সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ভারতকে দোষারোপ না করে পানি সমস্যার যৌক্তিক সমাধান # ১২৭

ভারতকে দোষারোপ না করে পানি সমস্যার যৌক্তিক সমাধান 
বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে। বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এ বন্যার নানাবিধ কারণ থাকলেও, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও তাদের মিডিয়াগুলোর ব্যাপক প্রচারের কারণে  সাধারণ অনেক বংলাদেশী শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ নির্বিশেষে বিশ্বাস করে যে, ‘‘বর্ষা মৌসুমে ভারত ফারাক্কা বঁাধ খুলে দিয়ে, তাদের দেশের অতিরিক্ত পানিকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারছে, যেমন শুকিয়ে মারছে শুকনো মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধ আটকে রেখে বাংলাদেশের পদ্মা নদী দিয়ে পর্যাপ্ত পানি আসতে না দিয়ে’’। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ‘টিপাইমুখ’ বঁাধ প্রকল্প। ভারত বিরোধী গোষ্ঠীর ব্যাপক প্রচারে অনেক বাংলাদেশী মনে করতে শুরু করেছে যে, ‘টিপাইমুখ’ বঁাধ আরেকটি ‘ফারাক্কা’ যা মূলত বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার নতুন ষড়যন্ত্র। আর এ বিশ্বাসের কারণে অনেক বাংলাদেশী মানুষ ভারতকে তাদের প্রতিবেশী ‘বন্ধু’ দেশের পরিবর্তে ‘শত্রু’ দেশ হিসেনে মনে করে থাকে, যদিও যৌক্তিকভাবে কথাটি বিশ্লেষণের দাবী রাখে যে, এর পেছনে সত্যতা কতটুকু। আর এ সত্যতা বিশ্লেষণে বাংলাদেশ-ভারত পানি সমস্যায় ভারতকে কতটুকু ‘দোষী’ করা যায়, তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। দেখা যাক, ঘটনার গভীরে প্রবেশ করে।
 
প্রথমে দেখা যাক শুকনো মৌসুমে গঙ্গার পানি স্বল্পতা প্রসঙ্গে। যেহেতু এই অঞ্চলে শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি হয়না, শীতের কারণে গঙ্গার উৎসস্থল ‘হিমালয়ে’ বরফ জমে থাকে, তাই সঙ্গত কারণেই ঐ সময়ে জল-প্রবাহ দু’অঞ্চলের স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল থাকে বিধায়, কোন অঞ্চলই তার চাহিদা মোতাবেক পর্যাপ্ত সরবরাহ ঐ সময় পায়না। আর পানি প্রবাহের স্বল্পতার কারণে ভারত যদি ঐ সময় ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে তার চাহিদা মোতাবেক পানি ধরে না রাখে, তবে তার দেশের সেচ সুবিধা ছাড়াও কোলকাতা বন্দর বন্ধের উপক্রম হবে। যদিও এ কথা সত্য যে, ঐ সময় বাংলাদেশেও পানি স্বল্পতার কারণে তাদের চাহিদামত পানি পায়না। কিন্তু সাধারণ নিয়ম হচ্ছে চাহিদামত ‘যোগান’ না থাকলে একটি পরিবারও কম বা পরিমিত বন্টনের নীতি গ্রহণ করে, কম ভোগের মাধ্যমে তার চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রেও শুকনো মৌসুমে পানির ‘যোগান’ প্রকৃত চাহিদার তুলনায় ‘কম’ থাকাতে বাংলাদেশ-ভারত উভয়ের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে ‘পরিমিত’ বন্টনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে এটিই যৌক্তিক। কিন্তু এই যুক্তির ধারে-কাছে না গিয়ে আমাদের ভারত বিদ্বেষী ইসলামের নামধারী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে সাধারণ বাংলাদেশীদের ভারত বিদ্বেষী করে তুলছে, যদিও ইসলামে সেচ ও পানি স্বল্পতা হলে করণীয় সম্পর্কে হাদিসগ্রন্থ ‘বোখারী শরীফে’ সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে নিম্নরূপভাবেঃ

মদিনার কৃষি জমিতে জনৈক মক্কাবাসী ও মদিনাবাসীর মধ্যে পানিসেচ নিয়ে বিবাদ শুরু হলে ইসলামের নবী মহাম্মদ (সঃ) নির্দেশ দিলেন, ‘‘যার জমি উঁচুতে ও প্রথম শুরু হয়েছে, সে পর্যাপ্ত পানি নেয়ার পরই পরবর্তী জমির মালিক পানি সেচের সুবিধা পাবে’’-(সূত্রঃ বোখারী শরীফে হাদিস নং ২১৮৮ ও ২১৮৯) এই হাদিস ব্যাখ্যা করলে উচঁু তথা উজানে তথা উৎসমূলে ভারতের অবস্থান বিধায় বাংলাদেশের পানির প্রাপ্যতা কতটুকু তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ ভারতের ‘পর্যাপ্ত’ জল-চাহিদা মেটানোর পর বাংলাদেশকে দেয়ার মত ‘পর্যাপ্ত’ পানি কি আর শুকেনো মৌসুমে অবশিষ্ট থাকে? একজন বাংলাদেশী হিসেবে বিষয়টি বাংলাদেশের অমৌলবাদী শিিক্ষত মানুষদের উপলব্ধি করার অনুরোধ জানাই।

আর বর্ষার বন্যার ব্যাপারে এখন প্রায় সকল পানি বিশেষজ্ঞ একমত যে, ‘গ্রিনহাউস’ ইফেক্ট তথা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, তাইওয়ান, লাওস, ভিয়েতনামসহ সাগরপারের অনেক দেশই এখন প্রতি বছর বন্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বন্যার জন্যে যেমন ভারত দায়ী নয়, তেমনি ভারতে বন্যার জন্যে দায়ী নয় চীন কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে আমাদের মৌলবাদী গোষ্ঠীর দাবী হচ্ছে, ‘ভারত কেন বর্ষা মৌসুমে পানি না আটকিয়ে ছেড়ে দিয়ে আমাদেরকে ডুবিয়ে মারছে’? তাহলে ভারত কি বর্ষার প্রচুর বন্যার ঢল আটকে রেখে তাদের দেশকে ডুবিয়ে মারবে? এমনকি তাদের কোলকাতা বন্দর ডুবে গেলেও? এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের স্থানে হলে কি তাই করতো?

এবার দেখা যাক সাম্প্রতিক ইস্যু ‘টিপাইমুখ’ বাঁধ প্রসঙ্গে। ইন্টারনেট, পত্র-পত্রিকা ও সম্প্রতি বাংলাদেশের ঘুরে আসা ‘সংসদীয় কমিটি’ থেকে যে সকল তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায়, এ উপমহাদেশের হিমালয়ের নদীগুলোতে কেবল ভারত নয়, অন্যান্য বেশ কয়েকটি ‘দেশ’ তৈরী করছে তাদের সুবিধামত ‘জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প’। ভারত ছাড়াও পাকিসত্মান মোট ৩৫টি, নেপাল ৫৪টি, ভুটান ২১টি এবং চীন তৈরী করছে অসংখ্য জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প, যদিও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ করেছে মাত্র ১টি (কাপ্তাই)। অর্থাৎ চীন বাদে বর্ণিত দেশ ক’টি সব মিলিয়ে ৫৫৩টি জল বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে হাত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত তার দেশের সমগ্র এলাকা জুড়ে মোট ৪২৯টি জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিলেও ‘টিপাইমুখ’ তার মধ্যে একটি। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ২১০ কিমি দূরত্বে ‘বরাক-টুইবাই’ নদীর মোহনায় বাঁধ দিয়ে ভারত এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এ ক্ষেত্রে এ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপিত হলে ভাটিতে নয় বরং ভারতের উজানে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কারণ জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প ফারাক্কা বাঁধের মত শুকনো মৌসুমে পানি আটকে সেচ বা কোলকাতা বন্দর চালু রাখার কোন প্রকল্প নয়, এটি হচ্ছে শুকনো ও বর্ষা মৌসুমে মানে সব ঋতুতে সম পানি প্রবাহের মাধ্যমে প্রকল্পের ‘টারবাইনগুলো’ সচল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্যে পানি প্রবাহ বন্ধ করলে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কিভাবে? বরং ভারতকে তার প্রকল্পের নিজস্ব স্বার্থেই সব ঋতুতে যেহেতু পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, সে ক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ সব সময়ই পানি প্রবাহের সুবিধা পাবে বলেই মনে হচ্ছে। আর বাঁধ চালু হলে ‘টিপাইমুখের’ উজানে বরং কৃত্রিম জলাধার সৃষ্টির কারণে অনেক জনপদ তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যেমন ভারতের ‘উত্তরখন্ডে’ ১-হাজার মেঘাওয়াটের জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের কারণে ‘ডেইরী’ শহরসহ ৩৭টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার নেপালের ‘কালিগন্ডকী’ প্রকল্পের কারণে হিন্দু তীর্থস্থান ‘শালগ্রাম শিলা’র একই পরিণতি হয়েছে। যেমন আমাদের ‘কাপ্তাই’ বাঁধের কারণে যেভাবে কাপ্তাই হৃদের সৃষ্টি হয়ে ক্ষতি হয়েছিল ‘চাকমা’ জনবসতি। বর্ণিত জল-বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভাটিতে কিন্তু কোন এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনায় আনা উচিত ভারত যা করছে তা কি আমাদের ক্ষতির জন্যে? নাকি তার দেশের চাহিদার জন্যে? ভারতে এখন বিদ্যুৎ চাহিদা ১লাখ ৮ হাজার ৮৮৬ মেঘাওয়াট, যার মধ্যে বর্তমান ঘাটতি ১৮ হাজার ৯৩ মেঘাওয়াট। ভারত দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করছে আগামী দিনগুলোতে সে জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ১,২৬,৫৮৮ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, যদিও সে এখন উৎপাদন করছে মাত্র ১৯,৬৪১ মেঘাওয়াট। হ্যা, আন্তদেশীয় অভিন্ন নদীগুলোর এক তরফা পানি প্রত্যাহার হলে সংশিøষ্ট দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের ব্যাপারে আমাদের ভারত বিদ্বেষী গোষ্ঠী তৎপর হলেও চীন সম্প্রতি তাদের ‘সাংপো’ (আমাদের ব্রম্মপুত্র) নদীর প্রবাহ ঘুরিয়ে দেয়ার যে পরিকল্পনা করছে সে ব্যাপারে আমাদের দেশের কেউ কিন্তু আপাত কোন কথা বলছে না।

এ ব্যাপারে আমাদের উচিত বাস্তবায়তায় ফিরে আসা। ভারত যখন তার দেশের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে ‘পিয়াজ’ বা ‘চাল’ রপ্তানী বন্ধ করে দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে পিয়াজ/চালের দাম বেড়ে যায়, তখন আমরা ‘ভারত আমাদের পিয়াজ/চাল রপ্তানী বন্ধ করে কষ্ট দিতে চাইছে’ বলি কিন্তু বলিনা যে, আমাদের নিজেদের পিয়াজ ও চাল উৎপাদন বাড়িয়ে ভারত থেকে যেন আমদানী করতে না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। শুকনো মৌসুমে পানির সমস্যা সমাধানের জন্যে আমাদের উত্তরাঞ্চলে বড় বড় ‘জলাধার’ নির্মাণ ও বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধের জন্যে ‘ড্রেজিং’ করে আমাদের নদীগুলোর ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কিন্তু তা না করে আমরা যদি কেবল ভারতকে ‘গালি’ দিতে থাকি এবং ‘হ্যান-করেঙ্গা, ত্যান-করেঙ্গা’ বলে ভারতকে খ্যাপাতে থাকি, তবে কি আমাদের সমস্যার সমাধান হবে? কেবল ভারতের সঙ্গে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করে সমঝোতার মাধ্যমে আমাদের পানি বন্টন সমস্যার সমাধান হতে পারে, যা মূলত ভারতেরও একটি অন্যতম সমস্যা। বুখারী শরীফের হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারত যদি আমাদের পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, তবে আমরা কি করবো চিন্তা করে দেখা দরকার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন