শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ রিভিউ-১ : দেশপ্রেমের এক অনুপম কাব্যকথা : ৬৪

 
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তাঁর নীতি-আদর্শ ও নেতৃত্বের স্বরূপ তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন চমকপ্রদ সরলতায়। বইটা মুলত ১৯৩৮-১৯৫৫ পর্যন্ত সময়কালের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে লেখা। এ বইতে বঙ্গবন্ধুর বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস সচেতনতা খুবই তীক্ষ্ণ ও সুগভীর। নানা কথা বলতে গিয়ে অসম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘...আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিল না’, অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ও নেতৃত্বের কারণে বঙ্গবন্ধু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও নেতাজী সুভাষ বসুর ভক্ত হয়েছিলেন। যে কারণে ভারত বিভাগের পর অন্যান্য অনেকের মতো সঙ্গেসঙ্গে কলকাতা ছেড়ে পাকিস্তানে ফিরে না এসে, মহাত্মা গান্ধী ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কলকাতার আশপাশে তাঁদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখার প্রচেষ্টায় গৃহীত শান্তি মিশনে যোগ দেন তিনি।
 
বইটি পাঠে বাঙালিরা এমন এক নেতাকে খুঁজে পাবেন, যিনি অকপটে বর্ণনা করেন ৩-বছর বয়সের রেণুর সঙ্গে ১৩-বছরের নিজ বিয়ের কথা, টাকার অভাব দেখা দিলেই বাবা বা স্ত্রীর থেকে টাকা নিয়ে জনতার সেবায় দাঁড়ানোর প্রত্যয়ের কথা, স্কুল জীবনে ছাত্রাবস্থা থেকে শুরু করে জীবনের অধিকাংশ সময় মানুষের অধিকার আর ন্যায্যতার জন্য জেলে কাটানোর কথা, পিতা-পুত্রের নিবিড় সম্পর্কের ফুটবল টিম গঠনের কথা, রাজনীতির ক্লান্তিকর সৈনিক মৌমাছি হিসেবে গোপালগঞ্জ-চুঁচূড়া থেকে কোলকাতা, দিল্লী, লাহোর, পাঞ্জাব, করাচী, হায়দ্রাবাদ, পাটনা, মারী, রাওয়ালপিন্ডি, হাওড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, নোয়াখালী, পাবনা, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, নাটোর, নওগাঁ, নারায়নগঞ্জ, রাজশাহী, বরিশাল কমিটি, উপ-কমিটি আর নানাবিধ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অবিরাম ছুটে চলার গল্পকথা। আর এ সফরে তিনি ভ্রমন করতেন নিম্নশ্রেণির ট্রেন, স্টিমার, নৌকা, হোটেল ও বিছানা-বেডিং সহ। নিজেই বহন করতেন তার নিজ জিনিসপত্র কুলির মত। অর্থের যোগানদাতা ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান, স্ত্রী রেণু, আর রাজনীতির গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ৪৩-র দূর্ভিক্ষের সময় লেখক পুরোপুরি মাঠ পর্যায়ের কর্মী হিসাবে নিজেকে নিয়োজিত করেন নিজ এলাকা আর কোলকাতায়।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধে কোলকাতা অবস্থান করেন তিনি সাহসিকতার সঙ্গে। আর দাঙ্গা পরবর্তী ভুখা মানুষের অভাব নিবারণে ‘সেন্ট জেভিয়ার কলেজ’ থেকে ৩-বন্ধু মিলে ঠেলাগাড়িতে চাল বোঝাই করে নিজেরাই ‘ঠ্যালাচালক’ হয়ে তা নিয়ে বিতরণ করেন ‘বেকার’ আর ‘ইলিয়ট’ হোস্টেলে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে যোগদানের কারণে তাকে বহিস্কার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব থেকে, যদিও কর্মচারীরা মুচলেকা দিয়ে ঠিকই যোগদান করেন তাদের চাকুরীতে। দিল্লী থেকে কোলকাতা ফেরার ৩-জনের ট্রেন ভাড়া না থাকাতে, টিকেনহীন বন্ধু নুরুদ্দিনের জন্য তারা ৩-জনেই ওঠেন ‘চাকরদের গাড়ি’ বা ‘সার্ভেন্ট কারে’, যাতে বন্ধুকে নিয়ে আসতে পারেন কোলকাতা পর্যন্ত। মানুষ ও আদর্শের প্রতি তাঁর সততা আজকের ভোগবাদী নেতারা শিখতে পারেন তাঁর জীবনাচার থেকে। কথিত উর্দুভাষী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাঙালি দেশপ্রেমের ঋণাত্মকতা আর নেতিবাচকতার ধারণা পাল্টাবে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।

স্কুল জীবন থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত জীবনের অধিকাংশ সময় জেলে কাটানো নেতাকে বাড়ি গেলে তার ছোট ছেলে কামাল বাবা হিসেবে চিনতে পারতো না, দূরে দূরে থাকতো সে ‘অপরিচিত ঐ পুরুষটি’ থেকে। কিন্তু বোন হাসিনাকে ঠিকই বলতো,“হাচু আপা হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি”, এক মহান নেতার এ হৃদয়ভেদী বাক্য মননশীল পাঠককে আপ্লুত আর অশ্রুাবৃত্ত না করে পারবে না! এ কারণেই হয়তো মানুষের জনসভা শেষে লোকেরা চাঁদা তুলে মানুষ প্রেমিক এ নেতার ‘পানদানে’ রেখে দিতো ৫০০/- টাকা কিংবা বৃদ্ধা মহিলা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতো ১-বাটি দুধ আর ৪-আনা পয়সা নিয়ে এ নেতার জন্য!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন