শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমার দ্বীপগাঁয়ের কলেরা (ডায়েরিয়া) যেভাবে পালিয়ে গেল ! # ৭৪


কৈশোরে আমার দ্বীপগ্রামের ১০০% জেলে, কৃষক আর অন্যান্য সকল মানুষই পাশের খাল বা নদীর পানি পানসহ সকল কাজে ব্যবহার করতো। শিক্ষিতরা কেবল পানিতে কিছু ফিটকিরি দিতো, আর ৯৯% মানুষ সরাসরি নদী বা খালের পানিই সকল কাজে সব সময় ব্যবহার করতো। কাঁচা টয়লেট ছিল খালের পাড়েই। তাই চৈত্র মাস এলেই গাঁয়ে কলেরা লেগে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই ২/১ জন করে মানুষ মারা যেত। এক বাড়িতে ২/৩ দিনের ব্যবধানে কলেরায় ১৩-জনের মুত্যু হয়েছিল কোন এক চৈত্র মাসে।

কলেরার ভয়ে ভীত গ্রামবাসী জানতো না কি করলে তাদের রক্ষা মিলবে এ রোগ থেকে। স্থানীয় মসজিদের "ইমাম" ও গাঁয়ের "কারি" সাহেব সবাইকে বলতো এটা "ওবা" নামক জনৈক অশরিরি আত্মার কাজ। যে বাড়ির কাছ দিয়ে এ ওবা যায়, সে বাড়ির মানুষই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। তাই দুপুরে বা সন্ধ্যায় আমরা সাধারণত ওবার ভয়ে ঘর থেকে বের হতাম না, কারণ "ইমাম/কারি" বলতেন ওবা দুপুরে ও সন্ধ্যার প্রাক্কালে চলাচল করে। প্রতি বছর চৈত্র মাস এলেই মরার ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরতো, মাসটি শেষ হলে মনে করতাম আরেক বছর অন্তত বাঁচবো।

গ্রামের অনেকেই চাঁদা তুলে ফান্ড করলো ইমাম আর কারির পরামর্শে। যারা টাকা দিল ইমাম আর কারি সারারাত হ্যারিকেন নিয়ে তাদের বাড়ির চারপাশে ডাকডাকি করতো "হাই হুই" করে। জোরে জোরে একটা মন্ত্র তারা বাড়ির চারপাশে পড়তো যা এতোদিনেও আমার মনে আছে। আর তা ছিল, "আবদুল্লা কা পুত্র, আমিনা কা জায়া, ভাগরে ওবা, মহম্মদ মেরা ঘরবে আয়া"। সারারাত এভাবে ওবা তাড়াতো আর ঘরের চার কোনে চারটা মাটির হাড়ি পুতে রাখতো ওবা নিরোধক হিসেবে। কিন্তু তারপরও ঐ মন্ত্র আর হাড়ি ভেঙে মাঝে মাঝে ওবা কলেরা দিয়ে মানুষ ছিনিয়ে নিতো। তারপরো তাদের মন্ত্র ব্যবসা জমজমাট ছিল অনেক বছর অন্তত চৈত্র মাসে।

হঠাৎ বিশেষ এক ব্যক্তি আর সংগঠনের উদ্যোগে প্রথম বাজারে আর স্কুলগুলোতে বসানো হলে গভীর নলকুপ। বিশুদ্ধ পানি পানের সুফলও বর্ণনা করলো সংগঠনটি। অনেক মানুষই দুর দুরান্ত থেকে এসে বাজার আর স্কুল থেক পানি নেয়া শুরু করলো কলসি ভরে। দেখা গেল যারা নলকুপের পানি পান করছে তাদের উপর ওবার দৃষ্টি পড়ছে না, উল্টো যারা তখনো খালের পানি পান করতো তাদের ঘরেই কলেরা লাগতো। আস্তে আস্তে অনেক মানুষ নলকুপের পানি পান করা শুরু করলো, কলেরা কমতে লাগলো।

এখন ঐ দ্বীপগাঁয়ের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই বসানো হয়েছে গভীর নলকুপ। প্রায় সকল মানুষই এখন নলকুপের পানি পান করে। খালের পানি কেউই কোন খাবারেও ব্যবহার করেনা। কাচা টয়লেট নেই বললেই চলে, অনেকের বাড়িতেই রিং দিয়ে বসানো আধা সেনিটারি টয়লেট। পাকা টয়লেটও চোখে পড়ে অন্তত ১০% মানুষের বাড়িতে।

ইমাম আর কারি গংদের কথা এখন আর কেউ তেমন মানছে না। তারা শিশুদের নানাবিধ রোগের ভ্যাকসিন দেয়, ডায়েরিয়া হলে খাবার স্যালাইন তৈরি করতে জানে প্রায় সকল জেলেনি আর কৃষাণি। তাই ওবা ওখানে পাত্তা না পেয়ে অন্যত্র চলে গেছে। গরিব গ্রামীণ মানুষের এ সচেতনায় আমি আন্দোলিত হই। ধর্মান্ধরা যত তাড়াতাড়ি সমাজ থেকে বিদায় নেবে, তত তাড়াতাড়ি সমাজ আর ব্যক্তির উন্নয়ন ঘটবে, এ বোধ ক্রমশ জাগ্রতে হচ্ছে মানুষের মনে। কিন্তু বর্ণিত ওবা তাড়ানো গোষ্ঠী এখনো নতুন অবয়বে, নতুন চেহারায়, নুতন ব্যবসায়ে নিমজ্জিত এ অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ আর সমাজে। কবে মানুষ জেগে উঠবে এদেের বিরুদ্ধে ?


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন