শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী : চৈনিক একদলীয় শাসনব্যবস্থা ভার্সাস বাকশাল : ৬৩

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী : চৈনিক একদলীয় শাসনব্যবস্থা ভার্সাস বাকশাল
নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠে কিছুটা দেরি হয়ে গেল। এ গ্রন্থে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাঙালির ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতি-কৃষ্টির প্রতি বঙ্গবন্ধুর একাগ্রচিত্ততা, তাঁর রাষ্ট্রভাবনা, ইতিহাস চেতনা, নেতৃত্ব, নেতৃত্বের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য, মূল্যবোধ, কারাস্মৃতি, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে প্রভেদ ও বৈষম্য, ভাষা-আন্দোলন, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও সংগঠন বিস্তার ইত্যাদি বিস্তারিত বর্ণিত হলেও, একটা বিষয় আমাকে বেশ চমকিত করেছে, আর তা হচ্ছে তাঁর শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে গনচীন ভ্রমন। ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চীন শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। মাও সেতুং-এর দেশ গণচীনে তিনি চীনা মানুষের শিক্ষা, আচার, দেশপ্রেম আর দেশ গড়ার একাগ্রতা দেখে অভিভূত হন, এমনকি পশ্চিমা ব্লেডও তিনি পাননা সেখানে ‘সেভ’ করতে, যেহেতু চীনারা দেশেপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে পশ্চিমা ব্লেডের পরিবর্তে সেভ করেন নিজ দেশের খুর দিয়ে।
একই সঙ্গে তিনি ব্যঙ্গ সমালোচনা করেন বৃটিশ শাসিত প্রতারণাপূর্ণ হংকংয়ের। চীন ভ্রমণ উপলক্ষে তিনি তাঁর এ আদর্শিক অবস্থান ব্যক্ত করেন এভাবে, “... আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিবাদ সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না”। বায়ান্ন সনেই চীন সফরে সাহসী বঙ্গবন্ধু লাখো মানুষের সম্মেলনে তাঁর বাংলায় প্রদত্ত ভাষণে আরো বলেন, “পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধ পরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্ব শান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে- তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে”।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, জনগণের শোষণ মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর কথায়, ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো।’ সে বিশ্বাসকে ধারণ করে স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি ‘সমাজতন্ত্র’কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতেই বিশ্বাসী ছিলেন, পশ্চিমের অবাধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নয়।
এবং এ বিশ্বাসের বলেই তিনি চীনা একদলীয় শাসন ব্যবস্থার মতো বাঙালি জাতির মুক্তির পথ নির্দেশনা হিসেবে প্রবর্তন করেন ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ’ বা বাকশাল।
এখন বামপন্থী (ডানপন্থীতে রূপান্তরিত) জ্ঞানপাপীরা কেবল ‘১-দলীয় বাকশালের’ সমালোচনায় মুখে ফেনা তুললেও, চীনের বিশ্ব কাঁপানো এক দলীয় শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নের চূড়ান্ত শিখায় আরোহণকে দেখে মুখে কুলুপ লাগিয়ে চুপ থাকেন। তখন একবারও বলেনা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা খারাপ বা উন্নয়নের অন্তরায়! হায় এদেশের রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে খেলছে ভন্ড খেলোয়াররা, কবে সাধারণের কাছে উন্মোচিত হবে এদেশের মুখোশ?
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বাঙালি জাতির এক অনুন্মোচিত পথদিশা, যা পাঠককে দেখাতে পারে এক অনারম্ভর নেতার ক্লান্তিহীন পথচলা, যা ধাবিত হয় কেবলই অসাম্প্রদায়িকতা, স্বদেশপ্রেম আর মানবিকতার দিকে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এ লেখকের সঙ্গে কি তুলনীয় হতে পারে এ মাটির, এ নদীর, এ বাতাসের কারো সঙ্গে? কখনোই নয়! এবং অদ্যাবধি জন্মাননি এ মাটিতে তাঁর সমতূল্য কেউ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন