শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

পরিজায়ী পাখিঃ ‘রাক্ষুসে না অতিথি’ বিতর্ক # ৮১

পরিজায়ী পাখিঃ ‘রাক্ষুসে না অতিথি’ বিতর্ক

শীত মৌসুমে এদেশে অতিথি বা পরিজায়ী পাখি একটি অত্যন্ত পরিচিত নাম। পৃথিবীর শীতার্ত অঞ্চল তথা উত্তর গোলার্থের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচন্ড শীতে টিকতে না পেরে শীত সিজনে হাজারো রং বেরং, আকার আকৃতি ও প্রজাতির পাখি চলে আসে বাংলাদেশে তথা গ্রীস্মমন্ডলীয় দেশে। আমরা আদর করে এই পাখিদের নাম দিয়েছি ‘অতিথি পাখি’। কেউ কেউ হাঁসজাতীয় এদের পরিজায়ী Migrant Bird নামেও অভিহিত করে থাকে। যদিও এই লাখো পাখি কেবল শীত মৌসুমেই মাত্র কয়েক মাসের বসবাসে আমাদের দেশের হাজারো টন মাছ ও ফসল খেয়ে শেষ করে ফেলে কিন্তু তবুও আবেগে হোক, আর সরকারি নীতি নির্ধারকদের ভুল তথা আবেগধর্মী প্রচারণায় হোক, হুজুগে বাঙালি হিসেবে আমরা এদের চমৎকার নাম দিয়েছি ‘অতিথি পাখি’। এই অতিথি পাখিদের যদিও কখনো নিমন্ত্রণ বা দাওয়াত করে আনা হয়নি, বরাবরই তারা রবাহূত বা অনাহূত হিসেবে এসে নিজেদের জাহির করতে চেয়েছে সেলফ ‘অতিথি’ হিসেবে। আর প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি অপুষ্টিতে ভোগা হাড়-জিরজিরে এই ছোট্ট ভূখন্ডের বাঙালিরা নিষিদ্ধ করেছি তাদের ধরতে, শিকার করতে ও মাংস ভক্ষণকে। কারণ তারা আমাদের ‘অতিথি’! হায়!

এই তথাকথিত ‘অতিথিরা’ কিন্তু এখানে শুধু ‘খালিহাতে’ বেড়াতে এসেই খান্ত হয়না, আমাদের ছোট বড় নানা প্রজাতির হাজারো মাছ (এমনকি নিষিদ্ধ জাটকা, ডিমওয়ালা, নলা ও মা মাছসহ) খেয়ে সাবার করে দেয়। যদিও এই জাটকা আবার এদেশের গরিব মৎস্যজীবী ‘রাম-রহিম, যদু-মধু’ নামক বাঙালির জন্যে ধরা, বিপণন ও ভক্ষণ নিষিদ্ধ হলেও, এই অবুঝ (নাকি চতুর!) অতিথিরা কিন্তু তাতে ‘ধোড়াই কেয়ার করে’। কেবল মাছ ও ক্ষেতের ফসল খেয়ে চলে গেলেও না হয় আমরা তা মেনেই নিতাম কিন্তু সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে যে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘(বার্ড ফ্লু)’ ছড়িয়ে পড়েছে মনে করা হয়, তার অন্যতম বাহক হচ্ছে আমাদের এই তথাকথিত ‘অতিথি’ জলচর নানা প্রজাতির পাখি মহাশয়রা। খচঅও্ ঐচঅও টাইপের এক শ্রেণির ভাইরাস দেশ থেকে দেশান্তরে বহন করে এই ‘অতিথি’ পাখিরা। যে কারণে হয়তো ইউরোপের কোন উন্নত দেশ বা সূদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত কোন অতিথি পাখি সঙ্গে করে নিয়ে আসে ‘আরেক নতুন অতিথি’ খচঅও্ ঐচঅও টাইপের ভাইরাস। বেড়ানোর পর নিজেরা তেলতেলে শরীর নিয়ে চলে গেলেও, যাওয়ার সময় আমাদের হাসমুরগী তথা গৃহপালিত পাখিদের জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ‘উপহার হিসেবে’ রেখে যায় মরণব্যধি হিসেবে খচঅও্ ঐচঅও টাইপের এই মারাত্মক ভাইরাস।

যে কারণে জনবহুল কোটি বেকারের এ দেশে সদ্য উদীয়মান পোল্ট্রি শিল্প এর মধ্যে পড়েছিল মারাত্মক ঝুুকির মুখে। বিশ্বের ধনবান উন্নত দেশগুলো কোটি ডলার-পাউন্ডের ‘ম্যাড কাউ’ বা বিলিয়ন ডলারের আক্রান্ত মোরগ মুরগীকে পুরিয়ে বা মাটিচাপা দিতে সক্ষম হলেও, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর এ দেশে কি সেই বিলাসিতার সুযোগ আছে? যেখানে অভাবের তাড়নায় ডাস্টবিনে মানুষ আর কুকুরে একত্রে খাবার নিয়ে টানাটানি করে। কেবল ঢাকা শহরেই ২৫-হাজারের বেশী মানুষ বাস্ত্তহীন হিসেবে কাওরান বাজার, সদরঘাট বা কমলাপুর স্টেশনে রাত কাটায় প্রতিনিয়ত! (যদিও আমাদের কারো কারো ৩০-৪০ কামড়ার প্রাসাদতূল্য রাজভবনের কথাও মাঝে-মধ্যে পত্রিকায় পাতায় প্রকাশিত হয়)।

তাই বিদেশী প্রভাবিত আবেগ এবং অন্যের সংক্রামিত চিন্তাধারায় নয়, নতুন করে গভীর ভাবে দেশপ্রেমের বিশ্লেষণি দৃষ্টিতে ভাবতে হবে কেন এইসব তথাকথিত পাখিদের ‘ইনডেমনিটি’ দিয়ে রক্ষা করতে হবে? কিসের অতিথি এরা, কার অতিথি? কি আমাদের উপকার করে এই পাখিরা? এদের জন্যে ক্ষতি হয় বছরে কতটন মাছ ও ফসলের? এরা কি আমাদের জন্যে নিষিদ্ধ জাটকা, ডিমওয়ালা, নলা ও মা মাছ ছেড়ে দেয়? যদি না দেয়, তবে কেন এদের প্রশ্রয় দেয়া? পাখিতো আমাদের নিজেদের আছে হরেক রকম। ডাহুক, শালিক, চড়ুই, দোয়েল, পানকৌড়ি, বক, চখাচখি, মাছরাঙা আরো কত পাখি! নিজেদের পাখিদেরইতো আমরা রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছি না নানাবিধ দৈন্যতার কারণে। তাহলে আর ‘দত্তক’ নেয়া কেন?

আসলে বিচিত্র এ দেশ ও দেশের মানুষের চিন্তা ভাবনা। আফ্রিকায় লক্ষ-কোটি পাখি ও পোকা এসে যখন তাদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে ফেলে, তখন তারা এদেরকে কখনো ‘অতিথি’ না বলে এটিকে একটি জাতীয় সমস্যা বা ‘আপদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তার প্রতিকারের পথ খুঁজতে থাকে। অপরদিকে আমরা প্রায় একই জাতীয় একটি সমস্যাকে কোন সমস্যা মনে না করে, ‘অতিথি পাখি’ বলে সমস্যাটিকে হালকা করে জাতির সঙ্গে কি এক ধরনের রসিকতা করছি না? এভাবে গুরুতর সব সমস্যাকে হালকাভাবে এবং হালকা সমস্যাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার কারণে, এ জাতি দীর্ঘ ৪৩-বছরের স্বাধীনতার সময় অতিক্রম করলেও, তিমির তাদের কাটছে না, বরং জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকারত্ব, সামাজিক অস্থিরতা ইত্যাদি দিনকে দিন বেড়েই চলছে।

এ লেখা পাঠান্তে কেউ কেউ লেখককে প্রাণি বিদ্বেষী মনে করতে পারেন। আসলে লেখক প্রাণি বা পরিজায়ী পাখি বিদ্বেষী নয়। প্রকৃতপক্ষে লেখক এদেশের কোটি ঘরহারা, শিক্ষাহারা, স্বাস্থ্য, খাদ্য আর নানাবিধ মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মানুষের জীবন সংগ্রামের ‘ন্যূনতম চাহিদা’ পুরণের চিন্তার বদলে, এইসব ‘বিলাসী’ চিন্তাধারা বিরোধী, যে চিন্তায় আপাত এদেশের কোন মঙ্গল ও কল্যাণ লেখক দেখছেন না।

হ্যা, কোন সময় যদি এদেশের অধিকার বঞ্চিত কোটি কোটি ‘ছলিমদ্দি-কলিমদ্দি’রা রাস্তায় ঘুমানোর বদলে অন্তত দু’বেলা খেয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নিজের ঘরে ঘুমাতে পারে নিশ্চিন্তে, সন্তানকে দিতে পারে ন্যূনতম খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা, স্ত্রীকে দিতে পারে তার ন্যূনতম পুষ্টি, তখন না হয় বর্ণিত অতিথিদের ‘আপ্যায়ন’ করা যেতেও পারে অতিথি হিসেবে। বর্তমান আমাদের এই ‘ক্রান্তিকালীন’ সময়ে আপাতত অতিথি দেখে ঘরে ‘খিল’ দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।


আপাতত প্রচলিত এই তথাকথিত শত্রু ‘অতিথি’ পরিত্যাগ তথা নিধনের সময় এসেছে এবং তা যত তড়িৎ করা যায়, ততই কল্যাণকর আমাদের দেশ ও জাতির জন্যে। আমাদের নীতি নির্ধারকগণ যদি একটু চোখ বন্ধ করে ভাবেন দেশ ও তার মানুষের কথা, তবে অবশ্যই দেখবেন এ দেশের অধিকার বঞ্চিত কোটি মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো লেখকের কথায় যুক্তি প্রচুর, যা তারা খুঁজে পাবেন না বিদেশি রাক্ষুসে অতিথি পাখিদের ‘অতিথি’ বানানোর আবেগঘন যুক্তিতে! কিন্তু এ যুক্তিহীন সমাজে কে মানে কার যুক্তি?





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন