শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমার ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধমালা # ১০ : ভাষা প্রবন্ধ # ৫৬


ইংরেজি, আরবি ভাষার চেয়ে ‘বাংলা’ কেন শ্রেষ্ঠ ভাষা!
আমরা বাংলা ভাষাভাষী প্রায় সবাই কমবেশী ইংরেজি, আরবি ভাষার সাথে পরিচিত। বাংলা ভাষার চেয়ে অনেক পুরনো ভাষা হচ্ছে ইংরেজি ও আরবি। ‘ইংরেজিভাষী বৃটিশ’ কর্তৃক একসময় ‘বিশ্বশাসনের’ বদৌলতে ইংরেজি ভাষা এখন প্রধান আন্তর্জাতিক মর্যাদাপ্রাপ্ত ভাষা। মুসলমানদের ‘ধর্মীয় ভাষা’ ও মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো-ডলারের বদৌলতে আরবি ভাষাও এখন বিশ্বে কম ব্যবহৃত ভাষা নয়। যদিও বাংলাদেশের ১৫/১৬ কোটি বাঙালী ছাড়াও পশ্চিম বাংলা, উড়িষ্যা, মেঘালয়, ত্রিপুরা, বিহার এমনকি ‘ভুটানে’র (ফুল্টসলিং এলাকায়) অনেক মানুষ বাঙলায় কথা বলে। বৃটেন, উত্তর আমেরিকাসহ বিদেশেও অনেক বাংলাভাষী বর্তমানে বসবাস করছে। অর্থাৎ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাভাষী খুব একটা কম না হলেও আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বাংলা কিন্তু তেমন একটা স্বীকৃতি এখনও পায়নি বিশ্বজনীনভাবে। যদিও ‘ধ্বনি’ ও ‘বর্ণ’ তাত্ত্বিক বিচারে আলোচ্য আরবি ও ইংরেজি ভাষার তুলনায় বাংলা শুধু শ্রেষ্ঠই নয় বরং ‘শ্রেষ্ঠতম’। এ কথা শুনে অনেকে হয়তো চমকে উঠতে পারেন বাংলা ভাষার এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা শুনে। আসলে কিন্তু সত্যিই তাই। একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
পৃথিবীর সকল ভাষার ধ্বনিসমূহ ২-ভাগে বিভক্ত তা হচ্ছে ‘স্বরধ্বনি’ (স্বাধীন ধ্বনি) আর ‘ব্যঞ্জনধ্বনি’ (পরাশ্রিত/পরাধীন ধ্বনি)। আর ধ্বনির প্রতীকগুলো হচ্ছে ‘বর্ণ’। স্বাধারণত স্বরধ্বনির সাহায্য নিয়ে ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো তার ধ্বনিমাধুর্য প্রকাশ করে। তবে স্বরধ্বনিগুলো আলাদাও স্বাধীনভাবে প্রকাশ হতে পারে। বাংলায় আছে মোট ১১-টি স্বরবর্ণ। পক্ষান্তরে আরবিতে স্বরবর্ণ মোট ৩টি (আলিফ, ওয়া, ইয়া) এবং ইংরেজিতে ৫টি (এ, ই, আই, ও. ইউ)। বাংলায় ১১টি স্বরবর্ণ থাকাতে বাংলাভাষীরা খুব সহজেই বাংলা ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য ভাষার শব্দ ও বাক্যগুলোকে নিজ ভাষায় প্রকাশ করতে পারে, যা পারেনা ‘আরবি’ বা ‘ইংরেজি’ ভাষাভাষী লোকজন। যেমন বাংলা শব্দ ‘দুধ’ বা ‘ঢাকা’ আরবি বা ইংরেজি বর্ণ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়। কিন্তু আরবি যে কোন শব্দ (যেমন ‘সিতারতুন’ অর্থাৎ কসটেপ) কিংবা ইংরেজি যে কোন শব্দ (যেমন স্টাটিস্টিক্স) বাংলা বর্ণ দিয়ে লেখা সম্ভব। এ ছাড়াও আরবিতে মাত্র ৩টি স্বরবর্ণ (আলিফ=আ, ওয়া=উ, ইয়া=ই) থাকার কারণে আরবিতে ‘অজগর’ লিখতে চাইলে ‘আজগর’ বা ‘উজগর’ বা ‘ইজগর’ লিখতে হবে। অনুরূপভাবে ইংরেজিতে স্বরবর্ণ ৫টি হলেও (এ=আ, ই, আই=ই, ও. ইউ-আ) ধ্বনিগত অনেক শব্দ ঐ স্বরবর্ণ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। যেমন বাংলা ‘অজগর’ আরবির মত ইংরেজিতেও লেখা সম্ভব নয়, কেননা ইংরেজি বা আরবিতে ‘অ’ বর্ণ নেই। আবার বর্ণিত আরবি ও ইংরেজি ভাষায় ব্যঞ্জনবর্ণের স্বল্পতার কারণেও ঐ ২-ভাষার বর্ণ দিয়ে অনেক শব্দ লেখা সম্ভব নয়। যেমন আরবিতে ‘ঢোল-টাকা’ বা ইংরেজিতে ‘ত্রিরত্ন’ লেখা যাবে না।
উপর্যুক্ত বিশ্লেষণ ছাড়াও বর্ণতাত্ত্বিক বিন্যাসেও বাংলা শ্রেষ্ঠ। যেমন বাংলা বর্ণকে প্রথমে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ হিসেবে আলাদা আলাদা ভাবে সাজানো হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরবি ও ইংজেরী বর্ণ এলোমেলো। আলাদা করা ছাড়াও বাংলা ব্যঞ্জন বর্ণকে আবার বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে বর্গীয় বর্ণ ও অবর্গীর্য় হিসেবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। যেমন কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয় এই শ্রেণির বর্গকে ‘ক-বর্গীয়’, অনুরূপভাবে উচ্চারণস্থান অনুযায়ী মোট ২৫টি বর্গীয় বর্ণকে সাজানো হয়েছে। প্রত্যেক বর্গের ৫টি বর্ণকে আবার সাজানো হয়েছে আরো উন্নততর পদ্ধতিতে। যেমন বর্গের ১ম+৩য় বর্ণটি অল্পপ্রাণ (প্রাণতা-), ২য়+৪র্থ বর্ণটি মহাপ্রাণ (প্রাণতা+) এবং বর্গের ৫ম বর্ণটি আনুনাসিক (ন্যাজালাইজড্)। সজ্জিতকরণের এই বিজ্ঞানমনস্কতাকে ভিত্তি ধরে বাংলা বর্ণের জন্যে একটি ‘সূত্র’ বানানো যেতে পারে এভাবে (এটি লেখকের উদ্ভাবিত)ঃ ‘‘বাংলা বর্গের ১ম ও ৩য় বর্ণটি অল্পপ্রাণ (প্রাণতা-), ২য় ও ৪র্থ বর্ণটি মহাপ্রাণ (প্রাণতা+), ১ম ও ২য় বর্ণটি অঘোষ (ঘোষতা-), ৩য় ও ৪র্থ বর্ণটি ঘোষ (ঘোষতা+) এবং বর্গের ৫ম বর্ণটি আনুনাসিক+ঘোষ’’। আরবি বা ইংরেজি ভাষাকে এভাবে কোন সূত্রে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া বাংলা স্বরবর্ণগুলোকে অনেক সময় ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে ব্যবহারের সুবিধার জন্যে তার আকার আকৃতি কাটছাট করা যায়। যেমন ‘ক্রান্তি (করআনতই)’ কিন্তু আরবিতে ক্ষেত্র বিশেষে সম্ভব হলেও ইংজেরীতে এভাবে ‘সর্টকাট বর্ণ’ সম্ভব নয়। শব্দগুচ্ছ তৈরীর সাধারণ নিয়ম হচ্ছে একটি স্বরবর্ণের পর একটি ব্যঞ্জন, আবার স্বরবর্ণ হবে যেমন ‘আমি তোমাকে দিলাম’ (ami tomake dilam) কখনো ব্যতিক্রম হতে পারে। যেমন ‘গ্লাস’ বা ‘প্রাণ’ (glass বা pran)। এ ক্ষেত্রে ধ্বনি গঠনের স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যেহেতু পাশাপাশি দুটো ব্যঞ্জনবর্ণ একত্রে এসেছে, তাই কেবল বাংলা ভাষায় উচ্চারণ জনিত শুদ্ধতার কারণে ‘গ্লাস’ ‘গেলাস’ বা ‘প্রাণ’ ‘পেরান’ না হয়ে ‘গ+ল+আ=‘গ্লা’ এবং প+র+আ=‘প্রা’ অর্থাৎ ব্যতিক্রমী পাশাপাশি দুটো ব্যঞ্জনবর্ণ ব্যবহৃত হওয়ার কারণে (gl) কিংবা (pr) বাংলা ভাষায় তা একটি বর্ণের সঙ্গে অন্যটি ঢুকে গেছে (প্রা, গ্লা)। যা ইংরেজি বা আরবিতে কখনো হয়না। এটি আধুনিক ভাষাতত্ত্বে চমৎকারভাবে বিশ্লেষণের দাবী রাখে।
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ‘আত্মীকরণ’। বাংলার মত খুব কম ভাষাই আছে যে সহজেই বিদেশী ভাষাকে আত্মীকরণের মাধ্যমে ‘হজম’ করে ফেলতে পারে। ইংরেজি বা আরবির এ সুবিধা নেই। যেমন বাংলাভাষীরা খুব সহজেই এমন বাক্য বানাতে পারে, ‘‘হোটেলে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেই ফ্যাক্স ওকে করে ইন্টারনেটে ক্লিক করলাম’’। এ বাক্যে ‘হোটেল’, ‘ব্রেকফাস্ট’, ‘ফ্যাক্স’, ‘ওকে’, ‘ইন্টারনেট’, ‘ক্লিক’সহ মোট ৬টি ‘বহিরাগত’ শব্দকে বাংলাভাষী আত্মীকরণের নামে ‘হজম’ করলেও ‘বদহজম’ কিন্তু হয়নি। এভাবে সাবলিলভাবে অন্য ভাষিক শব্দকে কখনো আরবি বা ইংরেজিতে ব্যবহার করা যায়না। এমনকি আরবি ভাষায় কিছু বাইরের শব্দ আনলেও ধ্বনি ও বর্ণ বিষয়ক জটিলতার কারণে তার তার সঠিক উচ্চারণ করতে পারেনা। যেমন ইংরেজি ‘potato’ আরবিতে ‘বাতাত’ এবং ‘Television’ আরবি ভাষীদের কাছে ‘তেলিফিজিওন’ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ বাঙালীদের মত ‘হজমশক্তি স্ট্রং’ না হওয়ার কারণে এরূপ উচ্চারণ তারা করতে বাধ্য হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও একুশের চেতনায় স্নাত হয়ে এর আন্তর্জাতিকরণের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন