শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাঙালি : বিশ্বের গরিবতর জাতি কিন্তু ভয়াবহ অপচয়কারী ২ পর্বের লেখাটির শেষ পর্ব : ৬০

বাঙালি : বিশ্বের গরিবতর জাতি কিন্তু ভয়াবহ অপচয়কারী
২ পর্বের লেখাটির শেষ পর্ব
আরেকটি ভয়াবহ অপচয়ের চিত্র হচ্ছে আমারদের ‘ঈদগাহ গুলো’। বছরে ২-দিন ঈদের নামাজ আদায় করার জন্যে দেশের সর্বত্র কয়েক লাখ ‘ঈদগাহ’। সবচেয়ে মজার ও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামের মূল জন্মভূমি মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে এমনকি খোদ সৌদি আরবের কোন এলাকায়ই, এমনকি মক্কা বা মদীনায় কোন ‘ঈদের মাঠ’ নেই। মহানবীর আমলেও কোথাও মাঠে ঈদের নামাজ পড়া হয়েছে বলে কোথাও উল্লেখ নেই। সেখানের সকল মানুষ ফজরের নামাজ শেষেই মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করে। যদিও জমি বা স্থানের সংকট আরবে নেই। কিন্তু আমাদের দেশে জমির মারাত্মক স্বল্পতা থাকা সত্বেও, এদেশে কিভাবে ঈদের মাঠ এলো তা কিন্তু গবেষণার বিষয়! চিন্তাশীল ও দেশপ্রেমিক মুসলমানদের ভেবে দেখতে হবে, বছরে ২দিন আমরা সংরক্ষিত ঈদের মাঠে নামাজ না পড়ে স্টেডিয়াম বা নিকটবর্তী স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বা খেলার মাঠে নামাজ পড়লে দেশ বা জাতির কি কোন ক্ষতি হবে? আবার খেলার জন্য আলাদা স্টেডিয়াম না বানিয়ে ঈদগাহকে বিকল্প মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা তাও চিন্তার দাবী রাখে। আর হ্যা, ঈদের মাঠগুলো আমরা রাখতেও পারি, সেক্ষেত্রে বছরে ২-দিন ঈদের নামাজ পড়া ছাড়াও এই মাঠগুলোকে আমরা অন্য ধর্মীয়, খেলাধুলা ও সামাজিক কাজেও লাগাতে পারি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়া দিতে পারি। খেলাধুলা বা শাকসবজি উৎপাদনের মত কাজে ব্যবহার করতে পারি। একই কথা টঙ্গীর ‘বিশ্ব ইজতিমা মাঠের’ জন্যও চিšতা করা অত্যাবশ্যক।

আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিবহণ বিআরটিসি সুপ্রীম কোর্ট, সচিবালয় ইত্যাদি সংস্থায় অনেক বাস দিয়েছে কেবল সকালে ১-বার ও অফিস শেষে আরেকবার কর্মচারীদের বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য। অন্য সময় সারাদিন-রাত বাসগুলো বেকার দাঁড়িয়ে থাকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে কিংবা সচিবালয় গেটে। আর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রহর গুণছে কখন বাস আসবে? এই বাসগুলো কি কেবল ২-বার আসা-যাওয়ার জন্য আমদানী করা হয়েছে? বিআরটিসির বর্ণিত বিভিন্ন সংস্থায় প্রদত্ত বাসগুলো কেবল সকাল-বিকেল ২-বেলা সংস্থার যাত্রী পরিবহণের কাজ শেষে সাধারণের জন্য রাস্তায় চলে আসতে পারে এবং একই ভাবে সরকারি ও আধাসরকারি সংস্থার নিজস্ব কেনা বাস দিয়েও অলস সময়ে যাত্রী পরিবহণ করে মানুষের কষ্ট লাঘব করতে পারে, যেগুলো কেবল ২-বেলা সরকারি প্রতিষ্ঠানের জনবলকে পরিবহণ করে বাকি সময় বসে থাকে।

সরকারি প্রায় সকল দফতর এখন ইন্টারনেটসহ কম্পিউটার ব্যবহার করে। কিন্তু অধিকাংশ অফিস অত্যন্ত দামী কম্পিউটারকে কেবল ‘টাইপ-মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করে ফাইলিং ইত্যাদি চালাচ্ছে সেকেলে পদ্ধতিতে, যাতে সময় অপচয় ছাড়াও দুর্নীতি চালানো যায় সহজ পদ্ধতিতে। দেশের সর্বত্র এখন ‘অনলাইন’ ব্যবস্থা চালু থাকলেও, মারাত্মক অপচয়মূলকভাবে আমাদের হাজার হাজার প্রাত্যহিক সরকারি ‘গেজেট’, হাইকোর্টের প্রাত্যহিক ৫০০/৬০০ পৃষ্ঠার ‘কজলিস্ট’ বা সূচিপত্র, সংসদের কার্যবিবরণীসহ নানাবিধ সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচি ইত্যাদির হাজার হাজার বই বিজি প্রেসে ছাপা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। আবার প্রতিটি সরকারি ফাইল-পত্রের সঙ্গে ‘সংযুক্তি’ হিসেবে নানাবিধ কাগজপত্রের ফটোকপি দেয়ার ‘রেওয়াজ’ প্রচলিত এদেশে, যেগুলো আগেই সংশ্লিষ্ট ফাইলে রক্ষিত ছিল। এভাবে প্রতিটি ফাইল একই কাগজের একাধিক কাগজের ভারে ভারাক্রান্ত প্রায় সকল অফিসে। যেমন একজন নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের ‘এমপিও’ করার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের নিয়োগ-যোগদানপত্র ছাড়াও, ঐ স্কুলের যায়গা-জমি, মাঠ-গাছ, পিওন-দপ্তরী ইত্যাদির নানাবিধ বর্ণনা দিতে হয় প্রায় ৩২ পৃষ্ঠার ৪-সেট। যা আগে থেকেই শিক্ষা দপ্তরে সংরক্ষিত ছিল।

প্রত্যহ লক্ষ লক্ষ লোক এদেশে চায়ের দোকানে অপচয়মূলক গালগল্প করে সময় কাটায়, আবার হাজার হাজার মানুষ বিনা কাজে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বাস-ট্রেনে ঘুরে ঘুরে যথার্থ কাজের লোকের যাতায়াতে বিঘ্ন ও রাষ্ট্রীয় অপচয় বাড়ায়। রাস্তা, ব্রিজ বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদ্বোধনের নামে সময় ছাড়াও কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ঘটে। ফিতা কেটে প্রধানমন্ত্রী বা কোন মন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠান উদ্বোধনের প্রস্তুতি শুরু হয় মূল অনুষ্ঠানের অন্তত ২-মাস আগে এবং তাতে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের নানা পর্যায়ের জনবলের নানাবিধ মিটিংয়ে সময় ঘণ্টা ছাড়াও পানির মত অর্থ খরচ হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠান উদ্বোধনের জন্য প্রায় ৪০-লাখ টাকা খরচ ছাড়াও, প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি বহর ঢোকার জন্য বিশাল একটি দেয়াল ভেঙে ফেলতে হয় এবং অনুষ্ঠানে শেষে ঐ দেয়ালটি আবার বানাতে হয় ‘তাৎক্ষণিক টেন্ডারের’ মাধ্যমে।

এদেশেই চৈত্রমাসের গরমেও উকিল ও বড়কর্তাদের কোর্ট-টাই পড়ে অফিস-কাচারীতে এসে, এসি চালিয়ে রেখে নিজেদের ‘গরম পোশাক’কে ঠান্ডা করতে হয়। সম্ভবত বাংলাদেশের মত গরিব রাষ্ট্রেই কোরবানীর সময় ছোট দুম্বা, ভেড়া, ছাগলের পরিবর্তে বিশালকৃতির লাখ টাকার ষাঁড় দিয়ে কোরবানীর প্রতিযোগিতা(?) দেখে ধনকুবের সৌদিরাও বিস্মিত হয়! এদেশে ড্রাইভাররাই বাম-লেন বন্ধসহ সকল ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে, রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা যানজটে আটকে থেকে নিজ ও পাবলিকের সময়ের মারাত্মক অপচয় করে। শিক্ষাক্ষেত্রে ‘আধুনিক গ্লোবাল’ ভাষাদক্ষ নাপিত, কুক, রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী, মোবাইল টেকনিশিয়ান তৈরীর বদলে, নানাবিধ অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে লক্ষ লক্ষ ‘উচ্চ শিক্ষিত বেকার’ তৈরী করে রাষ্ট্র ও পরিবারের বোঝা তথা দেশের জন্য মারাত্মক অপচয় করা হয়, যারা ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ হয়ে সাধারণ কৃষক বা জেলের সšতান হয়েও পরবর্তীতে হয়ে যায়, ‘সংস্কৃতি’ কিংবা ‘দর্শনশাস্ত্রে’ টেনেটুনে পাস করা বেকার ‘এমএ’।

এদেশের সংসদভবন, রমনা, সোহরাওয়ার্দী, চন্দ্রিমা, প্যারেড স্কোয়ার ও সরকারি পার্কসহ নানাবিধ জমিতেই লাগানো হয় আম, জাম, লিচু, নারিকেল, তাল ইত্যাদি ফলবান বৃক্ষের বদলে, নানাবিধ ‘অফলবান’ অজানা দেশী-বিদেশী গাছ-গাছালী। আর অপুষ্টির এদেশে ফল আমদানী করতে হয় ভারত-ভুটান-অস্ট্রেলিয়া তথা বিদেশ থেকে। অর্থের অভাবে মেঘনা-পদ্মায় সেতু না বানাতে পারলেও, এদেশের ‘হাতিরঝিল’ প্রকল্পে কেবল সৌন্দর্যের জন্য ৪-৫টি দৃষ্টিনন্দন ব্রিজ বানানো হয় কোটি কোটি টাকা খরচে। বর্তমান সরকারি অফিসগুলোর প্রবেশদ্বারকে এতো বেশী ‘বিলাসবহুল ও অপচয়মূলক’ বানানো হয় যে, আমেরিকানরা দেখলেও হয়তো লজ্জা পাবে, যা দেখা যাবে নবনির্মিত সরকারি ভবনগুলোতে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক ৪-লেন করতে গিয়ে যে জমি ও জমি ভরাটের খরচ করতে হয়েছে, তার চেয়ে কম খরচে কি ঢাকা-চট্টগ্রামে রেললাইন ডবল করে প্রতি ঘন্টায় দ্রুতগামী ট্রেন চালালে সাশ্রয়ী হতো না? ডবল রেলপথ নির্মাণে কোন লাইনেই আর নতুন করে জমি দখলের প্রয়োজন নেই বাংলাদেশে।

প্রতি বছর এদেশে বিশ্ব ইজতিমায় এসে লক্ষ লক্ষ মানুষ ৩-দিনে ‘সুন্দরতম’ বয়ান শুনে ঘরে ফিরেই পুন. নিমজ্জিত হয় মারাত্মক দুর্নীতিতে, যা এ জাতির সময়ের ব্যাঙ্গাত্মক ও ধর্মীয় মর্ম বাণীর চরমতম জঘন্য অপচয় নয় কি? হরতাল ডেকে এদেশের উৎপাদন ব্যহত ও মানুষকে কষ্ট দেয়া রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি আর দেশেপ্রেমের অপচয়। ভেজাল দিয়ে ও খাইয়ে জাতির স্বাস্থ্যজনিত অপচয় এবং বাণিজ্যিক ডাক্তার কর্তৃক নানা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট ও কোম্পানীর স্বার্থে নানাবিধ ঔষধ লিখে রোগী তথা জাতির সাথে প্রতারণামূলক অপচয় করা হচ্ছে। অনেক ওএসডি সরকারি কর্মকর্তাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিয়ে রাষ্ট্রীয় অপচয় যেমন হচ্ছে, তেমনি গরিব দেশের সেনাসদস্যদের ঢাকার যানজট নিরসন কিংবা দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজে না লাগিয়ে কি অপচয় বাড়ানো হচ্ছে না? রাজনীতির নামে রাস্তায় রাস্তায় হাজারো গেট নির্মাণ আর শুভেচ্ছার নামে পোস্টার-ব্যানারে ঘটনো হচ্ছে ভয়াবহ অপচয়। সরকারি বিভিন্ন আকার আয়তনের ফরম বিভিন্ন সাইজ আর অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা লিখে ও বানিয়ে করা হচ্ছে কাগজের অপচয়। ব্যাংকের একটি জমা স্লিপ ছোট আকৃতির হলেও, ব্যাংকে আয়কর জমাদের ফরমটি হচ্ছে একটি বিশালাকৃতির ‘লিগ্যাল’ সাইজ কাগজের, যা দিয়ে কমপক্ষে ৫-টি জমাস্লিপ বানানো যায়।


এভাবে বিশ্বের এ গরিবতর দেশটি রাষ্ট্রীয় পরিচর্যার মাধ্যমে অপচয়কে লালন করছে সমাজের সর্বত্র, যে কারণে জাতিটি হয়ে উঠছে মারাত্মক একটি অপচয়কারী জাতি হিসেবে। ইসলামে ‘অপচয়’কে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে, অপচয়ের জন্যে পরকালে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তাই আসুন, সব ধরণের অপচয়ের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হই ও প্রচার প্রচারণা চালাই এবং জনবিষ্ফোরণের এই ছোট্ট মাতৃভূমিকে রক্ষা করি। না হলে প্রতিযোগিতামূলক একুশ শতকের গ্লোবাল বিশ্বে আমরা কিভাবে টিকে থাকবো? তাকি একদিকে জণবিস্ফোরণ, অপরদিকে আর্থিক দৈন্যতা, আর বিপরীতমুখী আমাদের সার্বিক অপচয়মূলক আর্থনীতিক কর্মকান্ড দিয়ে? এতে আমরা কেবল দুষ্টচক্রের মধ্যেই ঘুরতে থাকবো নিজেদের উদ্ধার করতে পারবো না কখনোই!





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন