সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আম্বুজা সিমেন্টের গাঁথুনী ও আওয়ামী লীগের ‘বেইস’ # ১৪১

আম্বুজা সিমেন্টের গাঁথুনী ও আওয়ামী লীগের ‘বেইস’ 
কিছুদিন থেকে জনপ্রিয় স্যাটেলাইট চ্যানেল ‘স্টার প্লাসে’ একটি চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দেখানো হচেছ এভাবে, দু’টো বিবাদমান গ্রুপ একটি দেয়াল ভাঙার জন্যে বড় হ্যামার, দা, কুড়োল, খন্তা, শাবল, গাইতি ইত্যাদি দিয়েও দেয়ালটি ভাঙতে না পেরে, বড় একটি কনক্রিটের বড় ‘পিলার’ (এদেশীয় বহুল আলোচিত ‘খাম্বা’ টাইপ!) দিয়ে সম্মিলিতভাবে ‘আঘাত’ করেও যখন দেয়ালটি ভাঙতে ব্যর্থ হন, তখন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত-ঘর্মাক্ত-পরাজিত দলপতির হেঁড়ে গলায় প্রশ্ন, ‘‘ইয়ে দেওয়ার কিউ নেহী টুটতাহে’’? (এ দেয়াল ভাঙছে না কেন?) সচকিত ও সম্মিলিত কোরাসী জবাব, ‘‘এটি আম্বুজা সিমেন্টে তৈরী যে’’! প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় আম্বুজা সিমেন্টের গুণাগুণ কিংবা মান সম্পর্কে লেখকের জানা না থাকলেও, বিজ্ঞাপনটি দেখার পর থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর ‘ভিত’ তথা ‘বেইস’ সম্পর্কে লেখকের চিন্তনে দেখা দিয়েছে চমকপ্রদ সব ‘আম্বুজা সিমেন্ট বিষয়ক প্রশ্ন’। মানে এদেশের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক দলটি গঠন এবং তাকে ‘আম্বুজীয় পদ্ধতিতে’ বার বার ভাঙার প্রাণান্তকর ‘সিলসিলা’, যা পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করার তীব্র ইচ্ছে লেখকের!

বাংলাদেশের অনেক পুরণো গণতান্ত্রিক দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রের জন্যে দলটি সব সময়ই লড়াই করেছে ক্লান্তিহীনভাবে, যদিও পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ‘বাকশাল’ গঠনকে বিরুদ্ধবাদীরা ‘গণতন্ত্রের হত্যাকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বার বার প্রচারণা এবং ঐ সময়ে একদলীয় ‘বাকশাল’ গঠন নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে নানাবিধ মত দৃশ্যমান হলেও, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এদেশের কোমল মাটিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক ‘ভিত’-কে শক্ত ও মজবুত করার জন্যে। জন্মের পর থেকেই দলটির ‘ভিত’ তথা ‘বেইস’কে নড়বড়ে করার নানাবিধ অপচেষ্টা এদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে কাল আর সময়ের পেন্ডুলামে অসংখ্যবার। ৫৪-তে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করেও ক্ষমতায় খুব বেশীদিন থাকতে পারেনি আওয়ামী লীগ। ৭০-এ ইতিহাস সৃষ্টিকারী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও দলটিকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হয়নি ইচ্ছেকৃতভাবে। কেবল আওয়ামী লীগ ছাড়া পাকিস্তানের অন্য যে কোন দল এতো ‘ভূমিধ্বস’ আসন পেলে, অবশ্যই, সে দলটিকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হত না কি! ৭৩-এ আবার বিপুল ভোটে জয়ী হয় দলটি। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই পচাত্তরে দলটির ‘মেইন-পিলার’ বঙ্গবন্ধুসহ প্রধান নীতিনির্ধারক ব্যক্তিত্বগণকে নির্মমভাবে হত্যা করে দলটির বেইস, ভিত্তি, ফাউন্ডেশন তথা ‘প্লিন্থ’ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়া হল এফেঁাড়-ওফেঁাড় করে। আর বর্ণিত মারাত্মক ক্ষতগুলো শুভাকাংখিরা যাতে ‘মেরামত’ করতে না পারে, এ জন্যে বেঁচে যাওয়া নেত্রীবৃন্দের কাউকে করা হলো ‘বন্দী’ কিংবা ‘দেশান্তরী’। 

কিন্তু এ নরম কর্দমাক্ত মাটিতেও শক্ত এদেশীয় মজবুত ‘আম্বুজা’ সিমেন্টে গড়ে ওঠা ‘বেইস’কে যখন আক্রমনকারীরা একটুও টলাতে পারল না, তখন অব্যাহতভাবে নানা প্রপাগান্ডার ‘হ্যামার’, ‘শাবল’, ‘গাইতি’ চালাতেই থাকলো দীর্ঘ সময় ধরে। যে কারণে একাত্তর ও পচাত্তর পরবর্তী জন্ম নেয়া একটা প্রজন্ম ‘মাইন্ড সেট আপে’ প্রবলভাবে ধারণ করলো আওয়ামী বিদ্বেষী মনোভাব। আর পচাত্তরের আক্রমনকারী ও আপাত সফল গোষ্ঠীটিকে চাকুরী, অর্থ, প্রশাসনিক ও অন্যবিধ সহায়তা আর ইনডেমনিটি দিল সুবিধাভোগী পক্ষটি। গড়া হল ‘ফ্রিডম পার্টি’ নামক ফ্যাসিস্ট দল, যাদের কাজই ছিল আওয়ামী ফাউন্ডেশনে অব্যাহত আঘাতের পর আঘাত করা! এভাবে এ সবুজ স্বাধীন নরম মাটির বাংলাদেশে আওয়ামী পরিবারের উপর ক্রমাগত ‘হ্যামার’ চালনা অব্যাহত রাখল একাত্তরের পরাজিত শক্তি, পচাত্তরের খুনী চক্র, মাইন্ড সেট আপে’ বিকৃত ইতিহাস ধারণকারী ও লালনকারী গোষ্ঠী এবং পচাত্তর পরবর্তী সুবিধাবাদী চক্র। কিন্তু বেইস ভাঙতে পারলো না শত্রুরা বরং বিকৃত হ্যামারিং-এর জবাব স্বরূপ জনগণ ৯৬ ও ২০০৮ এর নির্বাচনে চরমতম বিজয়ে দেখিয়ে দিল দলটির ভিত নতুন ‘সিমেন্ট বালি’র প্রলেপ দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে আরো শক্ত করে দিল এর ‘ভিত’কে।

পচাত্তরে মরণঘাতী মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্রের আঘাতেও যখন এর গাঁথুনীকে টলানো গেলনা বরং জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসুরী এসে যখন এর ফাউন্ডেশনে যোগ দিলেন ভিতকে আরো মজবুত করার প্রত্যয়ে, তখন ধ্বংস প্রত্যয়ীগণ এবার সরাসরি আঘাত করলো উত্তরসুরীর ‘কনক্রিট পিলারে’ মারাত্মক আর্জেস ‘গ্রেনেড’ দিয়ে, মূল ভিতেই চালালো মারাত্মক শাবল আর হ্যামার। কিন্তু বর্ণিত সুনামীতে আইভি রহমানসহ কয়েকটি পিলার ধ্বংস তথা ২৪-জনের প্রাণহানী ঘটলেও, ভিত রয়ে গেল প্রায় আগের মতই অক্ষত। তারপরও ধ্বংসের চেষ্টা চললো ধারাবাহিক, নিরলস আর অব্যাহতভাবে। দলীয় নেতা কর্মীদের উপর চললো সপ্তপদী জুলুম, অত্যাচার, লুটপাট আর সাঁড়াশি আক্রমন। মূল ‘প্লিন্থ’ নেত্রীকে করা হল গ্রেফতার, মামলা আর বিষ প্রয়োগে হত্যার ষড়যন্ত্র! কিন্তু আবার কৃষক-শ্রমিক জনতা ২০০৮-এ এসে তাদের সঞ্চিত ‘ভোটের সিমেন্ট ব্যাগ’ খুলে সব ঢেলে দিল এর পুরণো ফাউন্ডেশনে! কিন্তু নতুন সিমেন্টে ‘বন্ড’ ধরার আগেই সারাদেশে ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ ঘটিয়ে সেনা আর বিডিআরকে মুখোমুখো দাঁড় করানো হলো, যাতে এবার মূল ভিতে আঘাত লাগে ‘বিডিআর ভার্সাস সেনাবাহিনী’র অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের কারণে এবং মারাত্মক আকারে! কিন্তু দক্ষ ‘রাজমিস্ত্রী’ ঝড়ের আলামত টের পেয়েই দক্ষতার সঙ্গে ‘বন্ড’ ধরালেন পুরণো গাঁথুনীর সঙ্গে সদ্য-নতুন ঢেলে দেয়া সিমেন্টের! চমৎকার ঐকতানীয় ‘হারমোনির’ সঙ্গে সমাপ্তি টানতে পারলেন বিডিআর বিদ্রোহের। কিন্তু তাতেই কি ‘শাবল আর গাইতী’ বাহিনী থেমে গেল? মোটেও না! 

তারা অব্যাহতভাবে তাদের হাতে রক্ষিত পুরণো সব কুড়োল, শাবল, গাইতী নিয়ে আক্রমন চালাতেই থাকলো আওয়ামী গাঁথুনীতে একের পর এক। তাইতো নেত্রীর অব্যাহত ও নানামুখী প্রচেষ্টা সত্বেও চাল-ডালসহ বাজার দর উঠতেই থাকলো ওপরের দিকে, সারের ভর্তুকির পরও কৃষিপণ্যের দাম আকাশচুম্বী, একাত্তরের রাজাকার আর খুনীদের বিচারের বিপক্ষেও দঁাড়ালো অনেকে সরাসরি কিংবা কিছুটা ঘুরিয়ে, শেয়ার বাজারে অস্থিরতা এলো মারাত্মক আকারে অনেকটা ৯৬-এর মত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান দেশগুলো প্রবাসীদের জন্যে ভিসা বন্ধ করে দিল, যা খুললো না ২-বছরের মাথায়ও, এমনকি নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের স্থান প্রায় জনবিরল ‘আড়িয়াল বিল’ নির্ধারণ নিয়েও শুরু হলো ‘কৃত্রিম আন্দোলন’ নামক নাটকীয় আঘাত। এগুলো সবই একটি মজবুত গাঁথুনীর ভবনের ক্ষতির জন্যে সৃষ্ট ছোট ছোট ভূমিকম্প, সুনামীর মত ছোট-বড় আঘাত কোনটা প্রত্যক্ষ, কোনটি আবার পরোক্ষ কিন্তু থেমে রইলো না তারা মাঠে নামালো হেফাজত, সাথে জামাত-শিবির, আবার আঘাত করতে চাইল মূলে কিন্তু বেইস মজবুত হওয়াতে এবারও  সুনামি মার খেল !

কিন্তু যে দলটির বেইস, ভিত্তি, ফাউন্ডেশন তথা ‘প্লিন্থ’ স্বদেশের মজবুদ খাঁটি ‘আম্বুজা’ সিমেন্টে তৈরী, তাকে কি কাত করে ফেলে দেয়া যাবে অনুমোদন বহির্ভূত ভেজাল সিমেন্টে নির্মিত অবৈধ ৬-তলা বেগুণ বাড়ির কোন ভবনের মত? দীর্ঘদিন ধরে সম্মিলিতভাবে চেষ্টাতো কম করা হয়নি বিভিন্ন এঙ্গেল, কৌশল, অর্থ আর অস্ত্র প্রয়োগে। বর্ণিত ‘আম্বুজা’ সিমেন্টের বিজ্ঞাপনে আঘাত বাহিনী অবশেষে দেয়ালটি ভাঙতে অসফল হয়ে প্রলাপোক্তি করতে করতে বিধ্বস্ত ও পরাজিত সৈনিকের মত মাটিতে বসে পড়লেও, আমাদের এদেশীয় দাউদকান্দির মৃত ‘ঘুণ পোকা’ খন্দকার  সাহেবের ‘দোয়া-সহবত’পুষ্ট আঘাত বাহিনী কিন্তু ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়েছে বলে ভবিষ্যত বক্তাগণ দেখছে না তাদের অন্তরের রাডারে, বরং আঘাতকারীরা কি নিয়ে আসতে পারে না, তাদের ব্যবহৃত প্রচলিত অস্ত্রের চেয়েও মারাত্মক কোন অত্যাধুনিক সুনামী শ্রেণীর আরো জীবনঘাতী মারণাস্ত্র? মজবুত ভিতের আওয়ামী লীগের কি প্রস্ত্ততি আছে তা মোকাবেলার? তাদের কি হাতে আরো পর্যাপ্ত খাঁটি সংরক্ষিত সিমেন্ট আছে, যা ঢেলে ‘প্লিন্থ’-কে আরো শক্ত ও মজবুত করা যাবে? দলটির দক্ষ ‘রাজমিস্ত্রী’-কে ঐ কাজে সহায়তা আর যোগান দেয়ার জন্যে দঁাড়িয়ে আছে লক্ষ-কোটি রাজ ‘জুগালী’! যারা তার ডাকের প্রত্যাশায় সিমেন্ট, বালি আর নুড়িপাথর নিয়ে অধীর অপেক্ষায়! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন