সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমাদের উন্নয়ন অন্তরায় : মননে ঋণাত্মক চিন্তাধারা # ১৩০

আমাদের উন্নয়ন অন্তরায় : মননে ঋণাত্মক চিন্তাধারা 
সমগ্র বিশ্ব এখন উন্নয়নের মহাজোয়ারে ভাসছে। কত উন্নয়ন করছে তা বাইরে না গেলে বোঝা যাবে না। ‘উন্নয়নশীল’ চীনের অবকাঠামো, ব্রিজ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী চাকচিক্য আমাদের চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। চীনের লঞ্চঘাটগুলোতে লাগেজ ‘স্কান’ করার যন্ত্র ছাড়াও ‘স্কেলেটারে’ (যান্ত্রিক সিঁড়ি) লঞ্চে ওঠা যায়, যেখানে আমরা একটি বঁাশ ধরে মোটা তক্তা বেয়ে কোন রকমে লঞ্চে উঠি এখনো। নিউজিল্যান্ডের ডাকঘরগুলোতে কমপক্ষে ৩-সাইজের ‘খাম’ সাজানো থাকে গ্রাহকের জন্যে ফ্রি, যেগুলো আবার ‘অটো-আঠাযুক্ত’, আর আমাদের ডাকঘরে জিপিওর সামনে ‘খিচুরীর মত গাম’ মাঝে মধ্যে পাওয়া গেলেও, কখনো তা শুকনো থাকার কারণে ব্যবহার করা যায় না। এমনকি মালয়শিয়ার রেলস্টেশনগুলোতেও চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করা যায়, যেখানে আমাদের বাস স্টেশনে ব্যবহার উপযোগী একটি ‘টয়লেট’ পাওয়া চরম ভাগ্যের ব্যাপার। সৌদি মসজিদগুলোতেও অসংখ্য টয়লেট বানানো থাকে এবং যেখানে টয়লেট পেপার সাজানো থাকে প্রায় সব টয়লেটে। সিঙ্গাপুরের বাসগুলোও আমাদের বাসের চেয়ে ৩/৪ গুণ লম্বা, যে গুলো রাসত্মায় ঘোরার সময় ‘অটো-বঁাকা’ হয়ে চলতে পারে। চীনে ‘সেনঝেন থেকে নিংবো’-তে দোতলা ট্রেনে ভ্রমন করেছি অনেক বছর আগেই। বর্ণিত সামান্য বর্ণনা থেকেই আমাদের গ্রাম ও খোদ ঢাকা শহরের অবস্থান আমরা অনুমান করতে পারি যে, আমরা আসলে কোথায়? প্রকৃতপক্ষে আমরা যখন ঢাকায় একটি ‘আধুনিক ওভারব্রিজ’ তৈরী করি, তখন উন্নত বিশ্বে তা অনেকটা ‘পরিত্যক্ত ঘোষণা’ করে অন্য নতুন ‘টেকনিক’ চালু করা হয়। অর্থাৎ সব সময়ই আমরা বিশ্ব থেকে পিছিয়ে থাকছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন?
 
এই কেন-র নানাবিধ জবাব থাকলেও, অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, আমাদের ‘চিন্তন দৈন্যতা’। অর্থাৎ চিন্তা ও ধারণাগত দিক দিয়েই আমরা একটি ‘নেতিবাচক ধারনা লালনকারী’ জাতি। অনেক নেতিবাচক চিন্তা আমাদের মননে ‘সেট’ হয়ে যাওয়াতে, আমরা আর তা থেকে বের হতে পারছি না। যে কারণে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, পরনিন্দা ইত্যাদি ‘দুষ্টচক্রের’ মধ্যে আমরা কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছি। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সুষ্পষ্ট হতে পারে।

এদেশের অনেক দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার পাতায় প্রায় প্রত্যহ বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় ‘অলৌকিক বাবা, গুরুজি, মঘা চিকিৎসা, তান্ত্রিক সম্রাট, ফকির, পীর, দরগা, যৌন চিকিৎসা, কামরুপ কামোখ্যার মা, জীন সাধন, ভূতে ধরা, স্বপ্নে প্রাপ্ত ঔষধ-তাবিজ-কবজ, রাবেয়া চিশতী, দ্রব্য শক্তি, গুরুমা, সাধক গুরুজি, রাহুর গ্রাস, বেদবিদ্যা, তরিকতে কামেল, শিশু সম্রাট’ ইত্যাদি হরেক রকম চিকিৎসা। এগুলো শুধু গ্রামে নয়, খোদ ঢাকা শহরেও এ চিকিৎসার অভাব নেই। বাংলাদেশের পত্রিকা ছাড়াও কোলকাতার পত্রিকায়ও জ্যোতিষ, ভাগ্য গণনা, শাস্ত্রী, প্রেত চিকিৎসা, তান্ত্রিক কন্যা, সমেত্মাষী মাতা, সাঁইবাবা, মেটাল চিকিৎসা, তন্ত্রসম্রাট, বশীকরণ, তন্ত্রসাধক, ব্রক্ষচারী, মহারাজ, ফুলবাবা, ফু-বাবা, ডাইনী সম্রাজ্ঞী, যোগী, রুদ্রাক্ষ ইত্যাদির বিজ্ঞাপন প্রত্যহ প্রকাশিত হয়, এমনকি আনন্দবাজারের মত বহুল প্রচারিত পত্রিকায় এই শ্রেণির বিজ্ঞাপনের জন্যে ১টি পাতাও বরাদ্দ থাকে। এই বিজ্ঞাপনে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা এদেশে এবং পশ্চিম বাংলায় অনেক (আসলে একই রক্ত কিনা?), বরং অবিশ্বাসীর সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। এদেশে এখনো একশ্রেণির পঞ্জিকায় কাজ শুরুর শুভ-অশুভ, যাত্রা আস্তি কিংবা নাস্তি, বিবাহ চৈত্র মাসে না ভাদ্র মাসে ভাল না মন্দ ইত্যাদি নানাবিধ কথা লিপিবদ্ধ থাকে এবং শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশিষে অনেকেই যাত্রা বা বিয়ের ব্যাপারে পঞ্জিকাটি অনুসরণ করে। 

এ ছাড়া অবতারবাদ, জর্মান্তরবাদ, জ্যোতিষশাস্ত্র, যাদু-টোনা, অতীন্দ্রিয়ক্ষমতা, ডাব পড়া, সুতা পড়া, পানি পড়া, জুতা পড়া, বাটি চালান, চাল পড়া, পক্ষীতীর্থ, পিন্ডিদান, অশৌচ, ঠিকুজি, কুষ্ঠি বিচার ইত্যাদি এখনো এ সমাজে অত্যন্ত জোরালেভাবে প্রচলিত। উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো অশিক্ষিত ও সাধারণ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বেশ প্রচলিত হলেও, অতি শিক্ষিত তথা আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তিগণও এদেশে তাদের চিন্তনে ধরে রেখেছে কুসংস্কারের নামে ভ্রান্ত অনুভূতি(illussion), অলীক বিশ্বাস (hallucination), মোহ বা ভ্রান্ত ধারনা (delusion), বিকৃত চিন্তন(paranoia), পরামনোবিদ্যা (Parapsychology), অতীন্দ্রিয় অনুভূতি (Extra sensory perception), দূরচিন্তন (Telepathy), ভবিষ্যত দৃষ্টি (Precognition), অতীন্দ্রিয় শক্তি(Clairvoyance), সাইকো কিনেসিস (Psycho-kinesis), ঈশ্বরবিদ্যা (Theosophy), আত্মা বৈঠক (Planchette), মিডিয়াম (Medium), ভাববাদ তথা আধ্যাত্মবাদী চিন্তনে। এই ২০১০ সনেও সাপে কামড়ালে এদেশের অধিকাংশ মানুষই ‘এন্টি-ভেনাম’ ইনজেকশনের পরিবর্তে, ওঝার কাছে দেঁড়ায় ‘মন্ত্রের মাধ্যমে বিষ নামানো চিকিৎসার জন্যে’। অনেক মানুষ এখনো সাপের ‘বিণ’ তথা বাশি বাজিয়ে সাপ আনানোতে বিশ্বাস করে। এ যুগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হিন্দু মেয়েরা রোকেয়া বা সামসুন্নাহার হলে ‘ভাল বিদ্যা’ লাভের জন্যে দেবী স্বরসতীর পূজো দেয় (ঘটনা সত্য হলে কি সব নন-হিন্দু শিক্ষার্থীরা ফেল ও পূজো দানকারী হিন্দুরা ফাস্ট ক্লাস পেয়ে ভাল পাস করতো না? তা কি হয়েছে কখনো?)। আর দেবী মনসার পূজো দেয়ার কারণে হিন্দুদের সাপে কামড়ায়নি কিংবা মুসলমানদের বেশী কামড়েছে এই জাতীয় কোন পরিসংখ্যান কিন্তু পাওয়া যায়নি!

‘নোটবিদ্যা’, ‘কমন পড়া বিদ্যা’, ‘ফটোকপি বিদ্যা’ দিয়ে আমরা আমাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ড্রিগী সম্পন্ন করি। যে কারণে আধুনিক শিক্ষায় বড় বড় ডিগ্রী নিয়েও, এদেশের অধিকাংশ মানুষ নিজেদের মননে লালন করছে প্রাগৈতিহাসিক তথা মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারনা। অবস্ত্তবাদী চেতনা লালনের কারণে হু-হু করে যেমনে বাড়ছে এ দেশের ‘অলৌকিকে বিশ্বাসী মানুষ, তেমনি এদেশের ডাক্তারের হাতে শোভা পায় ‘মাদুলী’, আর তথাকথিত আধুনিক ‘অন-লাইন’ সমৃদ্ধ ব্যাংক কাউন্টারে গেলেও, ‘গ্যাস বা পানির’ বিল পরিশোধকারী গ্রাহককে ব্যাংক কাউন্টার থেকে তাচ্ছিলের সুরে ‘খুচরা টাকা’সহ জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয় কিংবা বিলটি ফেরত প্রদান করা ‘অত্যন্ত স্বাভাবিক’ ঘটনা। এই সমাজে বড় হওয়া একজন ব্যক্তি বর্ণিত ঋণাত্মক ‘সামাজিক শিক্ষা’ প্রাপ্তির কারণে তার কর্মজীবনের প্রায় সর্বত্র ‘নেতিবাচক’ চেতনা লালন করে বিধায়, সমাজ তথা দেশ ঐ ব্যক্তি থেকে ইতিবাচক সেবা পেতে পারে না। এখনো আমাদের আইন হচ্ছে, কোন পর্যায়ের কর্মচারী, কোন শ্রেণির কর্মকর্তা পর্যন্ত দরখাস্ত বা ফোন করতে পারবে কিংবা পারবে না তার নির্দেশনা বাতলে দেয়া!

অধিক সন্তান জন্মদানকারী দম্পত্তিদের অনেকে প্রায়ই বলে থাকেন, যেহেতু তাদের জন্মদানকারী সন্তানদের খাওয়ানো-পড়ানোর দায়িত্বটা তারা নিজেরাই পালন করছে, তাই অন্যের সমস্যাটা কি? কিন্তু এদেশের এখন সকল মানুষ সর্বত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত অসুবিধা ও সমস্যার কারণে আসেত্ম আসেত্ম অনুধাবন করতে শুরু করেছে যে, সমস্যাটি আসলে এককভাবে কোন ব্যক্তির নয়। কারণ বর্ণিত দম্পত্তির সন্তানগুলো সমাজের সর্বত্র বিচরণ করে সমাজের বিদ্যমান সুযোগ গুলোতে ভাগ বসাচ্ছে ও নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করছে বিধায়, সমস্যাটি এখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক। এটিও মূলত বর্ণিত দম্পত্তিরা তাদের নেতিবাচক সামাজিক শিক্ষার কারণে ঠিকমত বুঝতে বা ধরতে পারছে না। এদেশের এখনো অনেক ট্রাক-বাস ড্রাইভার বেপরোয়া বা ত্রুটিযুক্ত গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যা করার পর, তাকে ‘নিহত ব্যক্তির হায়াত শেষ’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে এবং মৃত ব্যক্তির স্বজনরাও ব্যাপারটি মেনে নিচ্ছে স্বাভাবিক ‘ভাগ্য’ বলে।

আমাদের এ নেতিবাচক চিন্তন ধারা পাল্টানোর ব্যাপারে আধুনিক উন্নত পশ্চিমা দেশগুলো কিন্তু কোন উচ্চবাচ্যই করছে না বরং নির্লিপ্ততা দেখে মনে হচ্ছে, তারা হয়তো মনেপ্রাণে চাইছে ‘এভাবেই চলতে থাকুক’, যাতে আমরা ঐসব বর্ণিত ‘মন্ত্র-তন্ত্র, যপ-তপ’ নিয়ে ব্যস্ত থাকবো, আর তারা সেলফোন, ল্যাপটপ, সুপার কম্পিউটার উদ্ভাবন করবে এবং আমাদের কাছে বিক্রি করবে। এমনকি আমরা আমাদের বর্ণিত ‘মন্ত্র-তন্ত্র’ বা ‘ভূত তাড়ানো’র কাজে অন্য তান্ত্রিক বা সহযোগীর সাথে (এমনকি কথিত জীন-ভূতের সাথে) তাদের আবিষ্কৃত ‘সেলফোন’ বা ‘ল্যাপটপ’ ব্যবহার করে কাজটি যেন আরো সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারি।

এ জাতিকে বাঁচানোর স্বার্থেই অবিলম্বে এগুলো বন্ধ করা দরকার। শিক্ষা ব্যবস্থা তথা চিন্তনে আমূল পরিবর্তন করে ‘আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক’ কুসংস্কারত্যাগী মানুষ তৈরীর উপযোগী শিক্ষা ধারা প্রবর্তন করতে হবে, যে কোন কিছুর বিনিময়ে। মানুষ যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানজ্ঞান সম্পন্ন এবং আধুনিক মনন ও চেতনা ধারন করতে পারলে, এগুলো দূর হবে। এ জন্যে রাষ্ট্রের আইন ও তার প্রয়োগকে করতে হবে কঠোরতর। আর এর বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্র যদি বর্ণিত কার্যক্রম চলতেই দেয় অব্যাহতভাবে, তবে এ জাতির উত্তোরণ তথা মুক্তি স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ৪০-বছরেও যেমন ঘটেনি, তেমনি ১০০-বছরেও ঘটবে কিনা তা গভীর চিন্তার বিষয়। কারণ চেতনা ও চিন্তনগত দিক দিয়ে এ জাতি একাত্তরের চেয়ে 2013’র শেষ পর্বে এসে এগিয়েছে, এ কথা বিশ্বের অন্য জাতি গোষ্ঠীর মানুষ এবং এ জাতির কেউই বিশ্বাস করবে না ‘১০০% সত্য বলেই’!  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন