পত্রিকায় তা সা্ইদী নামক এক মৃতদ-প্রাপ্ত ব্যক্তির মুক্তির আন্দোলন হিসেবে চালিয়ে দেয়ার স্বাধীনতা ভোগ করে অবাধে এদেশে। যাকে তাকে ‘নাসিত্মক মুরতাদ’ ঘোষণার স্বাধীনতাও আছে স্বাধীন দেশের শাইখ, মুফতী, শায়খুল হাদিস খেতাবধারী ব্যক্তিদের, যা ইসলামের নবীর আমলেও ভোগ করতেন কেবল ইসলামের খলিফা। তবে যে কোন খাবার, ঔষধ ও নানাবিধ জিনিসপত্রে ভেজাল মেশানোর স্বাধীনতায় একদম পিছিয়ে নেই স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকগণ। তারা অবাধে মানুষের জন্য তৈরীকৃত খাবারে দামী ‘ফুড কালারের’ বদলে সসত্মা কাপড়ের রং মেশাতে পারে ও এই রং বাজারে কেন বিক্রি হয় এমন সাফাই গাইতে পারে, যা পারেনা স্পেনের কোন খাদ্য উৎপাদনকারী ব্যক্তি বা সংস্থা। নির্ধারিত সময়ে ফাইলের কাজ সম্পাদন না করার স্বাধীনতা আছে এ দেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এ জন্য তাকে জবাবদিহি না করার স্বাধীনতাও পায় সে অবাধে। এমন স্বাধীনতা কি ভোগ করতে পারে অস্ট্রেলিয়ার সরকারি চাকুরেরা?

আদালতে বছরের পর বছর মামলার মিমাংসা না হওয়ার স্বাধীনতা ভোগ করে এদেশের উকিল ও বিচারকগণ। স্বাধীন স্পেনের উকিল ও বিচারকগণ এতো স্বাধীনতা পায়না। ঢাকার জিপিও থেকে সেগুন বাগিচায় চিঠি ১০-দিনে পৌঁছানোর স্বাধীনতা পায় বাংলাদেশের ডাক পিওনগণ, যা ভোগ করেনা চীনের কোন চিঠি বিতরণকারী কিংবা ডাক বিভাগ। যেন তেন ইস্যুতে হরতাল ডাকা এবং হরতালে স্বাধীনতভাবে গাড়িতে আগুন দেয়া, ট্রেন লাইন উপড়ানোর স্বাধীনতা পায় স্বাধীন দেশের পিকেটাররা, যা ভোগ করতে পারেনা গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত খোদ গ্রীস বা এথেন্সের নাগরিকগণ। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল প্রভৃতি পেশায় ডেইলী লাখ টাকা কামালেও, বছরে মাত্র ২-৩ হাজার টাকা ইনকাম ট্যাক্স দেয়ার স্বাধীনতা আর কোন স্বাধীন দেশের নাগরিকগণ ভোগ করতে পারে? কানাডার নাগরিকগণ বাংলাদেশের তুলনায় এতোটা স্বাধীন নয় বিধায়, সেখানের নাগরিকগণ তার আয়ের ৪০% অর্থই তাকে দিয়ে দিতে হয় আয়কর হিসেবে, সে হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকগণ কতই না স্বাধীন! প্রচ- যানজট সত্বেও রাসত্মা দখল করে জনসভা ও মিছিল করার স্বাধীনতা কি ভোগ করতে পারে ডেনমার্ক না সুইজ্যারল্যান্ডের নাগরিকগণ? প্রকাশ্যে মানুষের সামনে সত্যের বদলে মিথ্যা গলাবাজির স্বাধীনতা বাংলাদেশের মত আর কোন দেশের লোকেরা ভোগ করে? হাজারো কর্মকর্তাকে কাজ না করিয়ে ‘ওএসডি’ করেও বেতন দেয়ার ও নেয়ার স্বাধীনতা আর কোন স্বাধীন দেশের নাগরিকরা পায় জানা নেই বাংলাদেশের এ নাগরিকের। পত্রিকা ও মিডিয়ায় ভূয়া ফকির, তাবিজ-কবজ, তান্ত্রিক, সর্বরোগের চিকিৎসা, ভূয়া নিয়োগ ও বিয়ের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের স্বাধীনতা অবাধে ভোগ করতে পারে বাংলাদেশের নাগরিকগণ, যা পারেনা সুইডেন বা রাশিয়ার মত স্বাধীন দেশের ‘হতভাগ্য পরাধীন’ নাগরিকরা।

কান ঝালাপালা করে সারাদিন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে চাঁদা তোলা, নানাবিধ প্রচার ও বোনাজী ঔষধ বিক্রি ও যত্রতত্র মাইক বাজানোর স্বাধীনতা কেবল বাংলাদেশের নাগরিকগণই ভোগ করতে পারে অবাধে, এমনকি পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা জীবন সঙ্কটে নিমজ্জমান রোগী পাশের ঘরে থাকলেও। একইভাবে যেখানে সেখানে বিনা অনুমতিতে নানাবিধ পোস্টার ব্যানার লাগানোর স্বাধীনতা বিনা পয়সায় স্বাধীনভাবে ভোগ করে বাংলাদেশীরা, সে হিসেবে হংকং বা সিঙ্গাপুরের নাগরিকগণ অনেকটাই পরাধীন নয় কি? নিজেদের স্বার্থে ডাকা হরতাল পালনে ভাড়াটে অগ্নি সংযোগকারী কিংবা ভাংচুরের স্বেচ্ছাসেবী আর পাবে কোন দেশে কেবল বাংলাদেশ ছাড়া? তাইতো যে কেউ যখন তখন ডাকতে পারে দেশব্যাপী হরতাল, এ জন্যে আগের দিন কয়েকটি গাড়িতে আগুন দিলেই কেলস্না ফতে। তাই হরতাল মানতে বাধ্য করার স্বাধীনতা ভোগ করে এদেশের হরতালকারীগণ, অন্য অনেক দেশেই যা থাকে না।

 দেশের সর্বত্র ভিক্ষাকরা ও চাঁদা তোলার স্বাধীনতা আছে বাংলাদেশে, যা পারেনা উন্নত চীনের নাগরিকরা। আইন থাকা সত্বেও গ্যাস ভর্তি ও ফেরিতে ওঠার সময় যাত্রী বাসে বসে থাকার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে বাংলাদেশে। এ ক্ষেত্রে বর্ণিত সময় নরওয়ে বা ফিনল্যান্ডের যাত্রীদের বাংলাদেশের যাত্রীদের মত স্বাধীনভাবে গাড়িতে বসে থাকার অধিকার নেই। এদেশের মটর সাইকেল চালকরা সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে যত্রতত্র ফ্রি স্টাইলে ছোটার ও পথচারিকে ধাক্কা দিয়ে যেভাবে ফুটপাথ দিয়ে ছুটতে পারে দূরনত্ম স্বাধীন বালকের মতো, তা ভোগ করতে পারেনা বিশ্বের কোন উন্নত কিংবা অনুন্নত দেশে। আবার এদেশের কসাই-সহ অনেক দোকানীই ওজনে কম দেয়ার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে, ‘তথাকথিত উন্নত দেশের মত’ তাকে কড়ায় গ-ায় ১-কেজিতে ১০০০ গ্রামই দিতে হয়না। দেশের সর্বত্র ফিটনেসবিহীন লঞ্চ, বোট, ট্যাম্পু, বাস ইত্যাদি চলার স্বাধীনতা পায় বর্ণিত বাহনের মালিক ও চালকরা, যা ইউরোপের কোন দেশই পায়না। হেল্পার হিসেবে কাজ শেষে জাল লাইসেন্স কিংবা বিনা লাইসেন্সে পাবলিক বাসের ড্রাইভার হওয়ার স্বাধীনতা আর কোন দেশের নাগরিকগণ ভোগ করতে পারে চরম স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ছাড়া? আবার এদেশের সরকারি অফিসগুলো বিনা নোটিশে যখন তখন বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহ বন্ধ করার স্বাধীনতা ভোগ করে, যা পারেনা ‘তথাকথিত স্বাধীন’ বিশ্বের দেশগুলো। প্রকাশ্যে অফিস আদালতে ঘুষ চেয়ে নানা কৌশলে আদায় করার স্বাধীনতা পায় আমাদের অফিসের লোকজন, যা কোরিয়ান বা জাপানীরা পারেনা। লাখ লাখ মানুষ কোন কাজ না করেও কেবল চাঁদাবাজী করে জীবন যাপনের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে বাংলাদেশের মতো দেশে। যা পারেনা মেক্সিকো কিংবা ইতালীর সাধারণ পাবলিক।

এভাবে বিচার করলে দেখা যাবে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার অনেক দেশের নাগরিকগণ স্বাধীনতার নামে প্রকৃতপক্ষে ‘পরাধীন’, সে হিসেবে একাত্তরে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে কেনা বাংলাদেশের লোকজন কতই না স্বাধীন! এ চরম তথা পরম স্বাধীনতা হয়তো এ জন্য যে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ যখন নিজের দেশকে স্বাধীন রেখেছিল কিংবা অন্যের দেশ দখল করেছিল, তখন বাঙালিরা ছিল নিজ দেশেই পরাধীন। হাজার বছর পরাধীনতার গস্নানি থেকে একাত্তরে প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়ে নিজেরা নিজেদের শাসক হয়ে পুরো দেশটি পরিণত করেছে একটি স্বেচ্ছাচারী ‘চরম স্বাধীন’ দেশ হিসেবে, যার বর্ণনা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো। এখন এ জাতিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি এভাবে ‘চরম স্বাধীন দেশ’ থাকবে অনন্তকাল? নাকি কিছুটা ‘পরাধীন’ হবে অন্যের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর জন্যে?     


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন