রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাঙালি এক বিস্ময়কর জাতি ! ভাষা আর উচ্চারণেও বৈপরিত্য বাঙালি চরিত্রের !! # ১০৩

বাঙালি এক বিস্ময়কর জাতি !
ভাষা আর উচ্চারণেও বৈপরিত্য বাঙালি চরিত্রের !!

বৈশ্বিক পৃথিবীর বাস্তবতায় বাঙালি এখনো ঘরকুনো ব্যাঙ হলেও, কথায় ঢাকাইয়া আর কোলকাতার বাঙালি যেন গ্রহ নক্ষত্র জয় করে ফেলেছে সব মহাবিশ্বের। এই সেদিন জেলেপ্রধান ফরমোজাবাসীগণ তাদের দেশের নাম তাইওয়ান রেখে, তাদের জেলে সন্তানদের কিভাবে কম্পিউটার প্রোগ্রামার বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, তা তাইপে শহরে না গেলে বোঝাই যাবে না। যে কারণে তাইপের একটা সবজির দোকানেও এখন কম্পিউটার পরিচালিত সবজি বিক্রেতা লাখ টাকা বেতনে জব করছে। কিন্তু কথায় রাজা উজির মারছে কেবল কোলকাতা আর ঢাকাইয়ারা।

কথা কাজে ও বাস্তবতায় সর্বত্র বৈপরিত্য বাঙালি চরিত্রে। ভাষা ব্যবহারেও তার ব্যতিক্রম নয়। অনেক জিনিস তাদের ধার করা বিশ্ব থেকে। আপেল চেয়ার টেবিল ফ্যাক্স বুলেট কিছুই ছিলনা বাঙালির। মাত্র ৪৭-টা ‘দেশি শব্দ’ পাওয়া গেছে “বাঙলা ভাষায়”। তাস খেলার নামও বাঙালি ধার এনেছে পর্তুগিজ থেকে, আর তাস খেলার সময় চা পান করলো চীন দেশের। সাথে চিনিও আনলো সেখান থেকে। সংস্কৃত ভাষা থেকে ধার না পেলে বাঙালিরা কথাই বলতে পারতো না। অথচ কি অকৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি! মূল ধারপ্রদানকারী “ভাষা ব্যাংক” সংস্কৃত থেকে ধারকৃত তথা আগত শব্দগুলো হিন্দি ভাষিকরা সংস্কৃতের মত উচ্চারণ করলেও, বাঙালিরা নকল করছে হুবহু সংস্কৃতের মতই কিন্তু উচ্চারণ করছে একদম নিজস্ব স্টাইলে। ভাষার নিজস্ব বাকশক্তি থাকলে অবশ্যই ওসব শব্দমালারা বাঙালির টুটি চেপে ধরতো বিকৃত উচ্চারণের সময়। যদিও ভারতীয় হিন্দি ভাষিকগণও অনেক শব্দ ধার নিয়েছিল ভাষা-মা সংস্কৃত থেকে কিন্তু তারা বাঙালির মত অকৃতজ্ঞতা দেখায়নি মাকে। দেখা যাক অকৃতজ্ঞ বাঙালির এমন কিছু উদাহরণ :

শিক্ষাকে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে শিক্ষা এবং লিখেও শিক্ষা, আর বাঙালি উচ্চারণ করে শিখ্খা কিন্তু লিখে শিকষা; আত্মাকে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে আত্মা এবং লিখেও আতমা (যেমন আতমা রাম), আর বাঙালি উচ্চারণ করে আততা কিন্তু লিখে আত্মা; পদ্মাকে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে পদমা এবং লিখেও পদ্মা, আর বাঙালি উচ্চারণ করে পদদা কিন্তু লিখে পদ্মা; শ্মশানকে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে মশান এবং লিখেও শ্মশান , আর বাঙালি উচ্চারণ করে সসান কিন্তু লিখে শ্মশান ; যোগকে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে ইয়োগ এবং লিখেও যোগ , আর বাঙালি উচ্চারণ করে জোগ কিন্তু লিখে যোগ; ইক্ষুকে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে ইকষু্ এবং লিখেও ইক্ষু , আর বাঙালি উচ্চারণ করে ইখখু কিন্তু লিখে ইকষু; আকাঙক্ষা কে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে আকাংকষা এবং লিখেও আকাঙক্ষা , আর বাঙালি উচ্চারণ করে আকাংখা কিন্তু লিখে আকাঙক্ষা; ক্ষেত কে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে কেষত এবং লিখেও ক্ষেত, আর বাঙালি উচ্চারণ করে খেত কিন্তু লিখে ক্ষেত; রানীকে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে রানঈ এবং লিখেও রানী , আর বাঙালি উচ্চারণ করে রানি কিন্তু লিখে রানী ; অলঙ্কারকে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে অলমকার এবং লিখেও অলঙ্কার , আর বাঙালি উচ্চারণ করে অলংকার কিন্তু লিখে অলঙ্কার ; উপর্যুক্ত কে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে উপরিউক্তো এবং লিখেও উপর্যুক্ত; আর বাঙালি উচ্চারণ করে উপরজুক্তো কিন্তু লিখে উপর্যুক্ত ; কার্যক্রমকে হিন্দি ভাষিকরা উচ্চারণ করে কারইওক্রম এবং লিখেও কার্যক্রম; আর বাঙালি উচ্চারণ করে কারজোক্রোম কিন্তু লিখে কার্যক্রম।

একইভাবে বাঙালিরা লেখে স্বভাব কিন্তু উচ্চারণ করে সভাব, লেখে লক্ষ্য কিন্তু উচ্চারণ করে লখখো, লেখে দ্বিগুণ উচ্চারণ করে দিগুন, লেখে দ্বন্দ্ব উচ্চারণ করে দনধো, লেখে তেলাপোকা উচ্চারণ করে ত্যালাপোকা, লেখে আঁচিল উচ্চারণ করে আচিল, লেখে আশ্রম উচ্চারণ করে আসরোম, লেখে ঈদ উচ্চারণ করে ইদ, লেখে ইন্তাকাল উচ্চারণ করে ইনতেকাল, লেখে ঈর্ষ্যা উচ্চারণ করে ইরসা, লেখে ঈশ্বর উচ্চারণ করে ইসসোর, লেখে উচ্ছ্বাস উচ্চারণ করে উচছাস, লেখে উজ্জ্বল উচ্চারণ করে উজজল, লেখে উড়া উচ্চারণ করে উরা, লেখে কক্ষ উচ্চারণ করে কখখো, লেখে কাঁচকলা উচ্চারণ করে কাচকলা, লেখে ও উচ্চারণ করে যথাক্রমে কুমড়ো>কুমরো; গাঢ়>গারো; জ্বালাতন>জালাতন; ঝাঁপ>ঝাপ; ঢেঁকি>ডেকি; দাঁড়ী (দাঁড় টানে যে)>দারি; দূষণ>দুসন; দ্বৈবার্ষিক>দৈবারসিক; দ্বীপ>দিপ; বাড়ি>বারি; ধ্বন্যাত্মক>ধনাততোক; কর্জ>করজো; এবং লেখে প্রৌঢ় আর উচ্চারণ করে পৌরো।বাঙালিরা কি কখনো ড+হ+র=ঢ়, ড+র=ড় উচ্চারণ করেছে নিজ ভাষায়? যদি নাই করে থাকে তবে লেখার এসব ভনিতা কেন? রূঢ় কে রুরো লিখে ফেলুক না? অন্তত কথা আর কাজের মাঝে কিছুটা হলেও মিলবে বাঙালি চরিত্র। না হলে রাস্তাঘাটের বাঙালি চরিত্রের প্রকাশ থাকবে তার ব্যবহৃত ভাষাটিতেও। একজন বাঙলা ভাষিক মানুষ হিসেবে এ দুখ বয়ে বেড়াচ্ছি ভাষাজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই। অতএব বাঙলা ভাষিক গোষ্ঠীর আম জনতা, চলুন হয় সংস্কৃতের মত মূল শব্দ উচ্চারণ করি (যা অসম্ভব এ জাতির কাছে) অথবা বানানকে বাঙলা উচ্চারণের মত ঠিক করে লিখি। অন্তত শেষের কাজটা করতে পারি সহজে বাঙালি হিসেবে।

কারো কারো কাছে এমন সংস্কারকে অযৌক্তিক মনে হতে পারে। তাদের জন্যে হারিয়ে যাওয়া হিব্রু ভাষার সত্য ঘটনাটি এখানে বলতে চাইছি। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ টেনে লেখাটা শেষ করতে চাইছি -

ইহুদি জাতির প্রতি নানাজাতির আক্রমনেও ফিলিস্তিনে ইহুদিরা টিকে ছিল তাদের ভাষা নিয়ে। ৬২৩ খ্রীস্টাব্দে মুসলিম আক্রমনে জেরুজালেমের অধিকাংশ ইহুদি নিহত হয় কিংবা ইউরোপে পালিয়ে যায়। ১৯ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ইহুদিরা ইউরোপ-আমেরিকায় ছিল। ১৯ শতকে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালগ্নে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ইহুদিরা ইসরাইলে এসে বসবাস শুরু করে। কিন্তু ঐসব ইহুদিদের কারো ভাষাই হিব্রু ছিল না। কারো রুশ, পো্লিশ, জার্মান, ইংরেজি, ফ্রেন্স বা আরবি ছিল। তখন শুরু হয় ইসরাইলে "ভাষা আ্ন্দোলন"।

আধুনিক কথ্য ভাষা হিসেবে হিব্রুর পুনঃপ্রতিষ্ঠার নেপথ্যে ছিলেন এলিয়েজের বেন ইয়েহুদা নামের এক রুশ-বংশোদ্ভূত ইহুদী। তিনি ১৮৮১ সালে হিব্রু ভাষা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে তৎকালীন উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীন ফিলিস্তিনে আসেন। বেন ইয়েহুদা চাইতেন ফিলিস্তিনে বসবাসরত ইহুদীরা কেবলই হিব্রু ভাষায় কথা বলুক। তিনি হিব্রুকে ঘরে ও বাইরে সমাজের সব ধরনের কাজের চাহিদা মেটাতে সক্ষম একটি ভাষা হিসেবে প্রচলন করার পরিকল্পনা নেন। এজন্য তিনি ইহুদী শিশুরা যাতে ছোটবেলা থেকেই হিব্রুতে শিক্ষা পায়, তার ব্যবস্থা করেন। এভাবে ধীরে ধীরে হিব্রু আবার একটি জীবিত ভাষায় পরিণত হয়।

একদা সমৃদ্ধ হিব্রু ভাষা কার্যত অচল হয়ে যাওয়ার দুই হাজার বছর পর ইহুদিবাদ প্রতিষ্ঠা ও ইসরাইল রাষ্ট্র কায়েমের মধ্য দিয়ে এটি নতুন জীবন পায়। অথচ এ ভাষা সামাজিক জীবনে চালু ছিল না। তারপরও হিব্রু ইসরাইলে জাতীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভাষার ইতিহাসে এ ধরনের দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। কারণ ধ্রুপদ হিব্রু কেবল প্রার্থনার ভাষা হিসেবে ও ধর্মগ্রন্থে সীমিত ছিল। উনবিংশ শতকের শেষভাগে এলিজার বেন এহুদার নেতৃত্বে ব্যাপক প্রচারণা, জাগরণ, ধর্মীয় অনুভূতির ব্যবহার, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ সব পদক্ষেপকে সমন্বিত করার ফল হিসেবে মুখের ভাষা হিসেবে হিব্রুর প্রত্যাবর্তন ঘটতে থাকে। আর সেই হিব্রু, এখন ৭০ লাখ মানুষের ভাষা। বহু আগেই হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের সক্রিয় সহায়তায় ভাষাটির রাজ্য সমপ্রসারিত হচ্ছে। কিন্ডারগার্টেনে শিশুরা হিব্রুতে কথা বলছে, এমনকি ইসরাইলে যাদের মাতৃভাষা আরবি ও হিব্রু তারাও দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। হিব্রু ভাষার এই ফিরে আসা মৃত ও বিপন্ন ভাষায় ফিরে আসার প্রশ্নে একটি মৌলিক শিক্ষা দিয়েছে। আর তা হচ্ছে ভাষাকে ফিরিয়ে আনতে হলে নাগরিকদের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য আবেগ ও উন্মাদনা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সেই আবেগই লক্ষ্য অর্জনে ব্যক্তিকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

হিব্রু ভাষা (হিব্রু ভাষায়: 'Ivrit ইভ্রিত) আফ্রো-এশীয় ভাষা-পরিবারের সেমিটীয় শাখার একটি সদস্য ভাষা। এটি হিব্রু বাইবেল, বা ওল্ড টেস্টামেন্ট তথা তোরাহ-র ভাষা।

হিব্রু বর্ণমালা (হিব্রু ভাষায়:אָלֶף-בֵּית עִבְרִי আলেফ্বেত্ ইভ্রি) ২২টি বর্ণ নিয়ে গঠিত একটি লিখন পদ্ধতি যা হিব্রু ভাষা লিখতে ব্যবহার করা হয়। এদের মধ্যে ৫টি বর্ণ শব্দের শেষ অবস্থানে ভিন্ন রূপ নেয়। হিব্রু লিপির আরও কিছু সামান্য পরিবর্তিত রূপ প্রবাসী ইহুদীদের একাধিক ভাষা লিখতে ব্যবহার করা হয়। এই ভাষাগুলির মধ্যে য়িডিশ ভাষা, লাদিনো ভাষা এবং জুডেয়ো-আরবি ভাষাসমূহ অন্যতম। হিব্রু লিপি ডান থেকে বাম দিকে লেখা হয়।

হিব্রু ভাষার ইতিহাস বৈচিত্র্যময়। নানা কারণে মুখের ভাষা হিসেবে এটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু লিখিত ভাষা হিসেবে এটি আরও বহু শতক টিকে থাকে। এটি ধর্ম, আইন, ব্যবসা, দর্শন ও চিকিৎসা বিষয়ক বহু বই লিখতে ব্যবহৃত হত। ১৯শ শতকের শেষে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কথ্য ভাষা হিসেবে এটির পুনর্জন্ম হয়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে (প্রধানত রাশিয়া থেকে) বর্তমান ইসরায়েলে (তৎকালীন ব্রিটিশ প্যালেস্টাইনে) ইহুদীরা এসে বসতি স্থাপন করেন এবং তাদের নিজস্ব বিভিন্ন মাতৃভাষা যেমন আরবি, ইডিশ, রুশ, ইত্যাদির পরিবর্তে আধুনিক হিব্রু ভাষায় কথা বলা শুরু করেন। ১৯২২ সালে হিব্রু ব্রিটিশ প্যালেস্টাইনের সরকারী ভাষার মর্যাদা পায়।

ইসরায়েলে প্রায় ৭০ লক্ষ লোক হিব্রু ভাষায় কথা বলেন। এছাড়া ফিলিস্তিনী এলাকায় ও বিশ্বের বিভিন্ন ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রায় কয়েক লক্ষ লোক হিব্রুতে কথা বলেন। বর্তমানে আরবি ও ইংরেজির পাশাপাশি হিব্রু ইসরায়েলের সরকারি ভাষা। আরব সেক্টরগুলি বাদে ইসরায়েলের সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি কাজে হিব্রু ব্যবহার করা হয়। সরকারি স্কুলগুলিতে হয় হিব্রু বা আরবি ভাষায় শিক্ষাদান করা হয়, তবে হিব্রু দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া বাধ্যতামূলক। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও হিব্রু ভাষাই শিক্ষাদানের মাধ্যম। ইসরায়েলের সংবাদপত্র, বই, রেডিও ও টেলিভিশনের প্রধান ভাষা হিব্রু।

তো বাঙালিরা কি কিছু শিখতো পারবো ইসরাইলি জাতির কাছ থেকে? ২০০০ বছর পরও তারা তাদের বিলুপ্ত ভাষাকে ফিরিয়ে এনে নিজ দেশ আর জাতির মাঝে এ ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছে রাষ্ট্র ভাষা রূপে? আর ভাষার জন্যে রক্ত দিয়েও আমরা কেবল "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো" গান গেয়ে সময় কাটাবো আর শিখখাকে লিখবো "শিকষা"? কথা আর কাজে এ বিপরিত্য আর কতদিন চলবে আমাদের মাঝে?



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন