সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

‘নচিকেতার’ ট্রাজিক গান ও আমাদের বয়স্ক (সিনিয়র সিটিজেন)-দের জীবন বৃত্তান্ত ! # ১২২

‘নচিকেতার’ ট্রাজিক গান ও আমাদের বয়স্ক (সিনিয়র সিটিজেন)-দের জীবন বৃত্তান্ত ! 
২০০০-০১ সনে বৃটেনে প্রশিক্ষণে থাকাকালীন একটি ‘এলডার হোম’ দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে বসবাসকারীদের জন্যে নানাবিধ সুযোগ সুবিধার পরও বয়সের ভারে ন্যুজ নানা মানুষের কষ্ট-বেদনা আমাকে দারুণভাবে পীড়িত ও বিস্মিত করেছিল। মনে করেছিলাম, এই দিক নিয়ে অন্তত আমরা পশ্চিমাদের চেয়ে উৎকৃষ্টতর এ জন্যে যে, এখনো আমরা আমাদের মা-বাবা-দাদা-দাদীকে আঁকড়ে রাখি পরিবারে পরম যত্নে। নাতি-পুতি নিয়ে আমাদের বুড়োরা এখনো আনন্দ আহ্লাদ করে এ ক্ষয়িষ্ণু সমাজ আর পরিবারে। সাম্প্রতিক ভারতীয় জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ‘স্টার প্লাসে’র জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আপকা কাচারী’তে প্রায়ই দেখা যেত, বৃদ্ধ অসহায় মা-বাবা হাজির হচ্ছেন ‘কাচারী’তে সন্তানের বিরুদ্ধে কথিত ভরণ-পোষণ ও দুর্ব্যবহারের প্রতিকারের জন্যে। বিষয়টি ব্যক্তি মানুষ হিসেবে দারুণ ভাবে পীড়িত করে আমায়! মনে মনে পুন. প্রতিজ্ঞা করি, একসময় টাকা হলে একটি বড় আকারের স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘এলডার হোম’ প্রতিষ্ঠা করবো, যেখানে কৃষি খামারে কাজ করে অসহায় বুড়োরা নিজেদের অফুরন্ত আর ক্লান্তিকর সময় কাটাবে, আর যাপন করবে অন্তত কিছুটা স্বাধীনতা আর আনন্দে কাজের মাধ্যমে!

পত্রিকা ও নানা মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে কৌতুহলবসত একদিন হাজির হলাম গাজীপুরের হোতাপাড়ার মনিপুর বাজার সংলগ্ন  ‘বয়ষ্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে’। গ্রিভেন্সী গ্রুপের মননশীল চেয়ারম্যান ও এমডি খতিব আ. আজিজ মুকুল পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে যে কোন মানুষ প্রথমে বিষ্ময়ে কিছুটা হতবাক না হয়ে পাড়বে না এ জন্যে যে, এদেশে অর্থ দিয়েও যেখানে সচরাচর ‘ভাল’ তথা প্রাপ্য সার্ভিস আদায় করা যায় না, সেখানে সম্পূর্ণ দাতব্য খাতে পরিচালিত সমাজের লাঞ্ছিত আর অবহেলিত একটি শ্রেণির জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠানটির চমৎকার ব্যবস্থাপনা দেখে প্রকৃতিপক্ষেই সচেতনতার বিবেককে নাড়া দেয়। ১৯৮৭ সনে প্রথমে উত্তরায় ভাড়া বাড়িতে স্থাপিত হলেও, পরবর্তীতে ১৯৯৪ সনে অনেকটা দুর্গম বিশিয়া-কুড়িবাড়ী এলাকায় ৭২ বিঘা জমির উপর আধুনিক স্থাপত্যের ৩টি ৫-তলা ডর্মেটরী টাইপ আবাসিক ভবন ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটিতে গড়ে তোলা হয়েছে বয়স্কদের জন্যে আধুনিক ডাক্তার ও ঔষধপত্র সমৃদ্ধ চিকিৎসালয়, হাঁটাচলার জন্যে বাগানের মধ্যে পাকা সর্পিল আঁকাবাঁকা পথ, প্রার্থনার জন্য মসজিদ, মৃত পরবর্তী কার্যক্রমের জন্যে একই কম্পাউন্ডে যথাক্রমে মুসলিম, হিন্দু, খৃস্টান ও বৌদ্ধদের করবস্থান, চলাচল অযোগ্যদের জন্যে ‘সিক হোম’, বসার স্থান ইত্যাদি। বয়স্ক মহিলাদের থাকার জন্যে নির্মাণ করা হয়েছে আলাদা একটি পাকা ভবন। 

এ ছাড়াও ৫টি পুকুরে মাছ চাষ, ধান চাষ ও পুরো কম্পাউন্ডে পেয়ারা, কুল, নারিকেলসহ নানাবিধ ফলবান বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে। যার ফল-ফসল মূলত বসবাসকারী অসহায় বৃদ্ধদের মাঝেই ভাগ করা হয়ে থাকে। বিনোদনের জন্যে আছে পত্রিকা, লাইব্রেরী, টিভি-রেডিও এবং সামান্য পরিসরে খেলাধুলার ব্যবস্থা। কেন্দ্রটিতে সুপার, ডাক্তার, নার্স, হোস্টেল সুপার, পরিচারক, পাচক, আয়া ইত্যাদি জনশক্তি রয়েছে নানাবিধ কাজের জন্যে। সমন্বয়ের জন্যে আছে ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ে সমন্বয়কারী, সহকারী এবং প্রোগ্রাম অফিসার। মো. আবু শরীফ সুপার হিসেবে বসবাসকারীদের কাছে বেশ প্রিয়। কেন্দ্রটি বেশ পরিচ্ছন্ন এবং সকল কাজই রুটিন মাফিক। খাবার ইত্যদিও বয়স ও রোগ ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে পরিবেশন করা হয়। ১৯৯৫ সনে মহিয়সী মাদার তেরেসা কেন্দ্রটিতে আগমন করেন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ ছাড়াও দেশ বিদেশের নানা পর্যায়ের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের আগমন ঘটেছে কেন্দ্রটিতে, যাদের প্রত্যেকের হাতে রোপিত হয়েছিল কমপক্ষে একটি বৃক্ষ। অসহায় প্রবীণদের বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসাসহ সকল সুবিধা সমৃদ্ধ এর অপর একটি শাখা আছে রাঙ্গামাটিতে। রাঙ্গামাটিতে এ জন্যে সম্ভবত করা হয়েছে যে, নানা উপজাতীয়দের মধ্যে বহুবিধ কুসংস্কারের অন্যতম একটি হচ্ছে বয়স্ক বৃদ্ধাদের ‘ডায়নী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পিটিয়ে হত্যা করা। এ কেন্দ্রটির মাধ্যমে অন্তত নিজ ভূমে ‘ডায়েনী’ হিসেবে গণপিটুনিতে হত্যার হাত থেকে বাঁচবে অসহায় বৃদ্ধারা! 

জানা গেল, খতিব মুকুল যখন ১২ বছর বয়সী কিশোর তখনই গ্রামের এক অসহায় মহিলার প্রতি তার সন্তান ও বৌয়ের নির্মম অনাচারের দৃশ্য তাকে এমন একটি সেন্টার প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আধুধাবীতে ভোর ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত ‘রক্ত-ঘামের অর্থে’ দেশে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় যথকিঞ্চিৎ সাফল্য এলে খতিব মুকুল তার কৈশোরে লালিত স্বপ্ন তথা প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন করেন বর্ণিত কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরই নিজের বিয়ের থেকেও অগ্রাধিকার দিলেন ‘বয়স্ক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার’। কেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে প্রায় ২৪ বছর যাবত। নানা ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিষ্ঠাতা মুকুল নিজে এ সংক্রান্ত সেল ফোন ধরেন, বয়স্ক হোমের যে কোন তথ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে। সপ্তাহের ৩-দিন তিনি কাটান কেন্দ্রে আশ্রিত সিনিয়র সিনিজেনদের সঙ্গে। প্রতিদিন ফোনে অন্তত একবার খবর নেন কেন্দ্রটির ভাল মন্দের। জনাব খতিবের মৃত্যুর পরও যাতে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রটি পরিচালিত হতে পারে, এ জন্যে তিনি একটি ‘ট্রাস্টি বোর্ড’ গঠন এবং ভোগড়া, জয়দেবপুরে তাঁর ক্রয়ক্রত ৩-বিঘা জমির উপর ৫৭ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছেন বলে জানালেন। যাতে বর্ণিত ভবনের আয়ে সকল প্রতিকুলতা কাটিতে কেন্দ্রটি চলতে পারে তার অবর্তমানেও অনন্ত কাল পর্যন্ত।

কেন্দ্রটি ঘুরে দেখা গেল, এক সময়ে সমাজ ও পরিবারে প্রচন্ড প্রতাপশালী কিন্তু চলমান কষ্টকীর্ণ সময়ে নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত ১০০ বয়স্ক মহিলা ও ৮৪ জন পুরুষ অবস্থান করছেন এ আশ্রয় কেন্দ্রে। ১২০০ ধারণ ক্ষমতার কেন্দ্রটিতে মাত্র ১৮৪ আবাসী অবস্থানের কারণে প্রতিষ্ঠাতা খতিব মুকুলসহ এ লেখকও আনন্দিত এ জন্যে যে, ১৬-কোটি মানুষের সমস্যা সঙ্কুল এদেশে এখনো বৃদ্ধ নিবাসে বসবাসের জন্যে স্রোতের মত মানুষ আসছে না। বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকার নানা জাত আর বর্ণের মানুষ এরা। ধর্ম, বর্ণ, চেহারা, শিক্ষা, প্রাক্তন পেশা ইত্যাদিতে কারো সঙ্গেই অপরের মিল না থাকলেও, অসহায়ত্ব, শ্রান্তি এবং বয়সের ভারে ন্যুজতায় দিক দিয়ে ‘ট্রাজিক ঐকতান’ প্রায় প্রত্যেকের মধ্যে। কারো ছেলে-মেয়ে নেই, কারো থাকলেও তারা বয়স্ক বাবা-মার খোঁজ না নিয়ে অবস্থান করছেন ইউরোপ আমেরিকায়। দেশেও কেউ কেউ ভাল অবস্থানে থাকলেও, মা-বাবাকে আশ্রয় দিতে রাজি নন, যার মর্মকথা বর্ণিত হয়েছে ‘নচিকেতার’ ট্রাজিক তন্ত্রী ছুঁয়ে যাওয়া ‘‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্লাটে যায়না দেখা এপার-ওপার’’ গানে। ৬০-৭০ উত্তীর্ণ ভাঁজপড়া কুঁচকানো চামড়ার ফাঁকে অনেকেই ঢেকে রেখেছেন নিজ কষ্ট আর বেদনাক্লিষ্ট ক্ষতকে, ব্যর্থ চেষ্টা করছেন ক্লান্তিকর হাসির। অনেক বয়স্কই আশ্রয় কেন্দ্রে আগতদের প্রশ্নের জবাবে ‘ভাল আছি’ বললেও, স্বজনহীন একটি ‘আপাত সুন্দর পরিবেশে’ সত্যিই কি তারা ভাল আছে? বসবাসকারী প্রায় প্রত্যেকটি নরনারীর দীর্ঘশ্বাস তার হারানো সন্তান আর স্বজনদের জন্যে, যারা তাদেরকে নিতান্তই ‘ঝামেলা’ হিসেবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে, তাদেরই কষ্টে, শ্রমে বানানো নিজস্ব ‘সুইট হোম’ থেকে।

কারো কারো ছেলে-মেয়ে, বোন কিংবা নিকট আত্মীয়রা দেখা কিংবা খোঁজ খবর নিতে আসেন কালেভদ্রে। কেউবা ঈদে পার্বনে কখনো পুরণো ফেলে আসা বাড়িতেও যান কখনো-সখনো। কিন্তু অনেকেই বিমর্ষ সেখানে মৃত্যু চিন্তা আর পরিত্যাগকারী স্বজনদের জন্যে, পুরণো দিনের হিসেব খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত শ্রান্ত কেউ কেউ। অথচ এরাই এক সময় তার প্রিয় সন্তানদের নানা প্রতিকুলতায় আগলে রেখে সমাজে বড় করেছিলেন ভবিষ্যতের জন্যে। আশ্রমে বসবাসকারী সকল মা-ই নিজের সুখ স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে নিজ সন্তানকে প্রতিপালনে নিজের জীবন-যৌবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, সন্তানের স্কুলের পাশে কিংবা ফুটপাতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছিলেন ছুটির জন্যে, সন্তানের ভাল ফলাফলের জন্যে। কিন্তু সে সন্তানরা এখন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজ স্ত্রী, সন্তান আর নিজেদের নিয়ে বিভোর নানাবিধ সুখ স্বপ্নে।

প্রতিষ্ঠাতা খতিব মুকুলের সাদামাটা বক্তব্য হচ্ছে, ‘‘একজন প্রকৃত মানুষ নিশ্চয়ই তার বাবা-মা’র প্রতি দায়িত্বশীল থাকে। আসুন, আমরা সবাই সত্যিকারের মানুষ হই’’। জনাব মুকুল বৃদ্ধাশ্রম চাননা, বরং তিনি চান, ‘‘দায়িত্ববান সন্তানের কাছে পরিবারের অন্যতম সদস্য হয়ে বেঁচে থাকুন পিতা-মাতা, দাদা-দাদী। বুক উঁচু করে বেঁচে থাকুক সেই সব সন্তান, যারা তাদের পিতা-মাতাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এতো টুকুও সম্মানহানী না করে, কষ্ট না দিয়ে তাদের আগলে রাখে’’। আমরা কি মুকুলের অনুকরণে আমাদের অসহায় মা-বাবা, দাদা-দাদীকে নিজ পরিবারে একটু ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখতে পারিনা তাদের অসহায় সময়ে? যারা আমাদের জন্যে কত কষ্টই না স্বীকার করেছিল তাদের কর্মময় স্বাপ্নিক সময়ে? জনাব মুকুলের মতো এ লেখকও চাননা এ দেশে এভাবে বৃদ্ধ নিবাস বেড়ে উঠুক বরং তার আশা আস্তে আস্তে মুকুল প্রতিষ্ঠিত বয়স্ক কেন্দ্রে বসবাসকারীর সংখ্যা ১৮৪ থেকে শূন্যে নেমে আসুক! প্রত্যেকে ফিরে যাক তার নিজ বাসভূমে এবং বসবাস করম্নক তার ভালবাসার আনন্দ বেদনার চিরচেনা পরিবেশ আর পরিবারের মাঝে!!!

গোধূলির প্রাক্কালে পড়ন্ত বিবর্ণ বিকেলে যখন বৃদ্ধ নিবাস ছেড়ে ফিরতে যাচ্ছি ঢাকার দিকে নিজ বাসভূমে, কাকতালীয়ভাবে পাশের ছোট রেস্টুরেন্ট কাম চায়ের দোকানে মনটা মোচড় দিয়ে বেজে উঠলো ‘নচিকেতার’ ট্রাজিক তন্ত্রী ছুঁয়ে যাওয়া ‘‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্লাটে যায়না দেখা এপার-ওপার’’ গানটি। গাড়ির সিটে পেছনে তাকিয়ে দেখি, বাইরের ক্লান্তিকর ঘুঘু ডাকা সেগুন বনে দৃষ্টি প্রসারিত আমার ৩-স্বজন সহযাত্রীর চোখ নোনাজলে আপ্লুত! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন