শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমার ভাষা বিষয়ক চিন্তন প্রপঞ্চ # ৩ : ভাষা প্রবন্ধ # ৫৫

আমার ভাষা বিষয়ক চিন্তন প্রপঞ্চ # ৩
বাংলা ভার্সাস হিন্দি ভাষা
(বাঙলা ভাষার আধুনিকায়ন তথা সংস্কার বিয়ষক ১০-টি পোস্টের সিরিজ)
পৃথিবীর নানাবিধ আবিষ্কারের মধ্যে ভাষা আবিষ্কার সবচেয়ে চমকপ্রদ, জটিল এবং যুগপতভাবে সব আবিষ্কারের মধ্যে শ্রেষ্ঠতর! যদিও আবিষ্কারকের নাম অদ্যাবধি অজ্ঞাত! বাঙলা ভাষাটি এখন পৃথিবীর বহু মানুষের ব্যবহৃত এবং সমৃদ্ধ একটি ভাষা হলেও, এর অধিকাংশ শব্দ আমরা ঋণ করেছি সংস্কৃত ভাষা থেকে। এ উপমহাদেশের অনেক ভাষাই নানা বিচারে সংস্কৃত ভাষার কাছে ঋণ স্বীকার না করে পারে না; যেমন পারেনা হিন্দী, উড়িয়া, অহমিয়া কিংবা মৈথিলি। ইন্দো-ইউরোপিও ভাষা পরিবারের সদস্য হিসেবে ভারতীয় হিন্দী ভাষায় অসংখ্য রূপমূল আমরা পাবো, যাতে দেখা যায় বাঙলা এবং হিন্দীর মধ্যে রূপমূলগত প্রভেদ অত্যন্ত ক্ষীণতর। নিচের উদাহরণ থেকে বিষয়টি ষ্পষ্টতর হবে যে, বাংলা ও হিন্দী ভাষায় ব্যবহৃত একই শব্দ কিছুটা পরিবর্তনের পরও কতটা হৃদয়ের কাছাকাছি তারা। আলোচ্য শব্দগুচ্ছের প্রথম শব্দটি বাংলাভাষি এবং ২য়-টি হিন্দিভাষিক মানুষেরা যেখাবে উচ্চারণ করে তা দেখানোর চেষ্টা করা হল। যাতে স্বচ্ছতর হবে দেবনাগরী বর্ণমালার হিন্দির সঙ্গে ব্রাহ্মী লিপির বাঙলার প্রভেদ কতই না তুচ্ছ!
উদাহরণ : [বাংলা ভার্সাস হিন্দি শব্দ]
ঠোঁট-অধর, ডিম-অন্ডা, হৃদয়-দিল, হৃদপিন্ড-কলেজা, আকাশ-নভহ, কুমার-কুমহার, ধোপা-ধোবী, সমুদ্র-সমুন্দর, কৃষক-কিষাণ, অবতরণ-অওতরণ, কাজ-কাম, পদ্ম-শতদল, কাঁঠাল-কটহল, অবসর-অওসর, তাড়াতাড়ি-ঝটপট, কোমর-কমর, ডাল-দাল, দৈ-দহি, জল-পানি, সূর্য-সুরুজ, ঘি-ঘৃত, কলা-কেলা, নৈতিক-ন্যায়তিক, কোকিল-কোয়েল, অংশ-অন্‌স, ভিতর-অন্দর, দুঃসময়-দুহ্‌সময়, গ্রাম-গাও, তফাৎ-ফর্‌ক, ভাবী-ভাভী, মা-মাঁ, বড়ভাই-বঢ়াভাই, পিতা-বাবা, বোন-ব্যাহিন, বউ-বহু, হাত-হাথ, চোখের পাতা-পলক, রসগোল্লা-রছুগুল্লা, ফুলকপি-ফুলগোভী, বেগুন-ব্যায়গুন, টমেটো-টমাটর, করলা-করেলা, জাম-জামুন, শশা-খিরা, তরমুজ-তরবুজ, মিষ্টি-মিঠা, কুকুর-কুত্তা, ছাগল-বকরী, হাতি-হাথী, হরিণ-হিরণ, শুকর-শুওর, বানর-বান্দর, কেঁচো-কেচুয়া, হাঁস-হন্‌স, কাক-কউয়া, বই-কিতাব, শ্রেণি-কক্‌ছা, শিক্ষক-শিক্‌ষক, ইক্ষু-ইক্‌ষু, নারিকেল-নারিয়েল, হলদু-হল্‌দী, মরিচ-মির্চ, লবঙ্গ-লংগ, চুলকানী-খুজলি, বেগুনী-ব্যায়গনী, নৌকা-নাও, থালা-থালী, জামা-কামিজ, পাঞ্জাবীসার্ট-বাঙালিকামিজ, ডাকঘর-ডাকখানা, চিড়িয়াখানা-চিড়িয়াঘর, শ্রমিক-মজুর, অন্ধ-অন্ধা, কালা-বওড়া, মিথ্যা-ঝুট, খোড়া-লেংড়া, পরিবার-পরিওয়ার, বাতাস-হাওয়া, পাথর-পাতথর, রাস্তা-সড়্‌ক, লজ্জা-সরম, নারী-আওরাত, তাড়াতাড়ি-জলদী, জ্যোৎস্না-চাদনী, পুরুষ-মর্দ, আলো-রশ্‌নি, বর-দুল্‌হা, জমি-খেত, অনেক-বহুত, ভয়-ডর, স্নানকরা-নাহানা, নাচা-নাচনা, বলা-কহনা, সত্য-সাচ, লবন-নিমক, অজুহাদ-বহানা, বন্ধু-দোস্ত, সমাপ্ত-ছমাপ্ত, সাত-ছাত, অতিথি-মেহমান, শব্দ-আওয়াজ, অদক্ষতা-অদক্‌ষতা, যোগ্যতা-ইয়োগ্যতা, অক্ষম-অক্‌ষম, কর্মচারী-করমচারী, ছুটি-ছুট্‌টি, দৈনিক-দায়নিক, নগদ-নক্‌দ, বকেয়া-বাকায়া, সম্পর্ক-ছমপর্ক ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত উদাহরণের তালিকা আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা সম্ভব। কিন্তু তা না করেও বলা সহজতর যে, বিশ্বে ব্যবহৃত আধুনিক ভাষাগুলোর নৈকট্য কতই না ঘনিষ্ঠতর! বাঙালিরা যেমন তাদের ব্যবহৃত নানাবিধ শব্দমালা খুঁজে পাবে হিন্দীতে; তেমনি আরবি, ইংরেজি, অসমিয়া, বিহারি কিংবা ভোজপুরি ভাষার মধ্যেও এভাবে প্রায় একই কিংবা সামান্য পরিবর্তিতরূপে বিদ্যমান নানা বিচিত্র ভাষিক শব্দসম্ভার! যা পৃথিবীর ভাষাগুলোকে শৃঙ্খলিত করেছে একটা ভাষিক ঐকতানে। মানুষের মাঝে বর্ণিত ঐক্য রক্ষিত হলে জাতিগত ঈর্ষা ও মানব বিদ্বেষিতা অবশ্যই অবদমিত হবে কালক্রমে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন