সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ভাষা রিলেটেড বিতর্ক-১ : আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ ও ভাষা সংস্কার বিষয়ক যুক্তি # ১১৪

আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ ও ভাষা সংস্কার বিষয়ক যুক্তি - ১

বাঙালির সপ্তপদী বিষ্ময়কর ঘটনার মতই আরেক বিষ্ময় হচ্ছে, এ ভাষাটির জন্যে প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেনঅবাঙালি একজন ধর্মযাজক মানুয়েল দ্য আসসুম্পসাঁও, যা প্রকাশিত হয় লিসবন থেকে ১৭৪৩ সনে রোমান হরফেভোকাবুলারিও এম ইদিওয়া বেনগল্লা ই পর্তুগিজঃ দিভিদিদো এম দুয়াস পার্তেস নামে! এরপর ন্যাথেনিয়েল ব্র্যাইসি হ্যালহেড বাংলা হরফে প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচণা করেন ১৭৭৮ সনে। উইলিয়াম কেরী ১৮০১ সনে রচনা করেন A Grammer of the Bengali Language নামে বাংলা ব্যাকরণ। বাংলাসহ পূর্ব ভারতীয় ভাষার মিশ্র ব্যাকরণ রচনা করেন হেরাসিম লেবেদেফ ১৮০১ সনে। ১৮২০ সনে জিসি কীথের বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়। ১৮২১ সনে প্রকাশিত হয় জিসি হাউটনের Rudiment of Bengali Grammer নামে বাংলা ব্যাকরণ। এর আগে ১৮১৬ সনে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের বাঙলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়, যিনি ছিলেন মূলত বাঙালি। এরপর বীমস,ফার্গুসন থেকে গ্রীয়ারসন পর্যন্ত অনেকেই রচনা করেছেন বাংলা ব্যাকরণ’, যা মূলত সংস্কৃত ও ইংরেজী ব্যাকরণের ঢং-এ রচিত কৃত্রিম বাংলা ভাষিক ব্যাকরণ মাত্র। 

পাটিলিপুত্র রাজাদের অভিবাসিত ও পুরস্কৃত বিদ্যাজীবী পাণিনি বিবৃতিমূলক সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করেন যিশুর জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে। উপর্যুক্ত ব্যাকরণ রচয়িতাগণ পাণিনীয় ব্যাকরণিক ধারাকে গ্রহণ করে অবৈজ্ঞানিকভাবে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও, যার মূলত জন্ম বাংলা ভাষার জন্মের অনেক আগে! বাঙালির ব্যাকরণ হচ্ছে,প্রথাগত সংস্কৃত ব্যাকরণের বিধিবিধান আর সূত্রগুলোকে বাংলায় প্রচার আর প্রকাশ মাত্র। এ ব্যাকরণ পাঠে তুলনামূলক কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, অর্থতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব বিশ্লেষণের পরিবর্তে বর্ণনামূলক কিছু সূত্র শেখা সম্ভব। এগুলো বিদ্যালয়পাঠ্য প্রথাগত ব্যাকরণ পুস্তক নিঃসন্দেহে কিন্তু আধুনিক বাংলা ভাষা বিশ্লেষণ শাস্ত্র নয়। সংস্কৃত ব্যাকরণ কাঠামোতে বর্ণিত হয়েছে প্রায় সকল বাংলা ব্যাকরণ। সংস্কৃত ব্যাকরণ হচ্ছে বেদ-নির্ভর। এ ব্যাকরণ আনুশাসনিক ও শব্দকেন্দ্রিক। বাংলা ব্যাকরণ কখনো ইংরেজি ও সংস্কৃত ব্যাকরণের বাইরে যেতে পারেনি। যদিও বাংলা ভাষা ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষা থেকে পৃথক একটি ভাষা। আসলে সঙ্কর বাঙালি জাতির মত ল্যাটিন,ইংরেজী ও সংস্কৃত ব্যাকরণের সঙ্করে সৃষ্ট বাংলা ব্যাকরণ পুস্তকরাজিগুলো। আমাদের প্রচলিত প্রথাগত ব্যাকরণের শব্দ বিশ্লেষণ সর্বাংশে আবার অসংস্কৃত অনুসারী। এর কারকতত্ত্ব সংস্কৃত, উদ্দেশ্য-বিধেয়ভিত্তিক বাক্যতত্ত্ব আবার ইংরেজি বাক্য অনুসরণে রচিত। আমাদের উল্লিখিত ব্যাকরণবিদগণ কেবল প্রথাগত ব্যাকরণের মধ্যেই আবদ্ধ থেকে হাবুডুবু খেয়েছেন, আধুনিক রূপতত্ত্বের আলোকে বর্ণিত কোন ব্যাকরণেই আলোকপাত করেনি বৈজ্ঞনিক বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে। এ থেকে মুক্ত হয়ে বের হতে পারেননি ড. সুনীতিকুমার তাঁর ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণে কিংবা ড. শহীদুল্লাহ তাঁরবাঙ্গালা ব্যাকরণ নামক পুস্তকেও। প্রায় আড়াইশো বছরের প্রথাগত বর্ণনামূলক ধ্রুপদী সংস্কৃত ব্যাকরণের সূত্র পর্যালোচনাই হচ্ছে আধুনিক বাংলা ব্যাকরণচর্চা। 

প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরণো অনাধুনিক ব্যাকরণ আমরা ব্যবহার করছি বিধায়, আমাদের ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে ব্যাকরণের অনেক কিছুতেই মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কারণ ব্যাকরণটি রচিত হয়েছিল ভাষাটি জন্ম বা ব্যবহারের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে! বর্ণিত ব্যাকরণের ণ-ত্ব/ষ-ত্ব বিধান, সন্ধি প্রকরণ, বিসর্গ ও ব্যঞ্জন সন্ধি, কৃৎ-তদ্ধিত-সংস্কৃত প্রকৃতি-প্রত্যয় (-তা, -ত্ব, -ইমা ইত্যাদি), কারক-বিভক্তি, উপসর্গ-অনুসর্গ, ক্রিয়ার কাল, ধাতুর রূপ, ক্রিয়ামূল-ধাতু, দ্বন্দ্ব-বহুব্রীহি-দ্বিগু সমাস ইত্যাদির বিভাজন, সূত্র ইত্যাদি সবই সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে ধার করা। যে কারণে সংস্কৃত থেকে আগত ‘‘বচ্+তি=উক্তি’’ কিংবা ‘‘ক্ষে+ত=ক্ষীণ’’ আবার ‘‘ইহ+ইক=ঐহিক’’ কিংবা ব্যঞ্জন সন্ধিতেউৎকৃষ্+ত=উৎকৃষ্ট’, ‘যজ্+ন=যজ্ঞ কেন কিংবা কিভাবে হয়েছে, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিন্তু বাঙালি শিক্ষার্থীরা ঠিক বুঝতে পারছে না কেবল মুখস্ত করা ছাড়া। আর বিজ্ঞান ও যৌক্তিক শিক্ষার এ যুগ কি মুখস্ত বিদ্যার যুগ হবে বোধগম্যতা বাদ দিয়ে? একইভাবে খাওয়া ক্রিয়াপদ অতীতকালে খাইছিলাম হলেও, ‘যাওয়া ক্রিয়াপদে কেনযাইছিলাম না হয়ে গিয়েছিলাম হচ্ছে, তারও কোন সদুত্তর শ্রদ্ধেয় পাণিনির ব্যাকরণে নেই। এই অপারগতাকে ঐ ব্যাকরণ বলছে নিপাতনে সিদ্ধ। তা ছাড়া আধুনিক রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বকে সময়োপযোগী তথা আধুনিক কম্পিউটার-ইন্টারনেটে ব্যবহার উপযোগী করার জন্যে এর বর্ণগুলোকে ল্যাটিন-ইংরেজী হরফে ব্যবহারের চিন্তাও করা যেতে পারে। এর কারণ হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় সকল জীবন্ত ভাষায় একটি শব্দ গঠনে বর্ণ (ধ্বনি) বিন্যাসের গঠন প্রক্রিয়া হচ্ছেঃ VCVCVC (স্বব্যস্বব্যস্বব্য) কিংবা CVCVCV (ব্যস্বব্যস্বব্যস্ব), মানে শব্দের প্রথম বর্ণটি স্বরধ্বনি হলে, পরবর্তীটি ব্যঞ্জনধ্বনি হবে কিংবা প্রথমটি ব্যঞ্জন দিয়ে শুরু হলে, পরবর্তী ধ্বনিটি হবে স্বরধ্বনি। যেমনamar(VCVC) nam(CVC) golap(CVCVC) (আমার নাম গোলাপ)। এ বাক্যে গঠিত ৩-টি শব্দই ল্যাটিন-ইংরেজী হরফে খুব সহজে উপর্যুক্ত গঠন সূত্র পাঠযোগ্য হলেও, বাংলা শব্দ গঠনে স্বরবর্ণগুলোর ব্যঞ্জনের সঙ্গে সংক্ষিপ্তাকারে চেহারা পরিবর্তনের কারণে সূত্র বিভাজন পাঠ কিছুটা জটিলতর বটে, অন্তত ল্যাটিন-ইংরেজী হরফের তুলনায়। তা ছাড়া বর্তমানে ইন্টারনেটের জ্ঞানের সমুদ্রে অবগাহনের জন্যে ল্যাটিন-ইংরেজী হরফে সার্জ-ইঞ্জিন’ (Google, Yahoo) ইত্যাদির বিকল্প নেই। যে কারণে আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়েই ফেইসবুকবা অন্যান্য চ্যাটিং সাইটে ল্যাটিন-ইংরেজী হরফে বাংলা চ্যাটিং করছে অহরহ। মালয়শিয়া, ফিলিপিন আর ইন্দোনেশিয়ানরা হয়তো এ বিষয়টি উপলব্দি করে তাদের নিজস্ব ভাষায় এখন ব্যবহার করছে ল্যাটিন-ইংরেজী হরফ। মানে তারা ল্যাটিন-ইংরেজী হরফে তাদের নিজস্ব ভাষা লিখছে। যে কারণে তারা ইন্টারনেটেও বেশ পারদর্শী।[এরপর পর্ব ২ ]
 
লেখকের ফেসবুক ঠিকানা : https://www.facebook.com/DrLogicalBangal

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন