সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

পাজেরো-মার্সিডিজ লালসায় বন্দী এ সমাজ! # ১৪০

পাজেরো-মার্সিডিজ লালসায় বন্দী এ সমাজ! 
একুশ শতকের সভ্যতার লজ্জাজনক দেশের নাম বাংলাদেশ! হোমের আগুনের যজ্ঞাগারে নৈবেদ্য সাজায় এদেশের লাখো গরিব অসহায় মানুষ প্রতিবছর যত্রতত্র। মারাত্মক জীবন সংহারী দুর্ঘটনা ঘটার পরপরই সংশিস্নষ্ট ‘অপরাধী’রা কথার ফুলঝুড়ির বাজি ফোটায় সর্বত্র। তথাকথিত তদন্ত কমিটির নামে উপহাস তথা খেলা হয় কিন্তু মানুষ তার বাস্তবায়ন খুব কমই দেখে পরবর্তীতে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘটে দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত কিন্তু তা প্রতিরোধে সর্বত্র দৃশ্যমান চমকপ্রদ যৌক্তিকতার। বিদেশের একটি যাত্রীবাহী বাসেও পেছনের ‘ইমা©র্জন্সী দরজা’ খোলার ‘আধুনিক শাবল’টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দরজার পাশে একটি ছোট্ট কাচের বাক্সে, যাতে ব্যবহারের নিয়মাবলী লেখা সহজ ভাষায়। এদেশের বাসগুলোতে অতিরিক্ত জরুরী দরজাতো নেই-ই বরং অনেক বাসেই পেছনের সাধারণ দরজাটি টাকা কামানোর সুবিধার্থে ‘ওয়েল্ডিং’ করে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এদেশে এই যে এতো মৃত্যু, তার প্রধান কারণ মূলত আইন না মানা এবং যথাযথ দায়িত্ব পালনের বদলে অর্থ কামানোর পুিজবাদী ভোগবাদী পাজেরো-মার্সিডিজ লালসায় বন্দী এ সমাজ।

পোশাক শিল্পের সাম্প্রতিক তালাবদ্ধ কলাপসিবল গেটকেন্দ্রিক দুর্ঘটনার পরপর একই রীতিতে কমিশন গঠন, নিহতদের পরিবারের ১০-বছরের ভরণপোষণ (বাংলাদেশের মানুষ তা দেখবে কি কখনো?), আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব ‘বিজিএমইএ’ কর্তৃক নেয়ার প্রতিজ্ঞা (কিন্তু মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত মানুষ দেখছে আহত নারীরা ধার করে ইঞ্জেকশন কিনছে কিংবা অর্থাভাবে ভাঙা পায়ে আধুনিক পস্নাস্টারের বদলে হাতুড়ে চিকিৎসার বাঁশের চ্যাড়া জড়াচ্ছে!!!) ইত্যাদি কথার ফুলঝুড়িকে মানুষ ‘ফানুস’ হিসেবে দেখতে চায়না। তাজরিনের মালিক নিজেই মিডিয়ায় বলেছেন, তিনি গার্মেন্ট শ্রমিক থেকে এখন ৬-পোশাককলের মালিক হয়েছেন এবং সিuঁড়ঘর বিগত ২-বছর যাবত গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করলেও কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। তার কান্নাকাটিও মেকি ও মানুষের চোখে ধুলা দেয়ার মতই দেখছেন অনেকে। এক্ষেত্রে হয়তো বিদেশী ক্রেতা ও দাতাদের চাপে ‘বাধ্য হয়ে’ ‘বিজিএমইএ’ কিছু করলেও করতে পারে কিন্তু মালিকপক্ষের নেতিবাচকতা এখনও প্রত্যহ দৃশ্যমান মিডিয়ার কল্যাণে। টিভি ক্যামেরার সামনেই অপরিকল্পিত নির্মাণ, পানির ব্যবস্থা, জরুরী বহির্গমন সিঁড়ি, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, ফায়ার লাইসেন্স, সিঁড়িঘর কাম গোডাউন, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের মেয়াদ, ফায়ার ড্রিলে অসহযোগিতা ইত্যাদি ব্যাপারে জানতে গেলে ফ্যাক্টরীতে সাংবাদিকদের ঢুকতে বঁাধা দেয়ার দৃশ্য সাধারণকে বিস্ময়াভিভূত করে।

শুধু পোশাক শিল্পই নয়, সমাজের সর্বত্রই এ রাক্ষুসে লালসার চিত্র দৃশ্যমান, যা সহজেই আমরা খুঁজে পাবো সমাজের পরতে পরতে। আপনি চলে যান সদরঘাটে বিশালাকার বিলাশবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হাজারো মানুষ ধারণক্ষমতার লঞ্চগুলোতে। প্রতিটি কেবিনে আধুনিক কালার টিভি, কার্পেট, কলিং সার্ভিস ইত্যাদি থাকলেও জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামের সংখ্যা নিতান্তই কম। প্রবেশ ও বের হওয়ার সিঁড়ি তাজরিন গার্মেন্টের চেয়েও সংকীর্ণ। হাজারো মানুষের জন্যে কয়েকটি মাত্র বয়া, আগুন নেভানোর যন্ত্র রাখা হয়েছে শো হিসেবে ২-৪টি মাত্র। নেই কোন লাইফবোট, লাইফ জ্যাকেট, রাডার ইত্যাদি (যা এখন বিদেশের একটি সাধারণ ফিশিং বোটেও দেখা যায়)। যে কারণে একটি লঞ্চ ডুবলে তখন খুব কম মানুষই বাঁচতে পারে। অথচ ধারণ ক্ষমতার সমান প্রত্যেকটি যাত্রীর জন্যে লাইফ সাপোর্ট থাকলে লঞ্চ ডুবলেও মানুষ না মরারই কথা, সবাই ভেসে থাকবে লাইফ সাপোর্ট নিয়ে।

একই কথা আমাদের প্রত্যহ সড়কে চলমান হাজারো বাসের ক্ষেত্রে। ২/১-টি বাস ছাড়া কোন বাসেই ‘জরুরী নির্গমন দরজা’ ও প্রাথমিক চিকিৎসার কোন ঔষধ-যন্ত্রপাতি থাকে না। জানালা, সিটগুলো ভাঙাচোরা হওয়ার কারণে দুর্ঘটনায় জীবন হারায় প্রত্যহ শয়ে শয়ে মানুষ। অনেক বাসেই কোন অতিরিক্ত চাকা না থাকার কারণে রাস্তায় পাঞ্চার হয়ে বাসগুলো দঁাড়ালে ড্রাইভার-কন্ডাকটর এক ফাঁকে সরে পড়ে, আগাম টিকেট কাটা যাত্রীরা এক-আধ ঘন্টা অপেক্ষা করে অন্য বাসের খোঁজে বের হন বাধ্য হয়ে পুন. গাটের পয়সা খরচ করে। বাস্তবতা হচ্ছে লঞ্চে ওঠার ঘাটগুলো অনিরাপদ, বাসস্টেশনে ব্যবহারের মতো ১-টা টয়লেটও পাওয়া যায়না, সিন্ডিকেট সর্বত্র, ইউনিয়ন বা সমিতিগুলো কেবল চাঁদাবাজি আর নিজেদের স্বার্থে কথাবার্তা বলে আখের গোছানোর ধান্ধায়!

গার্মেন্টেসের চেয়েও এখন অনেক বেশি বহুতল আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন ঢাকার যেখানে-সেখানে। ১৫-২০ তলার ভবনেরও অভাব নেই এখন কিন্তু হাজারো মানুষ বসবাসকারী বর্ণিত হাইরাইস ভবনগুলোতে অগ্নিকা- ও ভূমিকম্প হলে কিভাবে বসবাসকারীরা বের হবে ছোট চিকন সিঁড়ি দিয়ে তা তাদেরকে জানাননি নির্মাতা কোম্পানী কিংবা ফায়ারের লোকজন কেউই। অনেক ভবনেই অগ্নিনির্বাপনের কোন জিনিসপত্রই নেই কিংবা ২/১-টি যাও লোক দেখানো আছে, তা ভবন নির্মাণের সময় যেভাবে লাগানো হয়েছিল দীর্ঘ ১০-১৫ বছরেও সেভাবেই বিদ্যমান ব্যবহারের অনুপযোগী হিসেবে। ফায়ার সার্ভিস, পরিদর্শক, ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মানে কিনা তা দেখার মনে হয় কেউ নেই। প্রত্যেকেই জনবলের স্বল্পতার কথা বলে দায় এড়ায় কিংবা একে অপরকে দোষারোপ নীতি গ্রহণ করে এদেশে। 

নির্মাণ ত্রুটি এখন আমাদের সর্বত্র ধরা পড়ে সাধারণের চোখেও। ১০০-বছর আগে নির্মিত কোলকাতার হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন এখনো চকচকে। আমাদের দেশেও বৃটিশ আমলে নির্মিত হার্ডিজ ব্রিজ এখনো কার্যকর। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ কৃতিমানরা নির্মাণের কয়েকদিন পরই ব্রিজ ভেঙে পড়ে, রাস্তার ঢালাই উঠে যায়, ভবন টেকে না ৫০-বছরও কিন্তু দেশের নামকরা প্রকৌশলীদের কেরামতিতে তার বিল পাশ হতে সময় লাগেনা মোটেও। চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারের বিলও হয়তো নিয়ে গেছে কিংবা পেয়ে যাবে নির্মাণকারী কিন্তু মানুষের জীবনের কি হবে? এ দেশের মানুষের জীবন কি একাত্তরের মতোই সস্তা থাকবে চিরকাল? এর মূল্যমান কি নির্ণীত হবেনা বৈশ্বিক মানুষের মাপকাঠীতে?

অথচ এটা সহজ হিসেব-নিকেশের ব্যাপার এ যুগে। সকল পোশাক শিল্প-শ্রমিক, লঞ্চ-বাস যাত্রীর, নির্মাণ ও অন্যবিধ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে জীবনের বীমা উচ্চহারে করা থাকলে অনেকাংশে সমাধান পাওয়া যেতে পারে এ অমানবিক সমস্যার। প্রতিটি মৃত্যুর জন্যে কমপক্ষে ১০-লাখ টাকার বীমা করা থাকলে, মৃত্যুর পর যদি পরিবারটি অন্তত ১০-লাখ টাকার বীমা সুবিধে পায়, তবে বাঁচতে পারবে অসহায় স্বজনরা কিংবা অন্তত কিছুটা স্বান্তনা পাবে পরিবারটি। এ জন্যে পোশাককল মালিক, নির্মাণকারী কট্রাকটর, লঞ্চ ও বাস মালিককে পরিশোধ করতে হবে নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম। যা-ই মূলত তাদের সমস্যা। একজন তাজরিন মালিক পোশাক শ্রমিক থেকে ৬-টি পোশাককলের মালিক কিংবা ১টি সাধারণ বাস-মালিক ৩-বছরে ২০-টি আধুনিক গাড়ির মালিক হলে কিংবা একটি দ্বিতল লঞ্চের মালিক ৫-বছরে ১০-টি লঞ্চের মালিক হলেও ঐ জাতীয় ‘ফালতু প্রিমিয়াম’ পরিশোধে তারা কখনো রাজি হননা। এ ক্ষেত্রে তাদের সমিতিগুলো সকল দায় চাপান সরকারের উপর। যেন তাদের কাজ শুধু যাত্রীদের জীবন নিয়ে ব্যবসা করা, চাঁদাবাজী ও নিজেদের পরিবারের জন্যে লেক্সাস-প্যারাডো কেনা। শুনেছি, কেবল বছরে ২-টি ঈদের সিজনে একটি লঞ্চ যে লাভ করে, তা দিয়ে তারা আরেকটি লঞ্চ বানাতে পারে। 
 
ডিজেলের দাম বেশি হওয়া সত্বেও ভুটান ও ভারতে লঞ্চ-বাস-ট্রেন ভাড়া বাংলাদেশের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। এদেশের যাত্রীরা পাশের দেশের দ্বিগুণের বেশি ভাড়া দিয়েও বীমা সুবিধা পাবেনা কেন? সরকার যদি বাধ্যতামূলক আইনজারী করে পোশাক শ্রমিক, লঞ্চ, বাসযাত্রী ও নির্মাণ দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্যে ন্যূনতম ১০-লাখ টাকা বীমা সুবিধার, তাহলে এ সমস্যা কমতে পারে এবং সমাধান হতে পারে একটি অমানবিক অন্ধকার যুগের! ভোগবাদী মানসিকতা লালনকারী মালিকদের বলবো, আপনার সোনার শরীরটির মতোই অন্য পরিবারের একজন মানুষের জীবনকেও ভাবতে শিখুন, নিজেকে দাঁড় করান তার অবস্থানে, তাহলে হয়তো আপনার বোধোদয় হবে একদিন!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন