সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাঙালির সর্বজনীন উৎসবঃ ঐক্যপূর্ণ জাতিসত্তার রক্ষাকবচ # ১২৯

বাঙালির সর্বজনীন উৎসবঃ ঐক্যপূর্ণ জাতিসত্তার রক্ষাকবচ

পার্ট ১ : অপচয়
 
বাঙালি! অস্ট্রিক, দ্রাবিঢ়, মঙ্গোলীয়, নেগ্রিটো আর মিশ্র নরগোষ্ঠীর এক শঙ্কর সৃষ্টি হলেও, প্রকৃত বিচারে জাতিটি অসাম্প্রদায়িক প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। চর্যা থেকে আজকের বাংলাদেশ পর্যন্ত তারা সব সময়ই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করেছে এবং পরিচয় দিয়েছে কাল পরিক্রমায় সর্বত্রই। বিশ্বের অন্য জাতিগুলোর মত বাঙালিরও ছিল এবং আছে কতগুলো নিজস্ব পার্বণ। এই পার্বণ তথা উৎসব হচ্ছে আদিম মানুষ সৃষ্ট প্রাচীনতম অনুসঙ্গ, যা এ একুশ শতকেও প্রচন্ড দাপটের সঙ্গে টিকে আছে বিশ্বময়! প্রাচীন কৃষিভিত্তিক স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক আনন্দানুষ্ঠানই কালক্রমে ধর্মীয় লেবাসে ভিন্নতা পায় উৎসব হিসেবে। বাঙালি যদিও একটি ভাষাতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক জাতিসত্তা কিন্তু ধর্মীয় ও অন্যান্য কিছু অপ্রধান গৌণ কারণে, এ অভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে শ্রেণি বিভাজন অনেকটাই সুষ্পষ্ট এখন। যার মধ্যে বাঙালির প্রধান ‘উৎসবগুলো’ অন্যতমতো বটেই।

আমাদের দেশটি মাত্র ৫৫,১২৬ বর্গমাইলের লোকে লোকারণ্যের একটি দেশ। যেখানে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় ও ব্যক্তিপর্যায়ে নানা অপচয় আমরা প্রত্যহ লক্ষ করি। যে কারণে এ দেশে কিছু মানুষ ভোগ বিলাসে জীবন যাপন করলেও, কোটি কোটি মানুষ তাদের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা থেকে বছরের পর বছর হচ্ছে বঞ্চিত। বিদ্যুৎ স্বল্পতা সত্বেও আমরা কিভাবে তা অপচয় করছি তা সরকারী অফিসগুলোর বিল পরীক্ষা করলেই দেখা যাবে। সরকারী অফিস বাদ দিলেও ‘সুপার মল’ বা ‘পেট্রোল পাম্প’গুলোতে উৎসবের মত লাইটিং দেখে বোঝার উপায় নেই বিদ্যুতের কারণে অনেক কৃষক তাদের জমিতে ঠিকমত সেচ দিতে পারেনা। কিছুদিন আগে সমাজের উচ্চশ্রেণির প্রতীক বিদেশী ডিগ্রীধারী জনৈক উচ্চবিত্ত ডাক্তারকে মিডিয়াতে বলতে শুনেছি, ‘‘বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সে তার নিজস্ব আনন্দানুষ্ঠানের লাইটিং বন্ধ রাখতে পারেন না, কারণ সে বিদ্যুৎ বোর্ডকে নিয়মিত বিল দিচ্ছেন ও টাকা দিয়ে বাড়িতে লাইন নিয়েছেন’’! পাঠক বিচার করুন আমাদের মানসিকতা!

জমির স্বল্পতা এদেশে সবচেয়ে বেশী প্রকট। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশে ভূমিকেন্দ্রিক মামলার সংখ্যা মোট মামলার ৮৩%। মূলত ভূমির স্বল্পতাহেতু জমি নিয়ে এতো ঝগড়া-বিবাদ মামলা-মোকদ্দমা। এই জমি সংকটের এদেশে হাজার হাজার একর জমি কিভাবে আমরা অপচয় করছি, তার দু’য়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো।

সরকারী পর্যায়ে সারা দেশের কথা বাদই দিলাম, কেবল ঢাকা শহরেই নানা আকৃতি-প্রকৃতি আর আয়তনের ছোট বড় সরকারী অফিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শহরের সর্বত্র। কোনটি পুরান ঢাকায়, আবার কোনটি মতিঝিল, কোনটি আগারগঁায়ে, আবার কোনটি উত্তরায়। কোনটি একতলা, আবার অন্যটি বহুতল বিশিষ্ট। হিসেব করলে দেখা যাবে, সরকারী বর্ণিত অফিসগুলোর জন্যে যে জমি নষ্ট হচ্ছে, তা ঢাকা শহরের যে কোন স্থানে বহুতল বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করলে তাতেই স্থান সংকুলান সম্ভব। অথচ শহরের নানা স্থানে বিক্ষিপ্ত ও নানাভাবে অফিস ধরে রেখে সময়, অর্থ ও জমির অপচয় করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে অনেকগুলো স্টেডিয়াম, খেলার মাঠ, মানিক মিয়া এভেন্যু থাকলেও, কেবল বছরে ১/২ দিন সেনাবাহিনীর ‘প্যারেড’ করার জন্যে সংরক্ষণ করা হচ্ছে পুরনো বিমানবন্দরের পুরো বিমানবন্দরটি ‘প্যারেড স্কোয়ার’ নামে। অথচ ঢাকা শহরে রাতে কয়েক লাখ লোক ঘর-বাড়ি না থাকার কারণে রাসত্মায় ঘুমায়। আমাদের বিবেক বোধ জাগ্রত থাকলে এবং অপচয়কারী না হলে, পুরনো এয়ারপোর্টের ভেতর দিয়ে আমরা গাড়ি চলাচলের জন্যে ৪/৫ রাসত্মা বানাতাম, যাতে ঢাকা শহরের যানজট নামক ‘দৈত্য’টিকে কিছুটা হলেও হালকা করতে পারতাম। ‘সংরক্ষিত এলাকা’ বিধায় যুদ্ধকালীন বা জরুরী অবস্থার সময় ঐ রাসত্মাগুলো বন্ধ রাখা যেত। এ দেশের মানুষের জন্যে বানানো কোন ‘সংরক্ষিত এলাকা’ যদি এদেশের কল্যাণে না লাগে তাকে ‘সংরক্ষণ’ করে লাভ কি?

আরেকটি অপচয়ের চিত্র হচ্ছে আমারদের ‘ঈদগাহ গুলো’। বছরে ২-দিন ঈদের নামাজ আদায় করার জন্যে দেশের সর্বত্র কয়েক লাখ ‘ঈদগাহ’। সবচেয়ে মজার ও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামের মূল জন্মভূমি মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে এমনকি খোদ সৌদি আরবের কোন এলাকায়ই, এমনকি মক্কা বা মদীনায় কোন ‘ঈদের মাঠ’ নেই। মহানবী (স.) এর আমলেও কোথাও মাঠে ঈদের নামাজ পড়া হয়েছে বলে কোথাও উলেøখ নেই। সেখানের সকল মানুষ ফজরের নামাজ শেষেই মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করে। যদিও জমি বা স্থানের অভার সেখানে নেই। কিন্তু আমাদের দেশে জমির মারাতমক স্বল্পতা থাকা সতেবও, এদেশে কিভাবে ঈদের মাঠ এলো তা কিন্তু গবেষণার বিষয়। চিন্তাশীল ও দেশপ্রেমিক মুসলমানদের ভেবে দেখতে হবে, বছরে ২দিন আমরা সংরক্ষিত ঈদের মাঠে নামাজ না পড়ে স্টেডিয়াম বা নিকটবর্তী স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বা খেলার মাঠে নামাজ পড়লে দেশ বা জাতির কি কোন ক্ষতি হবে? আবার খেলার আলাদা স্টেডিয়াম না বানিয়ে ঈদগাহকে বিকল্প মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা তাও চিন্তার দাবী রাখে। মনে হচ্ছে এটি করতে পারলে ক্ষতির চেয়ে উপকারই হবে বেশী। আর হ্যা, ঈদের মাঠগুলো আমরা রাখতেও পারি, সেক্ষেত্রে বছরে ২-দিন ঈদের নামাজ পড়া ছাড়াও এই মাঠগুলোকে আমরা অন্য ধর্মীয় ও সামাজিক কাজেও লাগাতে পারি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়া দিতে পারি। লেখাধুলা বা শাকসবজি উৎপাদনের মত কাজে ব্যবহার করতে পারি। 

একই কথা টঙ্গীর ‘বিশ্ব ইজতিমা মাঠের’ ক্ষেত্রেও। যেহেতু ইসলামে ‘অপচয়’কে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে, অপচয়ের জন্যে পরকালে শাসিত্মর কথা বলা হয়েছে। তাই বলা যায়, আমরা বর্ণিত অপচয় থেকে মুক্ত হতে পারলে মূলত ইসলামকেই অনুসরণ করা হবে। যদিও আমাদের দেশে সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান ও প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার অভাবে দেশপ্রেমিক হিসেবে আমরা এগুলো চিন্তা করা থেকে বিরত থাকি, প্রচলিত ধ্যান ধারণায় গা ভাসিয়ে দেই। কেউ চিন্তাশীল কথা বললে তাকে মানহানীকর নানা অভিধায় ভূসিত করি কিন্তু প্রকৃত মুসলমানের জন্যে দেশপ্রেমই হচ্ছে আবার ‘ঈমানের অঙ্গ’। তাই আসুন সব ধরনের অপচয়ের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হই এবং জনবিষ্ফোরণের এই ছোট্ট মাতৃভূমিকে রক্ষা করি। এ ক্ষেত্রে মুসলিম জনসংখ্যাধিক্কের দেশ হিসেবে মুসলিম ভাইদেরকেই নবী (স.) এর শিক্ষায় অপচয়কে রোধ করার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের কোনক্রমেই শয়তানের বন্ধু বা ভাই হওয়া চলবে না। 

PART 2 :বাঙালির সর্বজনিন উৎসব

মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বাঙালির এখন প্রধান দু’টো উৎসব ‘ঈদুল ফেতর’ এবং ‘ঈদুল আযহা’ এখন অনেকটা জাতীয় উৎসবে রূপ লাভ করেছে। যদিও বাংলাদেশের ঈদ আর মধ্যপ্রাচ্যের ঈদ উৎসব ভিন্নতর নানাবিধ সাংস্কৃতিক কারণে। শাহী ‘ঈদগা’ ইরানী অনুকরণে বাংলাদেশে বিদ্যমান থাকলেও, সৌদি আরবে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। এদেশের মুসলমানগণ বর্ণিত দুটো ঈদ ছাড়াও পালন করে ‘ঈদ-ই-মিলাুদুন্নাবী’ মানে নবী (স.)-এর জন্ম উৎসব, জুমাতুল বিদা, শব-ই-মিরাজ, শব-ই-বরাত, শব-ই-কদর, পবিত্র আশুরা, আখেরী চাহার সোম্বা ইত্যাদি পর্বগুলো, কেবল বর্ণিত দুটো ঈদ ছাড়া বাকি মুসলিম পর্বগুলোর নাম এবং সরকারী ছুটি পালিত হয়না আরব দেশগুলোতে বিশেষ করে সৌদি আরব ও জিসিসিভুক্ত দেশগুলোতে। হিজরী সন অনুযায়ী বর্ণিত উৎসবগুলো এদেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানগণ নতুন জামা-কাপড় কিনে, সরকারী ছুটি ও বোনাস ভোগ করে, পশু কোরবানী করে ও তার মাংস খেয়ে, নিজের ও আত্মীয়দের সঙ্গে ঘরে আনন্দ ভাগাভাগি করে পালন করলেও, অনেক গরিব মুসলমান বর্ণিত ঈদ উৎসবের দিনেও ছেঁড়া জামা গায়ে, সামান্য মাংস বা একটি যাকাতের কাপড়ের জন্যে প্রাণ দেয় দীর্ঘ লাইনে এখনো এ সমাজে! বর্ণিত মুসলিম ধর্মীয় উৎসবে এদেশের  হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীদের ঘরে বসে ছুটি পালন ছাড়া আর তেমন কিছুই করার থাকে না। এই সময়ে তারা অর্থহীন নিরানন্দ ছুটি ভোগ করে। 
এদেশের সনাতম ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি, দুর্গা পূজাকে পালন করে প্রধান উৎসব হিসেবে। যদিও বহুপূর্বে বাংলাদেশের গ্রামের সকল অধিবাসী ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যোগ দিত এ পূজায়, যা বর্তমানে শারদীয় উৎসব হিসেবে পরিচিত। অবাক ব্যাপার, মাত্র ১৬ শতকে মুসলমান সম্রাট আকবরের সময় বঙ্গে দুর্গাপূজার প্রচলন করা হয়। দুর্গার পর হিন্দুদের প্রধান উৎসবের নাম হচ্ছে লক্ষ্মীপূজা। তারপর কার্তিক পূজা, সরস্বতী পূজা, শিবরাত্রি, দোলযাত্রা, হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন, মহালয়া, শ্যামাপূজা আরো কত উৎসব!। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনের স্মরণে পালিত হয় জন্মাষ্টমীর আনন্দ মিছিল। হিন্দুদের বর্ণিত উৎসবাদির সময় এদেশের মুসলমান, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানগণ সরকারী ছুটি উপভোগ করে ক্লামিত্মকর সময় অতিবাহিত করে, ঐসব উৎসবের কোন প্রভাব সাধারণত অন্য ৩ সম্প্রদায়ের লোকের উপর পড়ে না।

গৌতম বুদ্ধ তথা বুদ্ধদেবের জন্ম, গৃহত্যাগ, বুদ্ধত্ব, নির্বাণলাভ ইত্যাদি যে দিনে ঘটেছিল বলে বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে তার নাম ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’। এটি এদেশে হাজার বছরের পুরনো উৎসব, এর অন্য নাম বৈশাখী পূর্ণিমা। এ ছাড়াও বুদ্ধদের অন্যান্য উৎসবগুলো হচ্ছে মাঘী পূর্ণিমা, চৈত্র সংক্রামিত্ম, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা ও আশ্বিনী পূর্ণিমা। বৈশাখী পূর্ণিমার বাধ্যতামূলক সরকারী ছুটিতে এদেশের কোটি কোটি ‘অবৌদ্ধ’ ধর্মাবলম্বীগণ কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কেন তাদের ছুটি? 

ক্রিসমাস বা যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন হচ্ছে এখন আন্তরজাতিজ পর্যায়ের একটি উৎসব, যা এদেশের সংখ্যালঘু খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজন পালন করে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। এই দিন বাঙালি খৃস্টানগণ গির্জায় প্রার্থনা, ভোজসভা, উপহার বিতরণ, ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে, সান্তাক্লোজ বানিয়ে বেশ বড় করেই ‘বড়দিন’ পালন করে। যথারীতি হিন্দু, মুসলমান আর বৌদ্ধরা রাষ্ট্রীয় ছুটি উপভোগ করে ‘অন্য কাজে’ ব্যস্ততা দেখিয়ে। 
বর্ণিত চার প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় ছাড়াও ‘বাঙালি’ জনগোষ্ঠীর আছে একান্ত নিজস্ব উৎসব। বাঙালির প্রাচীনতম একান্ত নিজস্ব উৎসব হচ্ছে পহেলা বৈশাখ, চৈত্র সংক্রান্তি, পহেলা ফালগুন, নবান্ন উৎসব ইত্যাদি। এ ছাড়া এ সমাজের লুপ্তপ্রায় উৎসব হচ্ছে ‘পুণ্যাহ’, যেদিন প্রজারা ভাল পোশাক পড়ে ‘খাজনা-নজরানা’ দিতে যেতেন রাজা বা জমিদারকে। ব্যবসায়ীদের উৎসব ছিল ‘হালখাতা’ নামে, যা এখনো কিছুটা প্রচলিত এ সমাজে।

বাংলাদেশের প্রধান জনগোষ্ঠী বাঙালি ছাড়াও এদেশে বসবাসকারী উপজাতীয়দের মধ্যে আবার আছে তাদের নিজ নিজ বিবিধ উৎসব। খুমিরা পালন করে ‘গো-বধ’ পূজা উৎসব। খাসিয়াতের আছে সাংবাৎসরিক সপ্তপদী উৎসব। চামকাদের প্রধান উৎসবের নাম হচ্ছে ‘বিজু’ উৎসব। গারোদের আছে সমাজপতিদের আংটি পড়িয়ে ‘জারিয়ালি’ নাচের মাধ্যমে তুষ্ট করার বার্ষিক ‘গান্না’ উৎসব, এ ছাড়াও তাদের আরো আছে ‘ওয়াংগালা’ উৎসব। মারমাদের ফসলকাটার উৎসবের নাম হচ্ছে ‘নবান্ন’। লুসাই আর কুকিদের মোরগ মুরগী উৎসর্গের মাধ্যমে শুরু হয় ‘চাই’ উৎসব। ওরঁাওদের ‘করম’ উৎসব খুবই জনপ্রিয় তাদের জীবনে। মণিপুরীদের কাছে প্রিয় হচ্ছে ‘দোল পূর্ণিমা’র উৎসব। সাঁওতালদের শস্য তোলার নাম হচ্ছে ‘সাহরাই’ উৎসব। মগ, টিপরাসহ এদেশে বসবাসকারী অন্য উপজাতিয়রাও পালন করে নিজ নিজ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ভরপুর নানাবিধ পার্বন ও উৎসবাদি।

সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি একই জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক দেশ হলেও, এদেশের বিভিন্ন ধর্মানুসারী এবং উপজাতীয়রা তাদের নিজ নিজ উৎসব এককভাবে পালন করার কারণে, আমাদের জাতীয় উৎসবগুলো প্রকৃতপক্ষে ‘সর্বজনীন’ হচ্ছে না। অর্থাৎ ধর্মীয় ও অন্যান্য কারণে এক ধর্মালম্বীরা যোগদানে বিরত থাকছে অন্য ধম্বাবলম্বীদের উৎসবাদিতে, যা ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে নানা অনুসঙ্গে। যে কারণে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য একক জাতিগোষ্ঠীর মত নিবিঢ় ‘আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছেনা দীর্ঘদিন একই দেশ ও তার আলো বাতাসে বসবাস করার পরও’। এ ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় উৎসবকে যদি আমরা ‘সর্বজনীন’ করতে চাই, তবে এদেশের বিভিন্ন ধর্মের পালিত বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পরিবর্তে ‘জাতীয়’ উৎসবের দিন করতে হবে আমাদের ‘স্বাধীনতা’ বা ‘বিজয়’ দিবসকে। যা এদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও উপজাতীয়রা সম্মিলিত ও বিতর্কহীনভাবে পালন করবে রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এ দুটো দিনকে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালন করার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে, সত্যিকারভাবে বাংলাদেশ ‘প্রকৃত বাঙালির দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এবং আমাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে নিসন্দেহে। আর যার যার ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য ছাড়াই যার যার মত পালন করবে বিভিন্ন সম্প্রদায়, যাতে রাষ্ট্র কোন বঁাধা বা আনুকূল্য প্রদান করবে না।

এভাবে আমাদের মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসকে আমরা ঘোষণা করতে পারি আমাদের ‘জাতীয় উৎসব’ হিসেবে। একইভাবে বর্তমান প্রচলিত বংলা সন বা বঙ্গাব্দের পরিবর্তে আমরা আমাদের গর্বিত ‘স্বাধীনতার সন’ একাত্তর থেকে গণনা শুরু করতে পারি ‘মুক্তি সন’ হিসেবে। কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির চিন্তা, চেতনা ও মননের সঙ্গে  ‘বঙ্গাব্দ’-র কোন সর্ম্পক নেই। এটি অবাঙালি সম্রাট আকবর তার যুদ্ধ জয়ের স্মৃতি হিসেবে চালু করেছিল, যার সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের কোন মিল নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে আছে আমাদের নাড়ীর সম্পর্ক। এই মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করার জন্যে ১৯৭১-কে ‘১’ মুক্তিসন ধরলে এখন হবে ‘‘২৫ পৌষ ৪০ মুক্তিসন’’। অন্য জাতিরা তাদের বিশেষ দিনকে স্মরণীয় বরণীয় করে রাখতে নানাবিধ চেষ্টা চালালেও, আমরা তা করতে পারবো না কেন? অবশ্যই পারবো। এবং এ জন্যে বর্তমান অসাম্প্রদায়িক মহাজোট সরকারের ভূমিকা হতে হবে অগ্রণী! কারণ এ কাজটি বর্তমান সরকার না করলে আর কে-ই বা করবে এদেশে আর এ সমাজে?  

     

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন