শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

পাকিস্তান ভার্সাস বাঙলাদেশ ২০১৪ ! বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের : ৭১



পাকিস্তান ভার্সাস বাঙলাদেশ ২০১৪ !
বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের
উন্নয়নের সব সূচকে পাকিস্তান থেকে এগিয়ে বাঙলাদেশ !!!

স্বাধীনতার আগে এই ভূখণ্ডের মায়েরা গল্প শোনাত তাদের শিশু সন্তানদের, ‘আমাদের আরেকটি ভূখণ্ড আছে, তার নাম পশ্চিম পাকিস্তান। সেখানে শিক্ষিত সাহেবরা থাকেন। তারা সুন্দর সুন্দর গাড়িতে চড়েন আর বড় বড় বাড়িতে বাস করেন। তারাই আমাদের শাসক।’ স্বাধীনতার চার দশক পর গল্পটা বদলে গেছে। এখন পাকিস্তানের মায়েদেরই বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর উত্থানের গল্প শোনাতে হবে তাদের শিশু সন্তানদের।

অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানকে এগিয়ে রাখার জন্য সেই দেশের শাসকরা যে বাংলাকে শোষণ করল, স্বাধীনতা যুদ্ধের চার দশক পর সেই পাকিস্তানের চেয়ে এখন অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে বাংলাদেশ। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। গত চার দশকে অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকেও দেশটিকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।

গত মার্চে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে এই সময়ে পাকিস্তানের ছিল ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স পেয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তান পেয়েছে ৯ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আলোচ্য সময়ে যেখানে পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি ২০ বিলিয়ন ডলার, সেখানে বাংলাদেশের মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত ২ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অথচ পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে চলতি হিসাবে রয়েছে ঘাটতি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও ছাড়িয়ে গেছে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধিকে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ আর পাকিস্তানের তখন ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই ধারা থেকে পাকিস্তানকে শেখার পরামর্শ দিয়েছে। সিপিডির রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান অস্ট্রেলিয়াতে অধ্যয়নকালীন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিবর্তন সংক্রান্ত একটি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন যেখানে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে, সেখানে পাকিস্তানে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। তারা কোথাও থেমে আছে, কোথাও বা পেছনে হেঁটেছে। এ ক্ষেত্রে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা সৌভাগ্যবান। আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। তৈরি পোশাকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক দেশ এখন বাংলাদেশ। একটি স্বাধীন জাতির যে আকাক্সক্ষা তার সবটুকু পূরণ না হলেও অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকে শুধু পাকিস্তান নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। দেশীয় গবেষণা সংস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়ার কথা উঠে আসছে। লন্ডনের জাতীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির বিচারে পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। জেপি মরগান পাঁচটি অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশের নাম উল্লেখ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে।

কারা এই নেক্সট ইলেভেন? সম্প্রতি গোল্ডম্যান স্যাক্স সম্ভাবনাময় আরও ১১টি দেশের একটি নতুন তালিকা তৈরি করেছে। এ দেশগুলোর অর্থনীতিও এগিয়ে আসছে বলে এদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘নেক্সট ইলেভেন’। এই উদীয়মান ১১টি দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। সংস্থাটি বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেছে, দেশটির বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার বেশির ভাগই তরুণ। এদের মাধ্যমে দেশটির ভবিষ্যৎ বদলে দেওয়া সম্ভব।এ তো গেল অর্থনীতির কথা। স্বাধীনতার চার দশকে সামাজিক সূচকেও পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী ভারতের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে। গত নভেম্বরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি এসিসটেন্স স্ট্রাটেজি প্রগ্রেস রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ প্রত্যাশার চেয়েও বেশি এগিয়েছে। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৯ বছর, ওই সময় ভারতের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর। আর এখন ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ বছর হলেও বাংলাদেশে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ বছর। অন্যদিকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ২২৫ জন, ভারতে ১৬৬ জন। এখন বাংলাদেশে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৬ জনে, আর ভারতে তা ৬৫ জনে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ভারতের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলেও পরিকল্পনা কমিশনের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ যে সামাজিক সূচকে পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে গেছে সেই চিত্রও উঠে এসেছে। গত অক্টোবরে প্রকাশিত পরিকল্পনা কমিশনের ‘সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৬৯ বছর হলেও পাকিস্তানে মানুষের গড় আয়ু ৬৫ বছর। এক বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হার রোধেও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ। দেশে প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যু হার (এক বছরের নিচে বয়স) ৩৭ জনের। অথচ পাকিস্তানে এ হার ৫৯। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যু রোধের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সাফল্য লক্ষণীয়। দেশে এখন পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হার হাজারে ৪৬ জন, যা পাকিস্তানে ৭২। স্যানিটেশনেও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। এখন দেশে ৫৬ শতাংশ পরিবার সঠিকভাবে স্যানিটেশন সুবিধা পায়। অথচ পাকিস্তানে এই হার ৪৮ শতাংশ। দেশে সন্তান জন্মের হারও অনেক কমেছে। ১৯৯০ সালে দেশে সন্তান জন্মের হার ছিল ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সেটি এখন কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশে, যা পাকিস্তানের চেয়েও কম। পাকিস্তানে এখন সন্তান জন্মের হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। সার্কভুক্ত দেশগুলোর ২০১১ সালের তথ্য-উপাত্তের আলোকে এই প্রতিবেদন তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এম কে মুজেরি বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী চার দশকে বাংলাদেশের সামাজিক খাতের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ছিল অনেক বেশি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করেছে এসব সংস্থা। নারীর ক্ষমতায়নেও সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করেছে। সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং বাজেটেও গুরুত্ব পেয়েছে এসব খাত। ফলে গত চার দশকে সামাজিক খাতের বেশ কিছু সূচকে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আর এ বিষয়গুলোই ভারত-পাকিস্তানের মতো দেশগুলোকে পেছনে ফেলতে সহায়তা করেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়া সম্পর্কে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো বিস্মিত। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ যারা স্বাধীনতার প্রাক্কালে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত করেছিল, তারাই আজ বাংলাদেশকে উদীয়মান টাইগার বলে ভূয়সী প্রশংসা করছে। মানব সূচক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা দেখে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশকেও তা অনুসরণ করতে বলেছেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে তাতে ২০২১ সালের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাব আমরা। ২০৩০ সালের মধ্যে এই দেশ হবে ক্ষুধা ও দরিদ্রমুক্ত। আর ২০৫০ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হবে বাংলাদেশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন