শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বঙ্গাব্দের পরিবর্তে চলুন 'মুক্তিসন' বা 'স্বাধিনতা সন' গণনা করি # ৯৭

১৪২১ বাংলা সনের মুক্তিচিন্তনের ভাবনা :
বঙ্গাব্দের পরিবর্তে চলুন 'মুক্তিসন' বা 'স্বাধিনতা সন' গণনা করি
পৃথিবীর প্রথম ক্যালেন্ডার ছিল লুনার, যা তৈরি হয়েছিল স্কটল্যান্ডে প্রায় ৮০০০ বছর খৃস্টপূর্বে। প্রাক্তন রোমান ক্যালেন্ডারে প্রথমে বছর ছিল ২৬০-দিনের। পরবর্তীতে রোমানরা ৩০৪ দিনে ও ১০-মাসে বছর গণনা শুরু করে, এর ধারাবাহিকতায় তা ৩৬৫ দিন ও ১২-মাসে রূপান্তর ঘটে।

অদ্ভুত সপ্তপদী মন-মানসিকতার এদেশে বর্তমানে পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডারে মোট ৩-টি সন গণনা পদ্ধতি চালু আছে। বাংলা, ইংরেজি এবং আরবি। ইংরেজি সনটি খ্রীস্টীয় বা গ্রেগোরিয়ান সন হিসেবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে পরিচালিত হয় অনেকটা আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষার রীতিতে। এদেশে অফিস আদালত রোমান বা বৃটিশ আইনে পরিচালিত বিধায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা সনের কথা বলা থাকলেও, আসলে সর্বত্রই প্রতিপালিত হয় ইংরেজি বা গ্রেগোরিয়ান সনটি। যিশু খ্রীস্টের জন্ম তারিখ হিসেব করে গণনাকৃত এ সৌর ক্যালেন্ডারে লিপিয়ারসহ বিজ্ঞানভিত্তিক গণনা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় বলে, বিশ্বের প্রায় সর্বত্র এ সনটি নানা সংস্কারের মাধ্যমে এখন অনেকটা আধুনিক ও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও মানুষের কাছেই গ্রেগোরিয়ান সনটি গ্রহণযোগ্য।

মুসলমান প্রধান বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় কোন কাজে তেমন না লাগলেও, এদেশে আরবি বা হিজরি সনটিও বেশ প্রচলিত। যদিও এদেশের মুসলমান সম্প্রদায় পবিত্র রমজানের একমাস (সাহ্‌রে রামাদান), পবিত্র হজ্ব, কোরবানি, শবে-কদর, শবে-বরাত, আশুরা, আখেরি চাহার সোম্বা ইত্যাদি ধর্মীয় দিনগুলো আরবি তথা হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতিপালন করে থাকে। চন্দ্রের আবর্তনকে হিসেব করে আরবি মাস পরিচালিত হয় বিধায়, খ্রীস্টীয় বা বাংলা দিন তারিখের সঙ্গে আরবি দিন-মাসের হিসেব খুব একটা ঠিক থাকে না। এ জন্যে পবিত্র রমজান মাস কখনো এদেশে শীতকালে, আবার কখনো প্রচ- গ্রীম্মে প্রতিপালিত হয়।

মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বাঙালি প্রজাদের খাজনা তথা রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সন-তারিখ তথা ‘বঙ্গাব্দ’ প্রবর্তন করা হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা হলেও, শুরু থেকেই নানাবিধ কারণে বাংলা সালটি এদেশে উপেক্ষিত। কেবল গ্রামের কিছু সাধারণ মানুষ বা কৃষক সম্প্রদায় বাংলা সনের হিসেব রাখে কৃষিকর্ম তথা ফসল বোনা ও বিপনণের সুবিধার জন্যে। কেবল পহেলা বৈশাখ, আষাঢ় বা বসন্তের প্রথম দিন, চৈত্র সংক্রান্তি ছাড়া বাংলা সন-তারিখ এদেশে খুব একটা হিসেব করা হয়না, এমনকি ভাষা আন্দোলনের স্মরণে ‘একুশে দিবসে’-ও না।

এভাবে দেখা যাচ্ছে, এদেশের বাঙালিরা ৩-টি সন ব্যবহার করে যার প্রথমটি হচ্ছে খ্রীস্টিয় বা গ্রেগোরিয়ান মানে আন্তর্জাতিক, যেটি নানা কারণে আমাদের পরিহার করা চলবে না। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ বিধায় মুসলমানদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রতিপালনার্থে মুসলিম সন-তারিখও বাদ দেয়ার কোন আপাতত অবকাশ নেই। বাকি থাকলো বাংলা সন মানে ‘বঙ্গাব্দটি’। যা প্রবর্তন করেছিলেন একজন ‘অবাঙালি’ মোঘল শাসক তার নিজের সুবিধার্থে, তা ছাড়া এ সাল প্রবর্তনের সাথে এদেশের তথা বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি ঐতিহাসিক কোন ঘটনার যোগসূত্র নেই।

সন-তারিখের ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যায় বিশেষ কোন ব্যক্তি বা ঘটনার স্মরণে সন প্রবর্তিত হয়েছিল, যেমন যিশু খ্রীস্টের জন্মের হিসেবে ‘খৃস্টাব্দ’ এবং ইসলামেনর নবি মুহম্মদ এর হিযরতের স্মরণে ‘হিজরি’ সনের প্রবর্তন হয়েছিল। আর বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তিত হয়েছিল ১৫৮৪ সনের ১১ মার্চ তারিখে। বাদশা আকবরের রাজত্বের ২৯তম বছরে এটি প্রবর্তিত হলেও, এটি গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ সনের ০৫ নভেম্বর থেকে। এই তারিখটি ছিলু আকরব কর্তৃক হিমুকে পরাজিত করে পানিপথের যুদ্ধে তার জয়লাভের তারিখ। সম্রাট আকবরের আমলে ফার্সি (পার্সি) মাসের অনুকরণে বাংলা মাসের নাম ছিল যথাক্রমে ‘‘ফারওয়ারদিন, উর্দিবাহিশ, খোরদাদ, তীর, মুরদাদ, শাহারিবার, মেহের, আবান, আজার, দে, বাহমান ও ইসফান্দ’’। পরবর্তীতে নানা ঘটনাক্রমে মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকার নামানুসারে বর্তমান নামে রূপান্তরিত বা প্রবর্তন করা হয়। যেমন বিশাখা নক্ষত্র থেকে ‘বৈশাখ’, জেষ্ঠ্যা নক্ষত্র থেকে ‘জ্যৈষ্ঠ’, আষাঢ়া নক্ষত্র থেকে ‘আষাঢ়’, শ্রবণা নক্ষত্র থেকে ‘শ্রাবণ’, ভাদ্রপদ নক্ষত্র থেকে ‘ভাদ্র’, অশ্বিনী নক্ষত্র থেকে ‘আশ্বিন’, কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে ‘কার্তিক’, অগ্রাইহনী নক্ষত্র থেকে ‘অগ্রহায়ণ’, পুষ্যা নক্ষত্র থেকে ‘পৌষ’, মঘা নক্ষত্র থেকে ‘মাঘ’, ফল্গুনী নক্ষত্র থেকে ‘ফাল্গুন’ এবং চৈত্রা নক্ষত্র থেকে ‘চৈত্র’ মাসের নাম গ্রহণ করা হয়। বঙ্গাব্দ গণনায় কিছু সমস্যা সৃষ্টি হওয়াতে ১৯৬৬ সনে তা ইংরেজির মত সৌরবর্ষ হিসেবে নির্ভুল গণনার জন্যে সংস্কার করা হয় এবং বর্তমানে বাংলা সন-তারিখও অনেকটা আধুনিক, যদিও ‘পশ্চিমবঙ্গ’ ও ‘বাংলাদেশে’র বাংলা সন তারিখে নানাবিধ গরমিল এখনো দৃশ্যমান।


১৯৭১ সন আমাদের গৌরবজ্জ্বল স্বাধীনতার এক মহান ইতিহাস আলেখ্য। যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল ৩০-লাখ মানুষের রক্তের লাল অক্ষরে কিন্তু ঐ কালজয়ী ইতিহাসকে স্মরণে রাখতে এখনো আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি। আমরা আমাদের বর্তমান প্রচলিত বঙ্গাব্দের পরিবর্তে ‘স্বাধীনতা’ বা ‘মুক্তিসন’ প্রবর্তন করে আমাদের স্বাধীনতাকে স্মরণিয় করে রাখতে পারি কালের খাতায়। যেমন ১৯৭১ হবে ‘মুক্তি সনে’র প্রথম বছর। আর ২০১৪ হবে ‘৪৩-মুক্তিসন’। যেমন চলতি ‌’০১ পৌষ ১৪২০’ বঙ্গাব্দ মুক্তি সনে হবে ‘০১ পৌষ ৪৩-মুক্তিসন’। বাংলা মাস-দিন তারিখ ইত্যাদি প্রচলিত রেখেই, বর্তমান প্রচলিত বঙ্গাব্দের বদলে ‘মুক্তিসন’ (কিংবা স্বাধীনতা সন) প্রবর্তিত হলে, আমাদের মাস-দিন-বছর গণনায় কোনই অসুবিধা হওয়ারও কথা নয়। কেবল বঙ্গাব্দ (যেমন বর্তমান ১৪১৯ এর সঙ্গে আমাদের কোন ইতিহাস বা গৌরবগাঁথা জড়িত নেই) এর পরিবর্তে ‘মুক্তিসন’ বা ‘স্বাধীনতাসন’ গণনা করলেই সব ঠিক রেখেও, আমরা আমাদের মহান রক্তস্নাত স্বাধীনতা যুদ্ধকে অমোঘ ইতিহাসে স্থান দিতে পারবো যুগ থেকে যুগান্তরে! এটিও হবে আমাদের এক নবতম সৃষ্টিশীলতা তথা লাখো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাঘ্র। আশা করি সরকার বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্দি করে মুক্তিসন প্রবর্তনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ ব্যাপারে ফেসবুকে সচেতনার আন্দোলন গড়ে তোলা যায়! কি বলেন বন্ধুরা?





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন