রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

এখনো মানুষ নিজের করতলে তুলে নেয় অন্যের বিষাদ ! # ১০২

এখনো মানুষ নিজের করতলে তুলে নেয় অন্যের বিষাদ !
:
রাত ১১টার দিকে হঠাৎ জানলাম এক নিকটাত্মীয় মারাত্মক আহত হয়ে রওনা করেছে ঢাকার পখে। সারারাত টেনশনে ছিলাম খুব। সকালে রোগিসহ হাজির হলাম ঢাকার পঙ্গু (ট্রমা) হাসপাতালে। সে এক এলাহি কান্ড। বাঙলাদেশের হাজারে হাজারে মানুষ কি প্রত্যহ এভাবে আহত হয় রাস্তাঘাটে ? করিডোর থেকে হাসপাতালের সর্বত্র কেবল আহত মানুষ আর মানুষ। অপারেশন থিয়েটারেও বিশাল কিউতে দাঁড়াতে হলো আমার রোগির অপারেশন করাতে। এক সময় রোগির অপারেশন শেষে তাকে পাঠানো হলো কেবিন বা বেডের জন্যে "অপেক্ষাগার" নামক সাময়িক ওয়ার্ডে। যেখানে প্রায় ৫০-রোগি অপারেশন পরবর্তী চেতন, অর্ধচেতন আর অচেতন অবস্থায় প্রহর গুণছে সিটের জন্যে ।
:
আমার রোগির ভাঙা পায়ে ট্রাকশন লাগানোর পর একটা কেবিনের জন্যে চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু কেবিন পাওয়া যেতে পারে অন্তত দুপুর দুটোর পর, তাই অপেক্ষার পালা। আমার শীতকালীন "বিলিতি সাহেবি কোট টাই" পোশাক দেখে অনেক গ্রামীণ গরিব রোগি আমাকে "বড় কিছু" ভাবতে থাকে চেয়ে চেয়ে। জাস্ট আগ্রহে রোগির পাশে গিয়ে তাদের খোঁজ খবর আর ছবি তোলা দেখে।
:
মালয়শিয়া থেকে টাঙাইলের 'আবুল কাসেম' এসেছে গতকাল ভাঙা হাত নিয়ে এখানে। আজ তার হাত কেটে ফেললো একটা্। সিরাজগঞ্জের ৩ বছরের ছেলে "মাহেব" খেলতে গিয়ে ট্রাকের তলায় পড়ে দুপা-ই কেটে বাদ দিল ছেলেটার। ১৮ বছরের রহিমারও হাতে নানাবিধ নাটবোল্ট লাগিয়ে দিল ওটি থেকে এবং পায়ে প্লাস্টার। এমন প্রায় সবাই। কার কথা বলবো? শিশু, তরুণি, বৃদ্ধ কে না আছে? অনেকেই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত।
:
মালয়শিয়ার আহত আবুল কাসেমকে বুদ্ধি দিলাম, সে যেন প্রবাসি কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে সাহায্যের জন্যে আবেদন করে, তা পেতে আমি সাহায্য করবো তাকে। ৩ বছরের মাহেবের কাটা পা-তে কৃত্রিম পা লাগানোর জন্যে যেতে বললাম সাভারের CRPC-তে। এমন সব কথা শোনাতে উপস্থিত রোগিদের গরীব আত্মীয়রা ভীর করলো আমার কাছে, নানা সহায়তা আর পরামর্শ চাইলো তারা। অনেকের ক্লেদাক্ত ব্যথাতুর চোখ দেখে আমার বুক ভারী, বাক হলো রুদ্ধ তখন, হুহু করলো বুকের ভেতর, মাথায় ভেতর নেচে বেড়াতে লাগলো দুখের ঘুণপোকা। অনেককে অনেক সত্যমিথ্যা বলে সান্ত্বনা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করলাম বিবিধ।
:
বুঝলাম, এই যে প্রতিদিন প্রায় হাজারো আহত রোগি আসে এ হাসপাতালে নানাবিধ চিকিৎসা নিতে। তারা একটু সু্ন্দর ব্যবহার আর পরামর্শ প্রত্যাশা তাদের এ মহাবিপদে। কিন্তু এ বাঙালি মননে ভদ্রতা কোথায়? কোথায় সুপরামর্শ? সর্বত্রই কেবল খাই খাই টাকা টাকা সবার যেন। আমিও তেমন কিছুই করতে পারিনি তাদের জন্যে কিন্তু একটু সান্ত্বনার কথা, ভবিষ্যতে সুস্থ হ্বওয়ার প্রত্যাশা শুনে অনেকের বেশ ভাল লাগলো মনে হলো আমার।
:
দেশের অনেক স্বেচ্ছাসেবি কাজ করে বিভিন্ন সংস্থায়। এ সকল স্বেচ্ছাসেবিরা যদি কাজ করতো পঙ্গুসহ দেশের হাসপাতাল গুলোতে রোটেশনে, আর আহত স্বজনদের হেলপ করতো এক্সরে, ব্যান্ডেজ আর বাইরের ফার্মেসি থেকে বিভিন্ন ঔষধ কিনে আনতে, পরামর্শ দিতো জীবন সংগ্রামের, তাতে খুবই উপকৃত হতো টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া থেকে আগত হাজারো আহত মানুষ আর তার স্বজনরা।
:
আমার স্বজনকে বিকেল ৩টার দিকে একটা কেবিনে তুলে যখন নামছি অনেকটা 'সাফল্যের তৃপ্তি' নিয়ে ট্রমা হাসপাতালের সিঁড়ি ভেঙে, তখনো নজরে পড়লো হাজারো রোগি আর তার স্বজন, যারা এ হাসপাতালের করিডোর আর লবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আহত স্বজনের সুস্থ্যতায়। মনটা দারুণ খারাপ করে মহাসড়কে ট্যাক্সির অপেক্ষায় দাঁড়ালাম। টেক্সি না পেয়ে ঢাকার রাজপথের প্রচন্ড শব্দতরঙ্গের মাঝেও হাঁটছি আমি ফুটপাথ ধরে, আর পূর্ণেন্দু পত্রী শব্দের বিছানা নিয়ে আমার কানে অনুরণন তুলতে রইলো সারাপথ, যতক্ষণ না আমি পৌঁছলাম আমার কাংখিত স্থানে --
:
"তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও ওষ্ঠপুটে রাখি।
ভীষণ বৃষ্টির শব্দ সারাদিন স্মৃতির ভিতরে।
একাকিনী বসে আছ বৃষ্টির ভিতরে
বালুকাবেলায়
কবেকার উইয়ে-খাওয়া ছবি।
তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।
মানুষের ভীষণ বিষাদ
একদিন বেজেছে মন্দিরে শঙ্খ-ঘন্টা রবে।
মানুষের মহান বিষাদ
ভাষ্কর্যখচিত স্তম্ভে একদিন ছুঁয়েছে আকাশ।
আজ ভীষণ নীরব।
জলের ভিতরে ছুরি ঢুকে গেলে
আর্তনাদহীন।
রক্তের ভিতরে কান্না ঢুকে গেলে
প্রতিবাদহীন।
যে যার উদ্যানে ছায়াতলে
পুষ্পের ভিতরে অগ্নি জ্বলে
সুগন্ধ শোকের সম্মূখীন।
তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও
করতলে রাখি।
আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়।
আরম্ভে সকল গাছই সুসাস্থ্য সবুজ।
আরম্ভে সকল মুখে কলমীলতার ছাঁদে সাদা আলপনা
সব কথা রাখালের বাঁশি
আরম্ভে সকল চোখ চশমা ও কাজল ছাড়া সরল হরিণ।
আরম্ভের সব কিছু প্রতিশ্রুতিময়।
অতিশয় বিচক্ষণ হতে গিয়ে যত কিছু অদল-বদল
চোখে ছানি, গালে ব্রণ, বুকে লোম
নখে রক্তপাত
লালসা ও লোভ
ডুমুর ফলের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ এটেঁ যার দাঁতের মাড়িতে।
অতিরিক্ত লালসায় গাছ দীর্ঘ হয়।
আরও উচু হলে আরও অনেক আকাশ
এই ভেবে জিরাফের গ্রীবা ছুঁড়ে গাছ দীর্ঘ হয়।
বাতাসে হলুদ পাতা বাসী ফুল পতনে মূর্ছায়
স্তুপাকার, জলে-স্থলে শোকধ্বনিময়।
অন্যখানে আরও বেশি ভালোবাসা সোনার সিন্দুকে
এই লোভে শৈশবের রূপকথা রাজপুরী ভাঙে
ডুরে শাড়ী বদলে যায়, বিনুনীতে সাপের গড়ন
ঈর্ষার কাজল চোখে, দাঁতের হাসি ধবল করাত।
যে যতই দূরে যাক
অবশেষে সকলেরই ফিরে আসা স্মৃতির ভিতরে বৃষ্টিপাতে
অনুশোচনায় বালি ঘাঁটাঘাঁটি বালুকাবেলায়।
তোমার বিষাদগুলি করতরে তুলে নিতে দাও
ওষ্ঠপুটে রাখি।
সমস্ত আরম্ভ জুড়ে মানুষের আলুথালু কত ছোটাছুটি
কুসুম-কুড়ানো কত ভোরবেলা, কুসুমের মতন কাঁকরও
পকেটে কত কি ছবি, আয়নাভাঙা, আতশবাজীর ফুলঝুরি
দোলের আবীর, বাঁকা রেকর্ডের গান, আঁচলে কত কি
মনোহর মন্ত্রধ্বনি, পালকি যায় পাখী যেতে পারে যত দূর।
আরম্ভের সব কিছু এইরূপ প্রতিশ্রুতিময়।
ক্রমে,
ভীষণ নীরবে
প্রতিশ্রুতি, গাছ ও মানুষ
একযোগে হরিতাভ হয়।
ক্রমে, ভীষণ নীরবে
চোখের কাজল, বেণী, বিত্রিত আঁচল
সোনার সিন্দুক, সব সতকর্তা, সাফল্যের স্ফীতকায় ঘাড়
স্তম্ভ, দম্ভ, জঙ্ঘা, ঊরু, গর্ব অহংকার
সবকিছু থেকে, চেয়ানো ঘামের মত অদ্ভুত বিষাদ।
অবশেষে বৃষ্টিপাত স্মৃতির ভিতরে
বালুকাবেলায়।
তোমার বিষাদগুলি ওষ্ঠপুটে তুলে নিতে দাও
করতলে রাখি।
সভ্যতা সময় কিংবা মানুষের মহা ইতিহাস
এত শোকে তবুও মরেনি।
কারণ মানুষ
এখনো নিজের করতলে
তুলে নেয় অন্যের বিষাদ।
আকাশ পাতাল থেকে এত বিষ, বারুদ ও জীবানু সত্ত্বেও
এখনো মানুষ
অন্য কিছু মহত্তম সুধার আশায়
ওপরের ওষ্ঠ থেকে তার সব মলিন বিষাদ
শুষে নিতে চায়
এখনো বিষাদ পাবে বলে
পুরুষ নারীর কাছে যায়
নারীরা নদীর কাছে যায়
নদীরা মাটির কাছে যায়
মাটি আকাশের দিকে চায়।
তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে চাও ওষ্ঠপুটে রাখি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন