শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

আমার ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধমালা # ৪ : ভাষা প্রবন্ধ # ৬০


আমার ভাষা বিষয়ক চিন্তন প্রপঞ্চ # ৪
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা কি কোলকাতা থেকে ধার করা?
(বাঙলা ভাষার আধুনিকায়ন তথা সংস্কার বিয়ষক ১০-টি পোস্টের সিরিজ)

বাংলাদেশে প্রচলিত প্রমিত বাংলা :
"সালাম বাজার থেকে সন্ধ্যেবেলা ফেরার সময় শিয়াল ডেকে উঠলো। আর উপরে রাখা শাড়িটা ইঁদুরে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললো"
বরিশালের ভাষায় :
সালাইমমা আডেগোনে হাউচব্যালা আওয়ার টাইমে হিয়াল ডাইক্কা উঠলো। আর উফরে থোয়া হাড়িডা ইন্দুরে কাইট্টা গুডা গুডা কইরা হালাইলো।
সিলেটি ভাষা- সালাম বাজার থাকি হাইঞ্জাবালা আওয়ার সময় হিয়ালে ডাখ দিয়া উঠলো। আর উফরে রাখা শাড়িটা উন্ধুরে খাটিয়া টুকরা টুকরা খরিলিলো।
নোয়াখালি : সালাইম্যা হানঁজা বাজারোত্তুন হিরনের লগেদি হিয়ালে মেতাই উইটছে ...উর্ফে থুইন্না শারীরে উদুঁরে টুউরা টুউরা করিহালাইছে
সিলেটি : সালাম বাজার তনে হাঞ্জাবালা আওয়ার সময় হিয়াল এইজ্ঞে ডাক মারসে। আর উপরে থোওয়া শাড়িখান ইন্দুরে কাটিয়া টুমা টুমা করিলাইছে।
Anol Ani ফেনি : সালাইম্মা হাঞ্জুইন্না বাজারতুন আইবার সময় হিয়াইল্লা ওগগা চিল্লাই উইটছে। আর ওঁচের শাড়িগান ইন্দুরিয়া কাডি টুরা টুরা করি হালাইছে।
Sharon Kafer চট্টগ্রাম : সালাইম্যা হাঁজইন্যা হাডত্তুন আইবার সমত হিয়াইল্যা ডাক ছাইরগে। আর উওরে রাক্কিলাম দে শাড়ি হিয়ান উন্দুরে কাডি টুওরা টুওরা গরি ফেইল্লে ।
অ-কবি নীল খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় : সালাম বাজারেত্তে সইন্ধেকালে ফিরার সুমায় শিয়েল ডাইকে ওটলো। আর উফরে রাহা শাড়িডা ইন্দুরি কাইটে টুকরো টুকরো কইরে ফেলালো।
মানব বন্ধু চাঁদগাইয়ে : সালাম্মা বাজারত্তুন সন্ধ্যেসন আঁইবার সন ইয়াল ডাহি উট্টি। আঁর উর্দি রাহা শাড়িয়ান অঁদুরে হাডি টুওর টুওর গরি ফেলা-ই।
শুভ মিতা : সালামে বাজারতে হাইজাবেলা অাওনের সুম হিয়াল ডাইক্কা উটলো। অার ওফরে রাহা শাড়িডা ইন্দুরে কাইট্টা কুডি কুডি কইরা লাইলো। (রুপগঞ্জ , নারায়নগঞ্জ)

এভাবে হয়তো বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় উপর্যুক্ত “শুদ্ধ” বাংলাটি রূপান্তর করা হলে ৬৪টি ভাষা আমরা পাবো। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় “প্রমিত” নামে যে ভাষাটি প্রথমে লিখলাম সেটা বাংলাদেশের কোন জেলার ভাষা? চলুন খুঁজে এ প্রশ্নের জবাব-

ভাষা নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। যেহেতু বিশ্বে সম্ভবত আমরাই একমাত্র (?) ভাষার জন্যে লড়াই করেছি এবং এর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে রক্ত দিয়েছি, তাই অন্য বহুবিধ বিষয়ে গর্ব করতে না পারলেও, ‘বাংলা ভাষা’র জন্যে গর্ব করতে কিন্তু আমরা কখনোই পিছনা হইনা। এর কারণও অবোধ্য নয়! যারা সারা বছর কষ্টে-সৃষ্টে জীবন কাটান, তাদের জীবনে ‘ঈদ’ মহা খুশি নিয়ে আসলেও, সারা বছর ‘ঈদ পালনকারি’ বিলাসি মানুষের কাছে ঈদ বা এই জাতিয় বাৎসরিক উৎসবের আনন্দময়তা ঠিক অতটা থাকেনা। তবুও এটা আমাদের ‘শ্লাঘা’র বিষয় যে, দৈন্যতাপূর্ণ আমাদের জীবনে ভাষা আন্দোলন ও ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা একটি মাইল ফলক কিন্তু!

কিন্তু আমরা জানি কি, যে ভাষার জন্যে আমরা (কোলকাতাবাসি নয়) জিবন দিয়েছি (এবং এ লেখাটি যে ভাষায় লিখছি), সে ভাষাটি কিন্তু ‘আমাদের নয়’? আমরা পূর্ববঙ্গিয় তথা বাংলাদেশের ৬৪-টি জেলার কোন মানুষই কখনো এ ভাষা বলা বা লেখায় ব্যবহার করতাম না, এমনকি জানতামও না। বঙ্গ বিভাগের সময় পূর্ববঙ্গে তথা বাংলাদেশ অংশে পুরণো জেলা ছিল ১৭টি, যা বর্তমানে ৬৪টি। এই ৬৪টি জেলার কোন জেলার মানুষই কথা বলার জন্যে বর্তমান বাংলা ‘সাধু’ বা আধুনিক ‘চলিত’ ভাষা ব্যবহার করেনি। উদাহরণ টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। টেকনাফের লোকেরা কি ‘সাধু’ বা ‘চলিত’ বা আধুনিক ‘কথ্য’ বাংলা ভাষায় কথা বলে? আসলে বলে না। তারা ‘চট্টগ্রাম’ ও ‘আরাকানি মিশ্র’ ভাষা ব্যবহার করে। তেতুলিয়ার লোকের উত্তরবঙ্গিয় ঢংয়ে তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে। পশ্চিম-দক্ষিণের খুলনা? সেখানের মানুষের ভাষাও আলাদা খুলনা কেন্দ্রিক একটি আলাদা ভাষা। আর আমরা সবাই জানি সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকাইয়া, রাজশাহী, রংপুর প্রভৃতি জেলার ভাষাগুলোর মধ্যে রূপমূলগত ও ব্যবহারিক পার্থক্য কত! এমনকি চট্টগ্রামের ভাষা ও ফেনীর ভাষা আলাদা হলেও চট্টগ্রামের ‘মিরেশ্বরাই’ উপজেলার ভাষা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বরিশালের ভাষার সঙ্গে নোয়াখালীর ভাষার পার্থক্য প্রকট হলেও, ‘ভোলা’র ভাষাটি আবার না-বরিশালি না-নোয়াখালি অর্থাৎ মিশ্র প্রকৃতির। এমনকি ভোলা ও বরিশালের মধ্যবর্তি স্থানে অবস্থিত বরিশালভুক্ত ‘মেহেন্দিগঞ্জ’ উপজেলার মানুষের কথা শুনে কেউ বুঝতে পারবে না বক্তার বাড়ি বরিশাল, মাদারীপুর বা শরিয়তপুর। যেমন ‘আমি বাজার থেকে এসেছি’ বাক্যটি বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় ‘মুই আডে গোনে আইছি’ হলেও, মেহেন্দিগঞ্জের উপভাষায় এটি ‘আমি বাজারের তোন আইছি’’ হয়। এটি হয়েছে ‘ভাষা জাংশন’-এর সূত্রানুসারে। এমনকি মেহেন্দিগঞ্জের ‘জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন’ ও ‘কাজিরচর’ গ্রাম খালের এপার ওপার হলেও ব্যবহৃত ভাষার রূপগত পার্থক্য সুষ্পষ্ট, যা ভাষা বিশ্লেষকদের গভিরভাবে চিস্তাশিল করবে।

মোদ্দা কথা বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক বিভাজন ৬৪-টি জেলার মধ্যে কমপক্ষে ৬৪-প্রজাতির (উপজেলা হিসেবে আরো বেশি হতে পারে) ভাষা ব্যবহৃত হলেও, যে ভাষাটিকে আমরা বর্তমানে ‘সাধু’ বা আধুনিক ‘চলিত’ ভাষা হিসেবে ব্যবহার করছি, তা কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের কোন অঞ্চল বা জেলার ভাষাই নয়। এ ভাষাটি হচ্ছে ‘কোলকাতা’ শহর তথা সুতোনটি গ্রামের (এখন সেটা মধ্য কোলকাতার একটা মেট্রো ট্রেন স্টেশন) ও তার পার্শ্ববর্তি ‘ভাগিরথি নদি তীরবর্তি’ মানুষের মুখের ভাষা। যা বৃটিশ ভারতে প্রথমে কোলকাতা অঞ্চলে বিদ্যাসাগরের মাধ্যমে সাহিত্যের ভাষা তথা ‘সাধু’ ভাষা হিসেবে প্রবেশ করে। পূর্ববঙ্গে তখনো ঐ ভাষাটির প্রবেশ ঘটেনি। এর পর যশোর থেকে ‘মাইগ্রেটেড’ কোলকাতার আরেক বনেদি অধিবাসি প্রমথ চৌধুরীর মাধ্যমে কোলকাতা ও ভাগিরথি অঞ্চলের ‘কথ্য ভাষা’টি ‘আধুনিক বাংলা’ ভাষা হিসেবে সাহিত্যে স্থান করে নেয়। বৃটিশ ভারতে কোলকাতা যেহেতু ভারতবর্ষের রাজধানি ছিল, তাই রাজধানির প্রভাবশালি ভাষাটি কালক্রমে বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, অফিস-আদালত, দলিল দস্তাবেজ, চিঠিপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে ‘শুদ্ধ’ ভাষা হিসেবে উভয় বাংলার (পূর্ব ও পশ্চিম) মধ্যে বিস্তার লাভ করে। ‘উঁচু জাতে ওঠা’র সুপ্ত বাসনা লালনকারি ‘অকোলকাতা’-বাসি সাধারণ বাঙালিরা ‘গড্ডলিকা’র মত কোলকাতার ভাষাকে গ্রহণ করে এবং বাংলার সর্বত্র তা সাহিত্যের তথা ‘সাধু’ বা ‘শুদ্ধ’ বাংলা হিসেবে লালিত হয়। ‘অকোলকাতা’র আঞ্চলিক বাংলা প্রায় সকল স্থানে এখনো মুখে মুখে রক্ষিত হলেও, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার প্রায় সকল মানুষ কোলকাতার ভাষাটিকে ‘নিজস্ব বাংলা’ বলে গ্রহণ করে নিয়েছেন। ‘কোলকাতার বাংলা’ ভাষাটি সকল বাঙালি কর্তৃক গ্রহণের নেপথ্যে কাজ করেছিল প্রথমত রাজধানি কোলকাতার আধিপত্য ও বনেদিপনা। তা ছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদির কেন্দ্রবিন্দুও কোলকাতা কেন্দ্রিক হওয়া। অপর দিকে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীর মত প্রভাবশালি শিক্ষিত জমিদার ব্যক্তিদ্বয়ের বসবাস কোলকাতা হওয়াতে, তারাও তাদের মুখের ভাষাটিকে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে প্রভাব ফেলেছে দারুণভাবে। এ ক্ষেত্রে যদি ভারতবর্ষের রাজধানি ‘কোলকাতা’ না হয়ে ‘বরিশাল’ বা ‘সিলেট’ হতো এবং রবীন্দ্রনাথ বা এই শ্রেণির সাহিত্যিকের জন্ম কোলকাতা না হয়ে বরিশাল বা সিলেট হতো, তবে হয়তো বরিশাল বা সিলেটের ভায়াটিই আধুনিক বাংলা ‘সাধু’ বা ‘শুদ্ধ’ ভাষা হিসেবে দুই বাংলার সর্বত্র গৃহিত হতো।

তবে শুধু আমরা জেনে রাখলাম, বাংলাদেশের অনেক ‘আমদানি’কৃত জিনিসের মত আমাদের আধুনিক বাংলাটিও কোলকাতার মানুষের ব্যবহৃত ও তাদের মুখের ভাষা থেকে এদেশে ‘আমদানিকৃত’, যদিও বাংলাভাষি মানুষেরা সবসময়ই রাজভাষা হিসেবে অন্যের ভাষা ব্যবহার করেছে শতাব্দির পর শতাব্দি। সে কারণেই হয়তো এখনো আমাদের বিদেশি জিনিসের প্রতি এতো মোহ। এদেশের বাঙালিরা তেইশ বছর রাজভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছে উর্দু, দু’শ বছর ইরেজি, সাড়ে পাঁচ’শ বছর ফার্সি, তার আগে বহিরাগত ভাষা সংস্কৃত, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, কামরূপি আরো কত কি? এখনো আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষা কারো সিলেটি, চট্টগ্রামি, ঢাকাইয়া বা বরিশালি। কিন্তু তা সত্বেও কোলকাতার ভাষাকে সত্যিই আমরা আমাদের ‘মাতৃভাষা’ হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং বিশ্বে সম্ভবত আমরাই এমন একটি ‘ধার’ করা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছি। যে কারণে বিশ্বের অন্যান্য জাতিগুলো ছাড়াও কোলকাতাবাসিগণও আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ‘শ্রদ্ধা’ এবং শ্রদ্ধার সাথে কিঞ্চিৎ ‘ঈর্ষা’ও করে। অতএব বোঝা গেল রাজনৈতিক বাংলাদেশ তথা পূর্ববাংলার মানুষেরা একুশ ফেব্রুয়ারি যে ভাষাটির জন্য রক্ত দিয়েছিল তা তার নিজ অঞ্চলের মাতৃভাষা নয়, এটা ছিল কোলকাতা অঞ্চলের অভিজাত বনেদি মানুষের ভাষা তথা রাজধানির ভাষা, যা এদেশের বাঙালিরা আত্মিকরণ করে অনেক বিদেশি জিনিসপত্র আত্মিকরণের মতই! এখন যাকে সে মর্যাদা দিচ্ছে তার মাতৃভাষা রূপে। কিন্তু তা দিলেও, ভাষাটি তার নিজের মায়ের ভাষা [এমনকি পিতৃভাষাও না] না হওয়ার কারণে, সে তাকে এখনো ‘পরভাষা’ করে রেখেছে দেশের উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরত্বপূর্ণ কর্ম তথা স্থানেই। তাই বাংলা “অপাঙ্‌ক্তেয়” ভাষা-ই রয়ে গেল ২০১৪ সনেও রাজনৈতিক বাংলাদেশে এসব ঐতিহাসিক অকথিত অপ্রিয় সত্যের কারণে!




ভাষা বিষয়ে জানতে আগ্রহি? তো পড়ুন পর্ব # ৫


https://www.facebook.com/logicalbengali/posts/1527234470844037:0

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন