সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাঙালির ঋণাত্মক মানসিকতা ও অপচয়ের স্বরূপ! # ১১৮

বাঙালির ঋণাত্মক মানসিকতা ও অপচয়ের স্বরূপ! 
চর্যাপদের কাল থেকেই আমাদের হাড়ি ‘ঠনঠন’ করতো, মানে অভাব আমাদের হাজার বছরের নির্মমসত্য, অথচ আমরা একটি অপচয়কারী জাতি নয় কি! অপচয়ের সঠিক সংজ্ঞা খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। কারো জন্যে যা খুব প্রয়োজন, অন্যের জন্যে ‘অপচয়’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ২/৩ একর জমি নিয়ে বাংলো টাইপের বাড়ি করেছেন, এমন ব্যক্তির জন্যে বাড়িতে ফুলের বাগান না থাকা ‘কৃপণতা’ বা ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ হিসেবে গণ্য হলেও, একজন ভূমিহীন কৃষক যে মাত্র ২/১ শতক জমি বর্গা বা অনুদান হিসেবে পেয়েছে, তার আবার ঐ জমিতে শাক-সবজির বদলে ফুলের বাগান করা অপচয়েরই নামান্তর। সামাজিকভাবেও আলোচ্য ব্যক্তিকে অপচয়কারী হিসেবেই সবাই নিন্দা করবে। ইসলামে কৃপণতা ও অপচয় দুটোকেই কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে, এমনকি অপচয়কারীকে ‘শয়তানের’ ভাই/বন্ধু ইত্যাদি বলে সম্বোধন করা হয়েছে। পরকালে তার জন্যে কঠোর শাস্তির কথাও ইসলামের বিভিন্ন স্থানে ঘোষণা করা হয়েছে।

আমাদের দেশটি মাত্র ৫৫,১২৬ বর্গমাইলের লোকে লোকারণ্যের একটি দেশ। যেখানে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় ও ব্যক্তিপর্যায়ে নানা অপচয় আমরা প্রত্যহ লক্ষ্য করি। যে কারণে এ দেশে কিছু মানুষ ভোগ বিলাসে জীবন যাপন করলেও, কোটি কোটি মানুষ তাদের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা থেকে বছরের পর বছর হচ্ছে বঞ্চিত। বিদ্যুৎ স্বল্পতা সত্বেও আমরা কিভাবে তা অপচয় করছি তা সরকারি অফিসগুলোর বিল পরীক্ষা করলেই দেখা যাবে। সরকারি অফিস বাদ দিলেও ‘সুপার মল’ বা ‘পেট্রোল পাম্প’গুলোতে উৎসবের মত লাইটিং দেখে বোঝার উপায় নেই বিদ্যুতের কারণে অনেক কৃষক তাদের জমিতে ঠিকমত সেচ দিতে পারেনা। কিছুদিন আগে সমাজের উচ্চশ্রেণির প্রতীক বিদেশী ডিগ্রীধারী জনৈক উচ্চবিত্ত ডাক্তারকে মিডিয়াতে বলতে শুনেছি, ‘‘বিদ্যুৎ সংকটের কারণে সে তার নিজস্ব আনন্দানুষ্ঠানের লাইটিং বন্ধ রাখতে পারেন না, কারণ সে বিদ্যুৎ বোর্ডকে নিয়মিত বিল দিচ্ছেন ও টাকা দিয়ে বাড়িতে লাইন নিয়েছেন’’! পাঠক বিচার করুন আমাদের মানসিকতা!

জমির স্বল্পতা এদেশে সবচেয়ে বেশী প্রকট। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশে ভূমিকেন্দ্রিক মামলার সংখ্যা মোট মামলার ৮৩%। মূলত ভূমির স্বল্পতাহেতু জমি নিয়ে এতো ঝগড়া-বিবাদ মামলা-মোকদ্দমা। এই জমি সংকটের এদেশে হাজার হাজার একর জমি কিভাবে আমরা অপচয় করছি, তার দু’য়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো।

সরকারি পর্যায়ে সারা দেশের কথা বাদই দিলাম, কেবল ঢাকা শহরেই নানা আকৃতি-প্রকৃতি আর আয়তনের ছোট বড় সরকারি অফিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শহরের সর্বত্র। কোনটি পুরান ঢাকায়, আবার কোনটি মতিঝিল, কোনটি আগারগাঁয়ে, আবার কোনটি উত্তরায়। কোনটি একতলা, আবার অন্যটি বহুতল বিশিষ্ট। হিসেব করলে দেখা যাবে, সরকারি বর্ণিত অফিসগুলোর জন্যে যে জমি নষ্ট হচ্ছে, তা ঢাকা শহরের যে কোন স্থানে বহুতল বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করলে তাতেই স্থান সংকুলান সম্ভব। অথচ শহরের নানা স্থানে বিক্ষিপ্ত ও নানাভাবে অফিস ধরে রেখে সময়, অর্থ ও জমির অপচয় করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে অনেকগুলো স্টেডিয়াম, খেলার মাঠ, মানিক মিয়া এভেন্যু থাকলেও, কেবল বছরে ১/২ দিন সেনাবাহিনীর ‘প্যারেড’ করার জন্যে সংরক্ষণ করা হচ্ছে পুরনো বিমানবন্দরের পুরো বিমানবন্দরটি ‘প্যারেড স্কোয়ার’ নামে। অথচ ঢাকা শহরে রাতে কয়েক লাখ লোক ঘর-বাড়ি না থাকার কারণে রাস্তায় ঘুমায়। আমাদের বিবেক বোধ জাগ্রত থাকলে এবং অপচয়কারী না হলে, পুরনো এয়ারপোর্টের ভেতর দিয়ে আমরা গাড়ি চলাচলের জন্যে ৪/৫ রাস্তা বানাতাম, যাতে ঢাকা শহরের যানজট নামক ‘দৈত্য’টিকে কিছুটা হলেও হালকা করতে পারতাম। ‘সংরক্ষিত এলাকা’ বিধায় যুদ্ধকালীন বা জরুরী অবস্থার সময় ঐ রাস্তাগুলো বন্ধ রাখা যেত। এ দেশের মানুষের জন্যে বানানো কোন ‘সংরক্ষিত এলাকা’ যদি এদেশের কল্যাণে না লাগে তাকে ‘সংরক্ষণ’ করে লাভ কি?

ঢাকার একটি পরিত্যাক্ত বিমানবন্দরের নাম হচ্ছে তেজগাও বিমানবন্দর। বর্তমানে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরটি চালু থাকলেও সরকার আবার একটি নতুন বিমানবন্দর নির্মানের জন্যে মনেহয় আদাজল খেয়ে নেমেছে। কোটি কোটি বাস্ত্তহারা ও ভূমিহীন মানুষের এদেশে আরো হাজার হাজার মানুষকে ভিটেছাড়া করে আরেকটি নতুন বিমানবন্দর না বানালে দেশের কিকি ক্ষতি হবে এবং বানালে কি তেমন উপকার হবে দেশের মানুষ ঠিক বুঝতে পারছে না। আমরা কি আমাদের মেজরিটি গরিবদের কথা চিস্তা করবো না?

আরেকটি অপচয়ের চিত্র হচ্ছে আমারদের ‘ঈদগাহ গুলো’। বছরে ২-দিন ঈদের নামাজ আদায় করার জন্যে দেশের সর্বত্র কয়েক লাখ ‘ঈদগাহ’। সবচেয়ে মজার ও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ইসলামের মূল জন্মভূমি মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে এমনকি খোদ সৌদি আরবের কোন এলাকায়ই, এমনকি মক্কা বা মদীনায় কোন ‘ঈদের মাঠ’ নেই। মহানবী (স.) এর আমলেও কোথাও মাঠে ঈদের নামাজ পড়া হয়েছে বলে কোথাও উল্লেখ নেই। সেখানের সকল মানুষ ফজরের নামাজ শেষেই মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করে। যদিও জমি বা স্থানের অভার সেখানে নেই। কিন্তু আমাদের দেশে জমির মারাত্মক স্বল্পতা থাকা সত্বেও, এদেশে কিভাবে ঈদের মাঠ এলো তা কিন্তু গবেষণার বিষয়। চিস্তাশীল ও দেশপ্রেমিক মুসলমানদের ভেবে দেখতে হবে, বছরে ২দিন আমরা সংরক্ষিত ঈদের মাঠে নামাজ না পড়ে স্টেডিয়াম বা নিকটবর্তী স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বা খেলার মাঠে নামাজ পড়লে দেশ বা জাতির কি কোন ক্ষতি হবে? আবার খেলার আলাদা স্টেডিয়াম না বানিয়ে ঈদগাহকে বিকল্প মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা তাও চিস্তার দাবী রাখে। মনে হচ্ছে এটি করতে পারলে ক্ষতির চেয়ে উপকারই হবে বেশী। আর হ্যা, ঈদের মাঠগুলো আমরা রাখতেও পারি, সেক্ষেত্রে বছরে ২-দিন ঈদের নামাজ পড়া ছাড়াও এই মাঠগুলোকে আমরা অন্য ধর্মীয় ও সামাজিক কাজেও লাগাতে পারি। 

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভাড়া দিতে পারি। লেখাধুলা বা শাকসবজি উৎপাদনের মত কাজে ব্যবহার করতে পারি। একই কথা টঙ্গীর ‘বিশ্ব ইজতিমা মাঠের’ ক্ষেত্রেও। যেহেতু ইসলামে ‘অপচয়’কে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে, অপচয়ের জন্যে পরকালে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তাই বলা যায়, আমরা বর্ণিত অপচয় থেকে মুক্ত হতে পারলে মূলত ইসলামকেই অনুসরণ করা হবে। যদিও আমাদের দেশে সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান ও প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার অভাবে দেশপ্রেমিক হিসেবে আমরা এগুলো চিস্তা করা থেকে বিরত থাকি, প্রচলিত ধ্যান ধারণায় গা ভাসিয়ে দেই। কেউ চিস্তাশীল কথা বললে তাকে মানহানীকর নানা অভিধায় ভূসিত করি কিন্তু প্রকৃত মুসলমানের জন্যে দেশপ্রেমই হচ্ছে আবার ‘ঈমানের অঙ্গ’। তাই আসুন সব ধরনের অপচয়ের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হই এবং জনবিষ্ফোরণের এই ছোট্ট মাতৃভূমিকে রক্ষা করি। এ ক্ষেত্রে মুসলিম জনসংখ্যাধিক্কের দেশ হিসেবে মুসলিম ভাইদেরকেই নবী (স.) এর শিক্ষায় অপচয়কে রোধ করার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের কোনক্রমেই শয়তানের বন্ধু বা ভাই হওয়া চলবে না। এদেশকে বাচাতে অবশ্যই আমাদের বর্ণিত অপচয় রোধের ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।    
    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন