শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

"ভালবাসা আর চুমু" বিষয়ক লেখা "কাট-পেস্ট" # ৭৭


"ভালবাসা আর চুমু" বিষয়ক লেখা "কাট-পেস্ট"

বাঙালির কাছে বিনোদনের একমাত্র উৎস যৌনতা। অথচ বাঙালিরা জন্মগত যৌন অধিকার বঞ্চিত, তারা যৌন শিক্ষাও বঞ্চিত। বাঙালির আশে পাশে যত পরিচিত গালি আছে সব যৌনতা নির্ভর; বাঙালির কাছে যৌনতা অশ্লীল; তাই গালি মাত্রই কটূক্তি। বাঙালিরা নারীর পবিত্রতা যাচাই করে যৌনীর সতীত্ব দিয়ে; পুরুষের বীরত্ব যাচাই করে সহবাসের ক্ষমতা দিয়ে। বাঙালির কাছে চুমো, ভালোবাসা, বিপরীত লিঙ্গের হাত ধরা সব অশ্লীলতা; আবার এই বাঙালিরাই ভালোবাসা বর্হীপ্রকাশ খুঁজে রাত জাগা যৌনতায়। বাঙালি লোকমুখে যৌনতা নিয়ে কথা বলতে লজ্জা পায়; কিন্তু মুখ লুকিয়ে অন্যের যৌনতার কথা ঠিকই শুনে।

বাঙালির প্রধান সমস্যা জনসংখ্যা সমস্যা। জনসংখ্যা সমস্যার একমাত্র কারন যৌনতায় সমস্যা। উন্নতদেশে বাচ্চা নেওয়ার আগে পরিকল্পনা হয়। আর আমাদের দেশে বাবা মায়ের মজার মাঝে কখন সন্তান জন্ম হয় তারাও জানে না। তাই তারা পায় না ঠিক মত যৌনতার স্বাদ; পরিকল্পনা মত হয় না সন্তান উৎপাদন। আর এইভাবেই বেড়েই চলে দেশের জনসংখ্যা।

বাঙালিরা শিক্ষিত হয়েছে এখনও পঞ্চাশ বছর হয় নি; পঞ্চাশ বছর আগেও এক উপজেলায় পঞ্চাশ জন গ্র্যাজুয়েট খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। তবে এই আমরাই বিশ্বাস করি “আমরা এখন আপনার থেকে বেশি বুঝি।” শুধু বুঝি না সভ্যতা থেকে আমরা কতগুন কম জানি। নিজেরা সভ্যতার কথা বলি, মক্কা মদিনার কথা বলি, আবার এই আমরাই অ্যামেরিকার গ্রীন কার্ড খুঁজি।

আমাদের সামনে কোন পুরুষ বিয়ে না করে থাকলে তবে ধরা হয় সে পুরুষত্বহীন; তার লিঙ্গ দাঁড়ায় না। নারী বিয়ে না করে একলা জীবন কাঁটালে বলি “ওই মাইয়া রাতে খদ্দর খুঁজে।” বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী স্বেচ্ছায় সন্তান না নিলে ধরা হয় স্ত্রী বন্ধ্যা; তার সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নেই।

বিয়ে একটি সামাজিক প্রথা, সামাজ থেকে দেওয়া কমিটমেন্ট। সম্পর্ক রাখার বিষয়টি হল ব্যক্তিগত কমিটমেন্ট। বিয়ে লোক দেখানো বিষয়; দুই হাজার মানুষ সাক্ষী রেখে বিয়ে করার পরের দিনও ডিভোর্স হতে পারে। আবার কেউ বিয়ে না করে ব্যক্তিগত কমিটমেন্ট দিয়ে যুগ যুগ কাটিয়ে দিতে পারে।

বাঙালির প্রধান অংশ মনে করে বিয়ে মানেই দুটি মানুষের একসাথে বিছানায় রাত কাটানো; নারী শস্য ক্ষেতে পুরুষের লাঙল চালানো; নারী জরায়ুতে সন্তান উৎপাদনের বীজ ফলানো এবং সব শেষে একটি নতুন দায়িত্বের জন্ম দেওয়া- কোলে তুলে নেওয়া ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতক। এটি প্রথাগত ধারণা। আমরা কি কখনো এর থেকে একটু ভিন্ন ভাবতে পারি না?

মানুষ একা থাকতে পারে না; তার সঙ্গি দরকার। পাহাড়ের ভিড়ে উড়ে চলা পাখিদের গল্প শুনাতে, ভোরের সকালে শিশির ভেজা ঘাসে হাঁটতে, মাঠের মাঝে কালবৈশাখী বিকেলে কারো হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে, সুখের মাঝে হাসির অংশ হতে, কষ্টের দিনে পাশে দাঁড়ানোর দেওয়াল হতে একজন মানুষের আরেকজন মানুষ দরকার। প্রাকৃতিক ভাবেই সেই মানুষটি বিপরীত লিঙ্গের হলে মনের মাঝে কিছুটা বাড়তি সুখ পাওয়া যায়। এই ক্ষেত্রেও যৌনতার প্রশ্ন আসে। তবে মনের ভালোবাসার কাছে শারীরিক ভালোবাসা গৌণ।
গত কয়েকদিনে আমরা অনলাইনে দেখেছি রেল মন্ত্রীকে নিয়ে প্রচণ্ড মজা করা হচ্ছে। মন্ত্রীকে নিয়ে অবশ্যই মজা করা যায়। তাই বলে বলে একজন মন্ত্রীর ছবির সাথে যৌন উত্তেজক বিজ্ঞাপনের ছবি দেওয়াটা কি শালীনতা? এটাই কি আমাদের বেশি বুঝা সভ্যতার পঞ্চাশ বছরের শিক্ষা? আমাদের মন্ত্রী কি পালিয়ে বিয়ে করেছেন? জোর খাটিয়ে মেয়ে তুলে এনেছেন? লম্পট সামরিক শাসকের মত একাধিক নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়েছেন? না। এইসবের কিছুই করেন নি। তিনি সামাজিক ভাবে বিয়ে করেছেন।
আমরা বাঙালিরা ইবোলার মত কোন ভাইরাসে ক্রমাগত বিকৃত হচ্ছি। পরিবর্তনশীল আধুনিক সভ্যতা থেকে আমরা হেঁটে চলছি বিকৃত কোন গ্রহে। আমাদের কাছে সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র-ধর্ম-মানবতার সংজ্ঞা সব বিকৃত হয়েছে; এমনকি আমাদের কাছে যৌনতাও বিকৃত। নেলসন মেন্ডলার নব্বই বছর বয়সে গার্লফ্রেন্ড দেখে আমরা তালি দিতে পারি কিন্তু নিজেদের মন্ত্রীর সামাজিক বিয়েতে বলছি, “ভাই মন্ত্রী সাহেবের আজকে রাতে কি ভায়াগ্রা লাগবে?”

২) ঘটনা- এক, সাজানো গুছানো অনুষ্ঠান, বলিউড সেলেব্রেটিদের মহাড়ম্বর, সব মিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে অমিতাভ বচ্চনকে ‘লাইফ টাইম এচিভম্যান্ট এ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়। পুরুস্কার নিয়ে অমিতাভ বচ্চন দর্শক সাড়িতে ফিরে এলেন। পাশেই ছিল পুত্র অভিষেক ও স্ত্রী জয়া বচ্চন। বলিউডের ঈশ্বর অমিতাভ বচ্চন তার জীবনে আরও একটি সেরা পুরুস্কার পাওয়ার খুশিতে দর্শক সাড়িতে ফিরে স্ত্রী জয়াকে চুমু খেয়ে বসলেন। বিষয়টি দেখে পাশে বসে থাকা পুত্র অভিষেক খুশিতে আত্মহারা। অমিতাভ বচ্চনের ভাষায় ঠোঁটে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া অশ্লীলতা নয়।

ঘটনা- দুই, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের একজন মিশেল ওবামা। মিশেল এক সাক্ষাৎকারে বারাক ওবামার সাথে তার প্রথম চুমুর অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছিল। তবে আমার কাছে মিশেলের এই সাক্ষাৎকার কোন ঘটনাই না। লোক-সমুখে, জনসভায় পৃথিবীর প্রধান শক্তিধর প্রেসিডেন্ট ওবামা মিশেলের ঠোঁটে চুমু খেয়েছে এমন ডজন খানেক ভিডিও ইউটিউবেই পাওয়া যায়।

ঘটনা- তিন, ইংল্যান্ডের বর্তমান রাজপুত্রের নাম প্রিন্স উইলিয়াম। তার সাথে বিয়ে হয় অভিনেত্রী কেট মিডলটনের সাথে। বিয়ের কয়েকদিন পর রিসেপশনে লক্ষ্য জনতা, কয়েক শত টিভি চ্যানেলের সামনে দুই জনে অসংখ্য বার ওষ্ঠ চুম্বনে আবদ্ধ হয় ইংল্যান্ডের বর্তমান রাজপুত্র এবং রাজরানী; যা আমরা সবাই টিভিতে স্পষ্ট দেখেছি।

ঘটনা- চার, গত বছর চট্টগ্রামের ওয়াসাতে হেফাজতের আন্দোলনের সময় আমার এক বন্ধু তার প্রেমিকাকে নিয়ে জিসি মোড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। আচমকা কিছু মধ্যযুগীয় আন্দোলনকারী এসে তাদের প্রচণ্ড হেনস্থা করে। প্রকাশ্যে চুমু দেওয়ার অপরাধে নয়। রাস্তায় মেয়ে নিয়ে হাঁটার অপরাধে।
পশ্চিম বঙ্গ বেড়াতে গিয়ে থেকে তাদের মাঝে অন্যরকম প্রেম ভালোবাসার সংজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পেয়েছিলাম। যা আমার বাংলাদেশে বিন্দু মাত্রও নেই। ভারত এবং অন্য কয়েকটি দেশ না দেখলে ভালোমত বুঝতেই পারতাম না আমরা অন্ধকারে আছি। মধ্যযুগের সংস্কৃতি আমাদের মাথায় অভিশাপ হয়ে বসে আছে। ঘুষ নিয়ে বড়োলোক হওয়া সম্মানের, রগ কাঁটা বীরত্বের; কিন্তু প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া সমাজে এক কঠিন অপরাধ।

আমি প্রকাশ্যে চুমুর দাবীর পক্ষে। প্রকাশ্যে চুমুর দাবীকে অনেকে হয়তো বলবে এটি বাঙালি সভ্যতার বিরোধী। তবে মনে হয় এই দাবী তারাই করতে পারে যারা সভ্যতার সংজ্ঞায়নে দুর্বল। সভ্যতা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। স্থির কোন সংজ্ঞা সভ্যতার হতে পারে না। তিন’শ বছর আগে বারো বছরের মেয়ে বিয়ে দেওয়া ছিল বাঙালি সভ্যতা। দুই’শ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর বউকে জীবন্ত আগুনে পুরে মারা ছিল হিন্দু সভ্যতা। এক’শ বছর আগে মুসলমান মেয়েদেরকে ঘর থেকে বের হতে না দেওয়া ছিল মসুলমান সভ্যতা। উপরের তিনটি উদাহরণের মধ্যে যে কোন একটি এখন কেউ পালন করতে গেলে সেই সভ্যতার উত্তর পুরুষরাই ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবে।

সভ্যতার কোন স্থির সংজ্ঞা নেই। সভ্যতা দেশভেদে, সমাজভেদে, ধর্মীয় শাস্ত্রভেদে ভিন্ন। আধুনিক সভ্যতার কাছে চুমু খাওয়া অশ্লীলতা নয়, অশ্লীলতা চুমুকে অশ্লীল মনে করা। পশ্চিমে অ্যামেরিকা, পূর্বে চীন জাপানে, উত্তরে ইউরোপে, দক্ষিণ পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় কোথাও চুমু অশ্লীলতা নয়। চুমু অশ্লীলতা বাঙলাদেশে, ভারতের কম উন্নত প্রদেশে, বর্বর পাকিস্তানে, অশিক্ষিত আফ্রিকায়, এক বইয়ের পাঠক দলের মধ্যপ্রাচ্যে।

বাঙালিদের ইতিহাসে আজ প্রথম চুম্বন আন্দোলন হয়েছে। কলকাতায় রাস্তার মোড়ে পরস্পরকে জাপটে ধরে চুমু খাচ্ছে একপাল তরুণ-তরুণী। মুখে স্লোগান ‘আমার শরীর আমার মন, দূর হটো রাজশাসন।’ অভিনব আন্দোলন দেখে সমাজতাত্ত্বিক অভিজিত মিত্র বললেন, “আমাদের দেশে প্রকাশ্যে থুতু ফেললে, প্রস্রাব করলে, মলত্যাগ করলে কারও আপত্তি নেই; প্রকাশ্যে চুমুতে আপত্তি! দোষ কী চুম্বনে, নাকি দৃষ্টিভঙ্গিতে?”

২০১১ সালে ফেসবুকে প্রথম মুক্তমত আন্দোলন গড়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম “আমরা সত্য কথা বলি তাই আমরা বেয়াদব” নামের একটি পেইজ। সেই পেইজের এক লেখায় একটি দাবী ছিল, “চুমু দেয়ার অভয়ারণ্য হোক প্রতিটি উদ্যান, প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি রেস্তোরাঁ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি প্রেমিক-প্রেমিকার চুমু খাওয়ার দৃশ্য। ভালোবাসার সবচেয়ে সুন্দরতম ক্ষণ মনে হয় এই চুম্বন। নষ্ট হোক সমাজের লক্ষ্য বাঁকা চোখে, দূর হোক সংকীর্ণতা। সব বক্রতা পরিহার করে ভালোবাসার জন্যে মুক্ত হোক আমাদের চিন্তা, আমাদের চারপাশ। সব প্রেমিক-প্রেমিকার ঠোঁটে নির্ভয়ে জ্বলে উঠুক ভালোবাসার স্ফুলিঙ্গ।”
শেষ করছি আক্তারুজ্জামান আজাদের কবিতা দিয়ে-

টিভি ভর্তি যৌনতা?
উহা তো সিনেমা!
কাগজভর্তি যৌনতা?
উহা তো কবিতা!
ক্যাসেটভর্তি যৌনতা?
উহা তো সঙ্গীত!
বিলবোর্ডভর্তি যৌনতা?
উহা তো বিজ্ঞাপন!
ক্যানভাসভর্তি যৌনতা?
উহা তো পেইন্টিং!
পাথরভর্তি যৌনতা?
উহা তো ভাস্কর্য!

সমগ্র পৃথিবীর খাঁজে-ভাঁজে মাংসে-অংশে পাহাড়ে-নহরে উদ্যানে-বিদ্বানে যৌনতা?
উহা যে শিল্প,
উহা যে আর্ট,
উহা যে আর্টেরই পার্ট!
যদি বলি–
এসো, হাত ধরো, উত্তাপ যোগাও, চার ঠোঁট ঐক্যবদ্ধ করো,
একপ্রস্থ চুমু খাও,
মাতো উদ্বাহু অধরসঙ্গমে?
উহা তো অশ্লীলতা!
উহা তো অসভ্যতা!

নাকের ডগায় উপর্যুপরি যৌনতার অদৃশ্য মুলা ঝুলানো শিল্প, একদফা চুম্বন চরিত্রহীনতা!

৩) যৌনতা সবার মৌলিক অধিকার। তবে যৌন সম্পর্ক না করেও মনের ভালোবাসার মাঝে প্রেমের সম্পর্ক সুন্দর হয়। মন থেকে ভালোবাসাকে দেহতে ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজন যৌনতার। সেই যৌনতায় দূর থেকে একটু উঁকি দেওয়ার নাম চুমু।
[সংকলিত]


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন