সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মানুষ কি অন্য প্রাণিকূল থেকে উন্নততর? # ১৩৩

মানুষ কি অন্য প্রাণিকূল থেকে উন্নততর? 
মহাজগতে মানুষই হচ্ছে সম্ভবত একমাত্র সুখী প্রাণি, যারা বেঁচে আছে এবং বলতে গেলে চমৎকারভাবেই বেঁচে আছে অন্য অনেক প্রাণিকে ‘টেক্কা’ দিয়ে। কোন এক মহামনিষী বলেছেন, ‘‘মানুষের জন্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে ‘মানুষ’ হওয়া’’। একটি ইতর প্রাণির জন্ম নেয়ার পর আর তাকে তার সগোত্র পরিচয়ের জন্যে আর কোন পরীক্ষা দিতে হয়না কিন্তু একটি মানব শিশুকে জন্ম নেয়ার পরও অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় ‘মানুষ’ হওয়ার জন্যে। যে কারণে শৈশবস্থায় কোন কোন মানব শিশুকে গরু, গাথা, ছাগল, বলদ ইত্যাদি বিশেষণে কেউ কেউ ভুষিত করেন অবলীলায়। নানা কারণে ইতর প্রাণি থেকে মানুষ ভিন্ন ও উন্নততর। ইসলামে মানুষকে বলা হয়েছে ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ’ হিসেবে। কিন্তু এই ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ’ মানবকূলের নানাবিধ কর্মকান্ড আধুনিক চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিয়ে তোলে, হৃদয়কে করে দগ্ধ ও রক্তাক্ত। প্রশ্ন জাগায় হৃদ এবং মননে যে, প্রকৃতপক্ষে কারা শ্রেষ্ঠ মানুষ নাকি অন্যবিধ প্রাণি? সম্ভবত এটিই হচ্ছে মানুষ ও অন্য প্রাণির মধ্যে পার্থক্য।
 
মানুষ তার বুদ্ধি, কৌশল আর ‘চতুরতা’ দিয়ে বিশ্বকে বশ মানানোর নানাবিধ কর্মকৌশলে লিপ্ত সেই আদিম অবস্থা থেকেই। কিন্তু তারপরও অনেক প্রাণিকূলের ‘ন্যাচারাল হারমোনি’-র কাছে হার মানতে বাধ্য মানুষের চিন্তাশীলতা। অনেক প্রাণির সামাজিক জীবনধারা মানুষকে হতবাক ও বিস্মিত করে। সাধারণ বাবুই পাখির মত দক্ষ বাসা মানুষ শ্রেণিয় ‘আর্কিটেরচারগণ’ তৈরী করতে পারবে কিনা সন্দেহ! অতি সাধারণ প্রজাতির একটি মৌচাকের সামাজিক জীবন ব্যবস্থা উন্নততর মানব গোষ্ঠীর থেকে বিস্ময়কর। কোন মৌচাকেই একের অধিক ‘রাণী’ মৌমাছি গৃহীত বা রক্ষিত হয়না। রাণীর প্রজননে সহায়তার জন্যে তার কুঠরীর চারপাশে থাকে কয়েকশ’ ‘পুরুষ’ মৌমাছি। আর বিষাক্ত হুল নিয়ে মৌচাকের প্রতিরক্ষা কাজে নিয়োজিত মৌমাছিগুলোর সেক্স হচ্ছে ‘হিজড়া’। শ্রমিক মৌমাছিরা ঘ্রাণশক্তির ‘রাডার’ দিয়ে কেবল মধু আছে এমন ফুলটিতেই যায় বহুদূরে হলেও এবং এক চমৎকার ঐকতানীয় পদ্ধতিতে কুঠরী তৈরী, শিশু প্রতিপালন, ঘর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, রাণী+পুরষ+সৈনিক+শিশু মৌমাছিদের খাবার সংগ্রহ ও পরিমিত সরবরাহ দিয়ে যায় নিজেদের প্রজনন চেতনাহীন ‘হিজড়া’ জীবনেও। এরা কখনো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বা ঝগড়া করেনা রাণীকে পাওয়ার প্রাধান্য বিসত্মার কিংবা কর্ম-বন্টন নিয়ে। প্রত্যেকেই যন্ত্রের মত রুটিন কাজ করে নিজের নিয়ন্ত্রণেই। এদের কোন নিয়ন্ত্রক বা ‘রাজা’ নেই, এদের বিবেক তথা সপ্রণোদিত ইচ্ছেই হচ্ছে এদের ‘নিয়ন্ত্রক’।

ভালবাসা প্রাণিজগতের এক চমৎকার মেল বন্ধন। মৌমাছি ছাড়াও এই বিশাল প্রাণিজগতের অন্য কোন প্রাণিই বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে কখনো যুদ্ধ করেনা। একটি ষঁাড় অন্য একটি ষঁাড়ের সঙ্গে, একটি কুকুর অন্য একটি কুকুরের সঙ্গে, একটি বাঘ অন্য একটি বাঘের সঙ্গে আধিপত্যের লড়াই করলেও, ষঁাড়টি কখনো গাভীর সঙ্গে, বাঘটি বাঘিনীর সঙ্গে কিংবা কুকুরটি কুকুরীর সঙ্গে লড়াই করেনা। এ ক্ষেত্রে বিশাল ও চমকপ্রদ সকল শ্রেণির বিপরীত লিঙ্গের প্রাণিদের মধ্যে ভালবাসা প্রগাঢ়তর সব সময়ই। কিন্তু মানুষ তার সমলিঙ্গের এবং বিপরীত লিঙ্গ উভয় শ্রেণির সঙ্গেই নানাবিধ সংঘর্ষ ও যুদ্ধে লিপ্ত হয় নিজ স্বার্থে। এ ক্ষেত্রে লিঙ্গ ছাড়াও সে তার আত্মীয় তথা মা, ভাই, বোন, চাচা, প্রতিবেশীকেও হত্যা করতে দ্বিধা করেনা নানাবিধ স্বার্থে! 

একটি হিংস্রতর প্রাণিও তার নবজাতকের জন্য নির্দিষ্ট সময় দেয় এবং এ সময় সে পরকীয়া বা এই শ্রেণির কার্যক্রমকে প্রশ্রয় দেয়না সন্তান সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে পালনার্থে। একটি বাঘিনী সন্তান প্রসবের পর যতদিন বাচ্চাগুলো তার দুধ পান করে, ততদিন পুরুষ বাঘটিকে তার কাছে আহবান করেনা কিন্তু মানুষ বিয়ের আগে, বিয়ের পরে, এমনকি দুগ্ধপানকারী সন্তানকে ফেলে কখনো পরকীয়ার টানে ঘর ছাড়ে কিংবা সন্তান. স্বামী বা স্ত্রীকে হত্যা করে প্রেমিকের সহযোগিতায়। মানুষই নিজস্বার্থে ‘এবরশন’ করে যা অন্য প্রাণিরা চিন্তাও করেনা কখনো। এমনকি ‘তথাকথিত’ সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে মানুষ তার সদ্যজাত শিশু সন্তানকে ড্রেনে ফেলে নিজে দিব্যি ‘সতী’ মহিলা হিসেবে নিজেকে সমাজ আর পরিবারে প্রতিষ্ঠা করে।

ধর্ষণ মানুষের মধ্যে একটি স্বাভাবিক রুচি বিকৃত চিন্তন হলেও, অন্য প্রাণিকূলের মধ্যে ‘ধর্ষণ’ প্রবণতা লক্ষ করা যায়না। সকল প্রাণিকূলের মধ্যে একমাত্র মানুষই সমলিঙ্গের (পুরুষে পুরষে কিংবা মহিলা মহিলায়) প্রাণির সঙ্গে যৌনাচারে অভ্যস্ত ও লিপ্ত হয়, যা অন্য প্রাণিদের হয়তো বিস্ময়ে বিমুঢ় করে। সকল প্রাণির মধ্যে আলাদা অনুসঙ্গ হিসেবে ‘সেক্স’ ও ‘জেন্ডার’ নীতি অনুসৃত হলেও, মানুষ সব সময়ই সেক্স ও জেন্ডারকে একাকার করে। এমনকি সেক্স-টাইমের ব্যাপারে অন্য প্রাণিরা সময়ের রীতি-নীতি মেনে চললেও, এসবে মানুষের কোন রীতি পদ্ধতি নেই বললেই চলে। মানে এ ক্ষেত্রে মানুষ সব রীতি নীতির উর্ধে।

একটি কুকুর কখনো প্রভুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও, মানুষ অর্থের বিনিময়ে প্রায়ই এ কাজটি করতে পারে যে কোন সময়ে। অন্য প্রাণিরা তাদের মধ্যে শ্রেণি বৈষম্য না করলেও, মানুষ তার শ্রেণির মধ্যে নানাবিধ বৈষম্যের সৃষ্টি করে। অন্য প্রাণিকূলেরা শুধু তার দৈনন্দিন বা আপদকালীন খাবার সংগ্রহে ব্যাপৃত থাকলেও, মানুষ নিজের জন্যে অনেক বেশী সম্পদ মজুদ করতে অভ্যস্ত তার গোষ্ঠীর অন্য মানুষদের বঞ্চিত করে। ভোগবাদী মানুষেরা একাধিক স্ত্রী, স্বামী, ফিঁয়াসে, দাসদাসী গ্রহণে অভ্যস্ত হলেও, অন্যপ্রাণিরা এগুলো থেকে মুক্ত। ধর্মীয়, বর্ণীয়, সামাজিক, আর্থনীতিক, রাজনীতিক কারণে মানুষ তার দখলীকৃত এলাকায় অন্য মানুষের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করলেও, অন্য প্রাণিরা সমগোত্রীয় প্রাণিদের নিয়ে সাধারণত ‘মাইগ্রেড’ করে এদেশ থেকে অন্য দেশে। অন্য প্রাণিরা তার জৈবিক প্রয়োজনে বিজাতীয় প্রাণি হত্যা করে এবং এ জন্যে কোন ভণিতা বা লোকদেখানো ঠুনকো যুক্তি প্রদর্শন করেনা কিন্তু মানুষ ঐ জাতীয় বহু ‘অমানবিক’ কাজ করার পর তার নানাবিধ ‘খোড়া’ যুক্তি হাজির করে নিজের পক্ষে সাফাই স্বাক্ষী হিসেবে। যেমন মানুষেরই ভূখন্ড অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় কেন ‘বাঙাল’ নামক ‘কাঙাল’-দের প্রবেশ করতে দেয়া হবে না কিংবা বিশেষ একটি প্রাণিকে কেন হত্যা করে মাংস খাওয়া হবে কিংবা মুরগীর ডিম কেন বাচ্চা না ফুটিয়ে ‘ওমলেট’ করা হবে কিংবা একটি বোকা প্রাণির দুধ কেন তার বাচ্চাকে বঞ্চিত করে মানুষ নিয়ে আসবে আইসক্রিম বানানোর জন্যে; তার নানাবিধ খোড়া, হাস্যকর ও অযৌক্তিক যুক্তি প্রদর্শন সম্ভবত একমাত্র মানুষই করতে পারে তার ‘চতুরতা’র কারণে।

অনেক প্রাণির অন্ধকারে দেখার শক্তি, দূরাভাষ শোনার শক্তি, তীব্র ঘ্রাণশক্তি, বোধগম্যতা শক্তি, অনুভবের শক্তি, শিকার ধরার শক্তি, নিজের প্রতিরক্ষার শক্তি, প্রকৃতিকে বোঝার শক্তি মানুষ থেকে উন্নততর। মানুষ একটি মহা ‘ট্যান্ডন’ প্রকৃতির প্রাণি বলেই, সে তার নিজ নিজ সুবিধার জন্যে নানাবিধ জাতি, ভাষা, গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ, দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, রীতি, নীতি ইত্যাদি বহুধা সংজ্ঞা ও রীতি নীতি বানিয়েছে, যা থেকে হয়তো মানুষ একদিন বেড়িয়ে আসবে! মহাজাগতিক সৃষ্টিতত্ত্বে যদিও তা খুব অল্প সময়ের ভেতরেই ঘটবে কিন্তু পৃথিবীর মানুষের সময়ের হিসেবে এ ‘ট্যান্ডন চক্র’ থেকে বেরুতে মানুষের আরো অনেক সময় লাগবে! যে সময়ে মানুষ বর্ণিত প্রপঞ্চকে আরো জটিলতর করবে এবং নিজেদের আপাত সুখী প্রাণি মনে করলেও, প্রকৃত বিচারে অন্য প্রাণিরাই মানুষের চেয়ে সুখী। কারণ মানুষের মত ‘অ-সুখ’ তাদের আক্রান্ত অদ্যাবধি। যে কারণে স্ট্রোক বা হার্টএ্যাটাকে মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব বরণ মানুষের মধ্যে সহজপ্রাপ্য হলেও, অন্য প্রাণিকূলের মধ্যে বেশ দুষ্প্রাপ্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন