সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

জণবিষ্ফোরণ, ফতোয়া ও আমাদের ক্রমবর্ধমান সমস্যা # ১৩২

জণবিষ্ফোরণ, ফতোয়া ও আমাদের ক্রমবর্ধমান সমস্যা 
‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’ শব্দটি এখন সর্বত্র এ বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত। ঢাকা শহর কিংবা গ্রামে সর্বত্রই এখন মানুষে গিজগিজ করছে দেশটিতে। স্কুল, হাসপাতাল, রিক্সা, ট্রেন, ফুটপাত কোথাও চলার যো নেই শামিত্মপ্রিয় মানুষের। কি হারে মানুষ বাড়ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের পরিসংখ্যান বিভাগ না দিতে পারলেও, এদেশের মানুষ হিসেবে পদে পদে উপলব্ধি করতে পারি প্রকৃতপক্ষেই ভয়াবহ আকারে ঘটেছে জনবিষ্ফোরণ। যা রোধের কোন ‘টাস্কফোর্স’ বা লক্ষণীয় কার্যকরী ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না সচেতন নাগরিকদের। একটি দেশ যখন মারাত্মক কোন সমস্যায় আক্রান্ত হয়, তার জন্যে তখন প্রণীত হয় বিশেষ আইন এবং তা বাস্তবায়ন করা হয় কঠোর হসেত্ম দেশটির অসিত্মত্ব রক্ষার্থে। এসিড সন্ত্রাস কিংবা মহিলা ও শিশু নির্যাতন নিরোধ আইন এর উদাহরণ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় চীনসহ বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোতে জননিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণীত হলেও, আমাদের শিথিল ট্রাফিক আইনের মতো এদেশের জনউৎপাদন নিয়ন্ত্রণে নেই মূলত কোন আইন-ই। যে কারণে, দেশের বা বিশ্বের অন্য কোন উৎপাদনশীল কাজে না লাগলেও, যে যেভাবে পারছে উৎপাদন করে যাচ্ছে দেশে সপ্তপদী শিশুর, যার অনেকেই প্রকৃত শিক্ষাদিক্ষার অভাবে পরিণত হচ্ছে নেশাসক্তে, সন্ত্রাসী, বেকার, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীতে। বর্ণিত জনগোষ্ঠী ভাগ বসাচ্ছে সীমিত সম্পদের এদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, যানবাহন, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানে। যে কারণে অশান্তি-বিশৃঙ্খলা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে এ সমাজে দিনকে দিন। বিশেষ গোষ্ঠী লক্ষ-উদ্দেশ্যহীন পথহারা 
 
এ মানুষগুলোকে নানা ঋণাত্মক কাজে ব্যবহার করছে তাদের স্বার্থে। এমনকি জনগণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী হলমার্ক গ্রম্নপের এমডিকে পাহারা-রক্ষার জন্যেও বর্ণিত মানুষেরা আন্দোলন করে, প্রতিরোধ করতে উদ্যত হয় র‌্যাবের। সহজপ্রাপ্য ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে এখন সহজেই হরতালের আগে-পরে গাড়ি জ্বালানো কিংবা মানুষ খুন করা যায় নাকি সহজেই। বসিত্মতে ভাড়া পাওয়া যায় যে কোন মিছিলে যোগদান করতে ইচ্ছুক ‘জিন্দাবাদ পার্টি’ টাকার বিনিময়ে। ঢাকার বসিত্মগুলো এখন মাদক, সন্ত্রাস আর শিশু উৎপাদনের সুতিকাগার। বসিত্মতে বসবাসকারী প্রায় বয়স্ক কাজের বুয়ার রিক্সা-ঠেলাওয়ালা শ্রেণির একাধিক তথাকথিত স্বামী বিদ্যমান, যাদের ঔরসের সন্তান কাখে-কোলে নিয়ে বুয়া ঘুরলেও, স্বামী ঘরছাড়া হয়ে অন্য বসিত্মতে বসবাস শুরু করেছে নুতন ‘ফেলানী’-কে নিয়ে। যার কোলে সন্তান দিয়ে হয়তো পালাবে আরেক নতুন ‘শেফালী’র উদ্দেশ্যে।
 
অক্টোপাসের মত সপ্তপদী সমস্যায় নিমজ্জমান আর ঘনবসতির এ ক্ষুদ্র দেশটির যেন সমস্যার আর অমত নেই। যেদিকে তাকাই শুধু হাহাকার, অসুখ, কান্না আর না পাওয়ার যন্ত্রণা! এ যন্ত্রণার অনেকগুলো সৃষ্ট আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত কুসংস্কারের কারণে, কোনটির উৎপত্তি অশিক্ষার কারণে, আবার দারিদ্র্যতার কারণে আক্রামত হচ্ছি আমরা হাজারো সপ্তপদী সমস্যায়। এর মধ্যে কোন কোনটি আবার উদ্ভাবন এবং লালন করছে আমাদের শক্তিধর রাজনীতিবিদগণ, যেমন হরতাল বিষয়ক জ্বালাও-পোড়াও কিংবা ভাঙচুর জনিত সমস্যা। জেনে কিংবা না জেনে ফতোয়া প্রদানের কারণে সৃষ্ট হচ্ছে এদেশে নবতর সমস্যার, যা কখনো আমাদের সংবিধান ও রাষ্ট্রযন্ত্রকেও মুখোমুখি দঁাড় করাচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে কঠিনতর পরীক্ষায়! জনসংখ্যা বিষ্ফোরণের অন্যতম এরূপ কারণ হচ্ছে এই ফতোয়া।

ঢাকা শহরে বলতে গেলে কোন সিএনজি চালিত অটোরিক্সা কিংবা টেক্সিক্যাব-ই (স্বপ্নে দেখার মত!) এখন আর মিটারে চলে না, যা দুয়েকটি চলে তাতে ১.৫০ টাকার ইউনিট কোন কোন ক্যাবের মিটারে ৪/৫ টাকা পর্যমত লাফাতে দেখা যায়। অর্থাৎ সাধারণ ও পুলিশের সামনে প্রকাশে মারাত্মক চুরি! আগে ড্রাইভাররা বলতো, চালের কেজি নাকি ৪০/৫০ টাকা এ জন্যে মিটারে গেলে পোশায় না, এখন চাল-আটার দাম কম হওয়াতে মিটারে না যাওয়ার নানাবিধ খোড়া যুক্তি উপস্থাপন করে তারা নির্লজ্জ তথা সন্ত্রাসীর মত। কিন্তু সম্প্রতি কমপক্ষে ৩-জন অটো-রিক্সা চালকের মিটারে না যাওয়ার যুক্তিতে প্রায় এক ধরণের ‘ফতোয়া’ টাইপ কথা শুনে আমি চরম বিস্মিত এ রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পর্কে তাদের চিমতাধারা তথা ‘মস্তিষ্ক ধোলাই’ দেখে অবাক হয়েছি! ৩-দিন আগে প্রগতি সরণিতে মাথায় টুপির উপর সবুজ রঙের পাগড়ী পড়া সুন্নতী পোশাকের অটোরিক্সার ড্রাইভার পেয়ে খুশী হলাম এ ভেবে যে, সম্ভবত সে মিটারে কিংবা মিটারের চেয়ে ১০/২০ টাকা বেশিতে যেতে সানন্দে রাজি হবে। কিন্তু ‘দীনি’ পোশাকধারী ড্রাইভার পণ্টলে যেতে চেয়ে বসলো ২০০/- টাকা, যদিও দূরত্ব হিসেবে মিটারে ৭০/৮০ টাকার বেশি কোন ক্রমেই ওঠার কথা না। তাকে মিটারের চেয়ে বেশি দাবী করা রাষ্ট্রীয় আইনে নিষিদ্ধ এবং ধর্মীয় দৃষ্টিতেও ‘হারাম’ এবং হারাম খেলে পরকালের শাস্তির কথা বোঝাতে চাইলে সে বললো, ‘‘জালিম রাজার শাসন মান্য করা গুণাহ, হাসিনা-খালেদা জালিম শাসক বিধায়, তাদের আইন মানাও গুণাহ’’। এ ক্ষেত্রে ভাড়া ‘‘দরদাম’’ করে যাওয়াই ‘হালাল’ তথা ইসলাম সম্মত। প্রায় ১৫/১৬-দিন আগেও একই প্রকৃতির কাবুলী ড্রেস তথা ‘সুন্নতী’ ড্রেস পড়া জনৈক ড্রাইভারের সঙ্গে মিটারের বদলে ‘‘চুক্তিভিত্তিতে’’ ভাড়া চাওয়ায়, আমি আমার জানা বোখারী শরীফের ৪/৫-টি হাদিস দিয়ে তাকে হালাল/হারাম বোঝানোর চেষ্টা করলে ড্রাইভার জানালো যে, ‘শাইখুল হাদিস’ কিংবা ‘মুফতি’ ছাড়া কারো ফতোয়া দেয়ার বা হাদিস বলার অধিকার নেই। তার ওস্তাদ ‘মুফতি’ তাকে বলেছে, মিটারের বদলে ‘চুক্তি’-তে যাওয়াই ‘ইসলাম সম্মত’। কাজেই মিটারে না গিয়ে চুক্তিতে ভাড়া চেয়ে সে কোন অপরাধ করছে না। একইভাবে ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ করাও হারাম’ এ কথাও মুফতিরা বলেছে তাকে, যে কারণে প্রায় প্রত্যেক মুফতি-আলেমেরই এ যুগেও ৫-৭টি সন্তান রয়েছে।

বর্ণিত অটোর ড্রাইভার ছাড়াও আমাদের সমাজের অনেকের মধ্যেই এখন রাষ্ট্রীয় আইনকে অবজ্ঞা করা ও তাকে না মানার ধৃষ্টতা যত্রতত্র লক্ষণীয়। আমার গ্রামের বাড়ির মসজিদের ইমামের এ যুগেও ৮টি সমতান হওয়াতে (প্রতি বছর ১টি) অধিক সমতান হওয়ার কুফল তাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে, এলাকার ‘ফ্যামেলি প্লানিং কর্মী’ ঘটনাক্রমে বিষয়টি আমাকে জানায় ও তাকে বোঝানোর জন্যে আমাকে অনুরোধ করে। এ বিষয়ে মাদ্রাসা থেকে উচচতর ডিগ্রীপ্রাপ্ত ইমামের সঙ্গে কথা বললে, তিনি ‘‘পরিবার পরিকল্পনাকে’’ ইসলাম বিরোধী এবং মুসলমানদের উচিত তা না মানা ইত্যাদি যুক্তি আমাকে প্রদর্শন করেন। তার দৃষ্টিতে এদেশে এখনো নাকি অধিক মানুষ জন্ম নেয়নি এবং এদেশে কারো মুখের খাবার কেউ খাচ্ছে না বরং অধিক মানুষ জন্ম হওয়াতে বিদেশী গিয়ে মূলত অধিক মানুষ দেশের উপকার করছে এবং পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রেও তিনি ‘আযল’ কিংবা ‘অধিক জনসংখ্যা অথচ কম সম্পদ’ বিষয়ক বোখারীর হাদিসের আমার ব্যাখ্যাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করে ‘মুফতি’ বা ‘আলেম’ ছাড়া আমাদের মত ‘দুনিয়াবী’ তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানের অধিকারীদের হাদিস ব্যাখ্যা তথা তাফছিরের অধিকার নেই বলে জানালেন। আর এখন মিডিয়ার কল্যাণে প্রায়ই পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আমরা ‘যেনা’ ‘পরকিয়া’ ইত্যাদি অপরাধের কারণে গ্রাম্য ফতোয়ার মাধ্যমে নারীকে ‘জুতাপেটা’ ‘চুলকাটা’ ইত্যাদি শাস্তি দেখতে পাই অহরহ। এ ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে হাইকোর্টের সুয়ামোটোর কারণে কখনোবা গ্রামের মেম্বার বা সাধারণ অজ্ঞ গ্রামের ‘শাস্তিদাতা’-কে পুলিশ গ্রেফতার করলেও ‘মূল ফতোয়া’দাতা থাকে নজরের বাইরে। যদিও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ও এর সংবিধান বর্ণিত শাস্তিকে কখনোই আইনসম্মত মনে করে না।
এভাবে একটি সাংবিধানিক স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে ক্রমান্বয়ে আরেকটি শ্রেণি তৈরী হয়েছে, যারা বিশেষ এক ধরণের শিক্ষার কারণে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে জনকল্যাণে তৈরী এদেশের আইন ও সংবিধানকে মানতে চায়না, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ‘জালিম’ শাসক বলে, নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে ইসলামের মনগড়া অপব্যাখ্যা করে। দেশের প্রতি নিজেদের দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ পালন করছেনা, এমনকি নিজ স্ত্রী-সন্তানদেরকেও একই চিন্তাধারায় লালন-পালন করছে। হয়তো বিশেষ একটি স্বার্থবাদী শ্রেণি বর্ণিত সহজ-সরল ‘অটোচালক’ কিংবা ‘ইমামে’র মাথায় দেশের প্রতি এরূপ ‘‘ঋণাত্মক’’ চেতনা ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ চিন্তাধারা যদি বর্ণিত ব্যক্তিগণ তাদের নিজেদের, স্ত্রী ও সন্তানদের জীবনে ধারাবাহিকভাবে লালন করতে থাকে, তবে তা দেশের জন্য অবশ্যই একদিন ‘বিষফোঁড়া’ হিসেবে দেখা দেবে।

এদেশের জনসংখ্যা বিষ্ফারণ রোধে টাস্কফোর্স গঠন করে চীনের মত এক সন্তান নীতি গ্রহণ এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণে ফতোয়া প্রদান বন্ধ করে কঠোর আইন প্রণয়ন করা অত্যাবশ্যক জনস্বার্থেই। সরকারি চাকুরে, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রথমে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা যায় আইনটি ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হিসেবে। এখনই প্রতিহত করা দরকার তাদেরকে, যারা বলেন একাধিক সন্তান জন্ম দিলেও, তার ভার তারা নিজেরাই বহন করছে কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, সন্তানগুলো পিঁপড়ার মতো বিচরণ করছে বাংলাদেশ নামক এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটিতেই এবং ভাগ বসাচ্ছে তার সীমিত সুবিধাদিতে, যাতে টান পড়ছে প্রকৃত সরবরাহ ও যোগানের। তা না হলে সেদিন হয়তো খুব শীঘ্রই দেখতে হবে, যেদিন চলমান অন্যের গাড়িতে জোর করে অপেক্ষমান যাত্রীরা উঠে পড়ছে; রাতে অন্যের বড় ঘরে প্রতিবেশিরা জবরদসিত্ম ঢুকে পড়ছে ঘুমানোর জন্যে, ট্রেন-স্টিমারে সংরক্ষিত প্রথম শ্রেণি দখল করে রাখছে বিনা টিকেটের যাত্রীরা কিংবা হোটেলের খাবার ছিনিয়ে খাওয়া শুরু করছে পথচারীরা লজ্জাহীনভাবে। এরূপ ঘটনা শুরুর আগেই বাগে আনা দরকার জনবিষ্ফোরণের এ দানবটিকে, না হলে দানবটি তার সহস্রবাহু প্রসারিত করে এ সমাজের সকল শৃঙ্খলাকে পদদলিত করবে তাতে সন্দেহ থাকা উচিত নয় কারোই।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন