রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মুসলমান বাঙালির অবৈজ্ঞানিক হাস্যকর নাম ও বিড়ম্বনা # ১০৮


মুসলমান বাঙালির অবৈজ্ঞানিক হাস্যকর নাম ও বিড়ম্বনা

কথিত আছে, মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক বিমানবন্দরে জনৈক বাংলাদেশীর নাম জানতে চাইলে পাসপোর্টধারী ব্যক্তি তার নাম ‘জামাল মিয়া’ (জামাল=উট, মিয়া=১০০ সুতরাং জামাল মিয়া মানে হচ্ছে ১০০ উট) এবং পিতার নাম ‘তরিক মিয়া (তরিক=রাস্তা, মানে ১০০-উটের বাবার নাম ১০০ রাস্তা) জানালে বিমানবন্দরে হাসির রোল ওঠে এবং বাংলাদেশী মানুষের নামের ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবজ্ঞাসূচক হাস্যকর কথাবার্তা বলা শুরু হয়। এ ব্যাপারে বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের নাম আসলেই কতোটা অবৈজ্ঞানিক এবং ‘হাস্যকর’ তার কিছুটা খোঁজ নেয়া যাক (যদিও এদেশের কারো কারো আরবি নাম অত্যন্ত অর্থবোধক এবং শ্রুতি মধুর)।

বর্তমানে বিদেশ ভ্রমণের জন্যে ভিসাপ্রাপ্তির ফরম ছাড়াও, আন্তর্জাতিক সর্বজন গ্রহণযোগ্য যে কোন ফরমে ‘সার-নেইম, মিডেল নেইম এবং ফ্যামেলি নেইম’ ইত্যাদির ঘর থাকে। কিন্তু বাংলাদেশীদের নামগুলো এমন অদ্ভুত যে, বর্ণিত ফরমে কে, কোথায় কোন্ নামটি বসাবে, তা নিয়ে রীতিমত সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন আমি যে গ্রামে বাস করতাম, সেখানে জনৈক ব্যক্তির নাম ছিল ‘ছনু’ এবং তার পিতার নাম ছিল ‘ধনু’, আবার এদেশের অনেকের নাম হচ্ছে, আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাসিম কিংবা আবু নাইম মোহাম্মদ বাশারাত উল্লাহ খন্দকার। পিতা ও ফ্যামেলি নাম আবার ভিন্ন। ‘দৈনিক আল ইহসান’ পত্রিকায় দেখলাম, ঐ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষকের নাম হচ্ছে ‘হযরত ইমাম সাইয়্যিদ মুহম্মদ দিল্লুর রহমান আল হাসানী ওয়াল হুসাইনী ওয়াল কুরাঈশী’, আবার এদেশের প্রায় প্রত্যেক মুসলমানের নামের প্রথমেই অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে লাগানো হচ্ছে মোঃ, যার সংক্ষিপ্ত ইংরেজি রূপ লেখা হয় MD হিসেবে। অথচ MD বলতে বিদেশে অনেকেই বুঝে থাকে Doctor of Medicine.

আর মুসলমান হলেই তার নামের আগে মোঃ লাগাতে হবে, এরূপ কোন উদাহরণ ইসলামে নেই। যেমন ইসলামের চার খলিফা এবং সাহাবাদের কারো নামের পূর্বেই মোঃ আবুবকর, মোঃ ওমর, মোঃ ওসমান এবং মোঃ আলী কিংবা সাহাবা ‘আবুজর আল গিফারী’র নামের পূর্বে ‘মোহাম্মদ’ বসানো হয়নি। আগের মত বর্তমানেও আরবের নামগুলোতে একটি ‘বৈজ্ঞানিক রীতি’ অনুসরণ করা হয়, যেমন ‘আহম্মেদ সালাম আল-সায়ের’ অথবা হামাদ সুবাহ আল-ঘামদী । এখানে ‘আহম্মেদ’ হচ্ছে ব্যক্তির নাম, ‘সালাম’ হচ্ছে তার বাবার নাম এবং ‘আল-সায়ের’ হচ্ছে ফ্যামেলি বা গোত্রনাম। কিন্তু আমরা বাঙালি মুসলমানরা আরবি ভাষা ভাল করে না বুঝে কিংবা নামের উচ্চারণ ও অর্থ না বুঝেই নামকে বিকৃত করি। যেমন আরবি ‘সামস আল দীন’ মানে হচ্ছে ধর্মের সূর্য কিন্তু আমরা বলি ‘সামছুদ্দিন’, আবার ‘দলিল আল দীন’ মানে হচ্ছে ধর্মের প্রমাণ, আমরা বলি ‘দলিলুদ্দিন’ এভাবে ‘আবদ্ আল মালেক’-কে আমরা বলি আবদুল মালেক, হারুন আল রশীদকে বলি, হারুন অর রশীদ ইত্যাদি।

অথচ আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব দেশের নামগুলোই হচ্ছে অনেকটা বৈজ্ঞানিক তথা যৌক্তিক। কোরিয়ান কোন ব্যক্তির নাম অবশ্যই হবে ৩-শব্দের, যেমন ‘কিম জং ইল’, এখানে ‘কিম’ হচ্ছে ব্যক্তির নাম ‘জং’ তার বাবার নাম এবং ‘ইল’ হচ্ছে পরিবারের নাম। এভাবে রাশিয়ান ‘ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন’, চাইনিজ ‘Tsang Yam kuen’, ইসরায়েলী হিব্রু নাম ‘বিন ইয়ামেন নেতানইয়াহু’, আর ইতালীয় ভাষায় ঐভাবে, ‘আরমে সাইউরেত্তা ফ্রানচিস্কা’, থাই নাম তাদের রীতি অনুসারে ‘মা খিন সু’, বৃটিশ নাম ‘মিলি ইয়াং কুক’ এমনকি বিশ্বখ্যাত ‘চে গুয়েভারার’ প্রকৃত নাম হচ্ছে ‘আর্নেসেন্তা চে গুয়োভারা’ কিন্তু তারপরও বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নামও বেশ অর্থপূর্ণ। যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা ঈশ্বর চন্দ্র জলদাস।

বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান অনেকের নামের সঙ্গেই ফ্যামেলী নাম হিসেবে পদবী ব্যবহার করা হয়। যেমন তালুকদার, হাওলাদার, দফাদার, চৌধুরী, বেপারী, সরকার, ঠাকুর, কুমার, দাস, ধোপা, শীল ইত্যাদি। আধুনিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী স্বাধীন পেশাধারী সমাজে কারো নামের সঙ্গে বেপারী, চৌকিদার, সিকদার, দাস, ধোপা, নাপিত, দফাদার ইত্যাদি ব্যবহারে মানুষের ব্যক্তিমর্যাদাকে খাটো করা হয় কিংবা অহেতুক উপরে তোলার হাস্যকর চেষ্টা করা হয় বিধায় নামের সঙ্গে এগুলো পরিত্যাজ্য। অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজ্ব সমাপনান্তে নামের সঙ্গে ‘আলহাজ্ব’ শব্দ ব্যবহার করেন। আলহাজ্ব মানে হচ্ছে ‘হজ্ব সম্পন্নকারী’, এভাবে সকল মুসলমানই প্রকৃতপক্ষে নামাজ ও রোজা সম্পন্নকারী কিন্তু তা কি এভাবে ‘খেতাব’ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য?

আরবের মুসলমানগণ কখনো ‘আলহাজ্ব’ শব্দ নামের সঙ্গে ব্যবহার করেন না। তারা বলে, ইসলামে এই জাতীয় কিছু ‘প্রদর্শন করা’ গুণাহ বা ‘পাপ’, আবার আমরা বাবার নাম হিসেবে মৃত বৃক্তির নাম লিখতে গিয়ে ‘মৃত আবদুল মন্নান’ বা ‘Late’ Rabeya Khatun লিখি, যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে কর্মরত আমাদের শ্রমিকদের যে সমস্যাটি হয় তা হচ্ছে, ঐসব দেশের আইডি কার্ডে কারো কারো নামের সঙ্গে নামে শুধু Late যুক্ত হওয়া। যেমন ‘আবুল কালাম’ পাসপোর্টে পিতা ‘Late আবুল হোসেন’ এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আইডি কার্ড বানানোর সময় তাদের রীতি অনুসারে ‘আবুল কালাম লেট’ লেখা হয়, কারণ পিতার প্রথম নামটি কার্ডধারী ব্যক্তির নামের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ওখানের রীতি অনুসারে। আসলে আমরা অজ্ঞতাবসত অনেক কিছু করে ফেলি নিজেদের অজান্তে।

সেক্ষেত্রে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের নামগুলো কম্পিউটারে ইনপুটযোগ্য, সামঞ্জস্যপূর্ণ, যৌক্তিক, অর্থবোধক ও বিজ্ঞানভিত্তিক করার জন্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে সরকারের উচিত কোন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি, আর নাগরিকের উচিত তার সস্তানের জটিল নাম পরিহার করে ৩-শব্দ বিশিষ্ট সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখা।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন