সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

স্ট্রোক, হাইপার-টেনশন ও হার্ট-ফেইলিউরের আধিক্য যে কারণে বাংলাদেশে # ১২৮

স্ট্রোক, হাইপার-টেনশন ও হার্ট-ফেইলিউরের আধিক্য যে কারণে বাংলাদেশে 
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখন স্ট্রোক, হাইপার-টেনশন ও হার্টফেইলিউরের ঘটনা প্রায় প্রত্যহ প্রত্যক্ষকরি আমরা। সাধারণ মানুষও এখন চাল-ডালের মত প্রত্যহ বর্ণিত রোগের ঔষধ কিনছে দেদারসে। পরিচিত জনদের পরিবারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এমন পরিবার খুব কমই আছে, যারা বা যাদের পরিবারে কেউ না কেউ বর্ণিত রোগে আক্রান্ত হয়নি কিংবা ভুগছে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বর্র্ণিত রোগগুলোর আধিক্যের কারণ কি? পেশাদার ডাক্তারগণ হয়তো সানন্দে এদের চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে এর নানাবিধ চমকপ্রদ ব্যাখ্যাও দেবেন কিন্তু এদেশের যে কোন চিন্তাশীল ব্যক্তি সমাজের একটু গভীরে প্রবেশ করলেই দেখতে পাবেন, সামাজিক অস্থিরতায় কিভাবে এবং কেন এ রোগগুলো ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনের পর দিন।
 
আসলে আমাদের সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যেই মূলত রোপিত হচ্ছে বর্ণিত রোগগুলোর বীজ। সমাজের পরতে পরতে রোপিত অন্যায় আর প্রতারণার চক্র আমাদের নিচে যাচ্ছে অনাকাংখিত-অনভিপ্রেত সময়ে। যেমন আপনি কোথাও যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছেন কিন্তু কোন যানবাহনই পাচ্ছেন না, হঠাৎ সিএনজি চালিত একটি অটো বা টেক্সিক্যাব পেলেও, আপনার কাংখিত গন্তব্যে যেতে চাইবে না কিংবা চাইলেও মিটারে যেতে চাইবে না, ভাড়া চাইবে মিটারের ৩-গুণ বেশি। ড্রাইভারের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে এবং কাংখিত স্থানে সময়মত পৌঁছতে না পাড়ার জন্য বেড়ে যেতে পারে আপনার টেনশন কিংবা আক্রান্ত হতে পারেন বর্ণিত একাধিক রোগে। আবার বাসে উঠলেন কোন রকমে ঠেলেঠুলে? কিন্তু ‘কনডাকটর’(!) ভাড়া চাইবে তার ইচ্ছেমত ‘সিটিং’, ‘ডাইরেক্ট’ ইত্যাদি ফালতু যুক্তি দেখিয়ে দূরত্বের ৩-৪ গুণ। চলমত বাসে দাঁড়ানো, ধাক্কা আর বসা নিয়ে পার্শ্ববর্তী লিঙ্গভেদে যে কোন যাত্রীর সঙ্গে লেগে যেতে পারে বচসা কিংবা হাতাহাতি। বিকল্প হিসেবে ১-কিলোমিটার দূরত্বের পথের জন্য ২০-টাকা ভাড়ায় যখন অনড় থাকে রিক্সাওয়ালা, তখন টেনশন ধরে রাখে কার সাধ্য?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোগ্যপণ্য তথা জিনিসপত্রের দাম প্রায় একই থাকে এবং কখনো যৌক্তিক কারণে বাড়লেও, দেশের সব নাগরিক বিষয়টি সম্পর্কে জানে এবং ওভাবে তাদের মানসিক প্রস্ত্ততিও থাকে কিন্তু এদেশে বাজারে গিয়ে দেখা যায় হঠাৎ গতকালের ৩০ টাকার কাঁচা মরিচ আজ বিনা কারণে ৭০ টাকা কিংবা ২০০ টাকার মাছ ৪০০ টাকা, ব্যস মানুষ আক্রান্ত হয়ে গেল বর্ণিত এক বা একাধিক রোগে। ঈদে আনন্দের জন্যে পরিবারসহ যাওয়া হবে গ্রামে কিন্তু একই ব্যাপার বাস-ট্রেন-লঞ্চের টিকেট পাওয়া না পাওয়ার টেনশন, পেলেও অনেকগুণ বেশী দামে কেনার যন্ত্রণা এবং কষ্টকর নিরানন্দ যন্ত্রণাদায়ক জার্নি, যা থেকে বর্ণিত রোগের উৎপত্তি ঘটবে সহজেই। রাসত্মাঘাটে চলতে গিয়ে সবসময় টেনশনে থাকতে হয়; কখন মোবাইলটি, গলার চেইনটি কিংবা পকেটের টাকাটি চলে গেল পকেটমারের পকেটে কিংবা মলমপার্টি কখন চোখে মলম লাগিয়ে সব নিয়ে যাওয়ার পরও মূল্যবান চোখদুটো নষ্ট হওয়ারও টেনশন থাকবে সারাক্ষণ! ব্যাংকে টাকা জমি দিতে কিংাব তুলতে গিয়েও শামিত নেই, টাকা তুলে বের হয়ে রাস্তায় সারাক্ষণ টেনশনে কাটাতে হবে ঘরে না ফেরা পর্যমত। কোন কিছু কিনতে গিয়ে ওজনে কম পাওয়ার টেনশন আপনাকে যন্ত্রণা দিবে অনেকক্ষণ, বিশেষ করে মাংস কিনলে ওজনে কম ছাড়াও মাংসের বদলে ‘ফালতু’ জিনিসপত্র দিয়ে দেয়ার ভয়, মাংস নিয়ে ঘরে ফিরে স্ত্রীর ভৎর্সনা শোনার ভয়, ডিম কিনতে পচা ডিম পাওয়ার টেনশন, লিচু কিনতে একশ’র বদলে ৭০-৮০টি পাওয়ার টেনশন, মোবাইলের চটকদার বিজ্ঞাপনে মোহিত হয়ে ২০০-৩০০% গুণ বোনাস ‘টক-টাইম’ কথা বলার আগেই ১-দিনের মাথায় শেষ হয়ে যাওয়ার টেনশন, পøট ও ফলাট বুকিং দিয়ে তা বছরের পর বছর ঘুরেও সমাপ্ত না হওয়া ও বুঝে না পাওয়ার টেনশন আমাদের মন ও মসিত্মষ্ককে কুড়ে কুড়ে খায় প্রতিনিয়ত। 

প্রত্যহ যানজটে হাজার হাজার মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থেকে বেড়ে যায় তাদের মানসিক যন্ত্রণা এবং ক্রমাগত একই যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে আক্রান্ত হয় তারা বর্ণিত সব রোগে। উচ্চ শিক্ষিত লক্ষ ক্ষ বেকার নানা যায়গায় ইন্টারভিউ দিয়ে চাকুরীর জোগার করতে না পেরে ক্রমাগত তারা হার্ট ডিজিজ, টেনশনসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয় সহজেই। বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালদের টাকা দিয়ে বিমানবন্দর কিংবা নানা চোরাই পথ থেকে ফিরে এসে প্রদত্ত টাকা ফেরত না পাওয়ার যন্ত্রণায় আক্রান্ত হয় বর্ণিত রোগে। আর সদ্য বিবাহিত যে লোকটি শশুর বাড়ি থেকে ২-৩ লাখ টাকা ধার (বা যৌতুক) এনে কিংবা নিজের পৈত্রিক জমিটুকু বন্ধক রেখে ‘শেয়ার বাজারে’ বিনিয়োগ করে ফটকাবাজীদের কারসাজিতে এখন ‘ফতুর’ হয়ে পথে বসেছে, তার বরং বর্ণিত ৩টি রোগে আক্রান্ত না হওয়াই বরং অস্বাভাবিক! শেয়ার বাজারে ফতুর হয়ে স্ট্রোক করার ঘটনা আমার পরিচিত জনের মধ্যেই বিদ্যমান। সরকারি দপ্তরে ফাইল ছাড়াতে গিয়ে সাধারণে টেনশনে ভোগে ‘ঘুষ’ প্রদানের চিমতায়, আর ‘ঘুষখোর’ দুর্নীতিবাজ কর্মচারী সবসময় মানসিক টেনশনে আক্রামত থাকে, কখন ধরা পড়বে ‘সৎ বড়কর্তা’ কিংবা ‘গণধোলাই খাবে’ পাবলিকের হাতে! যেভাবে সরকারি টেন্ডার ডেকে মারাত্মক টেনশনে থাকেন সৎ কর্মকর্তা মাস্তানদের হাতে নিগ্রহের, আর অসৎ কর্মকর্তা ‘কমিশন খাওয়া’ তার পছন্দের পার্টিকে কাজ ‘গুছ’ করে দেয়ার দুশ্চিন্তায়।

আজকাল নানাবিধ পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতারণামূল নানাবিধ বিজ্ঞাপন আমাদের চোখে পড়ে। এর মধ্যে জামানত প্রদানের মাধ্যমে টাওয়ারে চাকুরী, বিদেশ প্রত্যাগত বিধবা ম্যাডামের কেয়ার টেকার, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ান বাঙালি মহিলার জন্য জরুরী ভিত্তিতে ‘গ্রামীণ দঁাড়িওয়ালা পাত্র’, বিশাল নগদ লাভে ক্যাশ টাকা বিনিয়োগের প্রসত্মাব, যৌথ বিনিয়োগ জমি বা ফ্লাট নির্মাণ, জীন-ভুতপ্রেতের মাধ্যমে চিকিৎসা ইত্যাদি চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে এদেশের হাজারো সমস্যায় আক্রান্ত হতাশাগ্রস্ত মানুষ এদের খপ্পরে পরে সর্বশ্রান্ত হয়ে আক্রান্ত হয় বর্ণিত এক বা একাধিক রোগে। কোথাও যায়গা-জমি কিনলেই তার দখল বা নির্মাণ কাজ শুরু করলেই দেখা দেবে চাঁদাবাজ মাসত্মান। তাদের নিয়মিত চাঁদা দিয়ে খুশী রাখতে না পারলে, বেড়ে যাবে আপনার টেনশন আর আক্রান্ত হবেন বর্ণিত রোগে।

এভাবে উপর্যুক্ত সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, দুরবস্থা আর অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা থেকে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে প্রথমে মানসিক যন্ত্রণায়, পরবর্তিতে তা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে স্ট্রোক, হাইপার-টেনশন ও হার্টফেইলিউরের মতো জীবনঘাতী রোগ। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজপতিরা এ ঋণাত্মক অবস্থা থেকে উত্তোরণের কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না। যার প্রেক্ষিতে প্রতিনিয়ত সমস্যাটির ভয়াবহতা ও বর্ণিত রোগগুলো বেড়েই চলছে এ সমাজে। কিন্তু এ থেকে কি আমাদের পরিত্রাণ নেই? এ প্রশ্ন রেখে গেলাম রাষ্ট্র পরিচালক আর সমাজ নিয়ন্ত্রকদের কাছে, যারা মূলত প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষে লালন করছেন বর্ণিত নেতিবাচক ও সমাজের জন্যে এসব মারাত্মকক্ষতিকারক কর্মকান্ডকে!   
                              

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন