রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

প্রসঙ্গ : বাঙালির এভারেস্ট বিজয় – যৌক্তিকতা আর অযৌক্তিকতার দোলাদল # ১০৭

প্রসঙ্গ : বাঙালির এভারেস্ট বিজয় – যৌক্তিকতা আর অযৌক্তিকতার দোলাদল
 
[অন্ধ, খোঁড়া, ১৩-বছরের বালকও এভারেস্ট জয় করেছে]

উদ্ধার হলনা খালেদ সজলের লাশ ! অর্থনৈতিক সমস্যা-আক্রান্ত বাংলাদেশিদের ‘হিমালয় বিজয়’ কতটুকু যুক্তিযুক্ত ? এ নিয়ে এ প্রবন্ধ লিখেছিলাম অনেক আগেই, অনেকেই তা মানতে পারেননি। সম্প্রতি এতে যোগ হল নতুন মাত্রা। প্রথম বাংলাদেশি এভারেস্টজয়ি হিসেবে দাবিদার মুসা ইব্রাহিম এভারেষ্টের চূড়ায় উঠেছিলেন, কি ওঠেননি এ নিয়ে বিতর্ক চলছে এখন দেশ আর মিডিয়া জুড়ে। বিবিধসূত্রের খবরে বলা হয়েছে, এভারেস্ট জয়িদের নিয়ে প্রকাশিত নেপালের পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং নেপাল মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রকাশনা ‘নেপাল পর্বত’ এ নাম নেই মুসা ইব্রাহিমের। সেখানে প্রথম বাংলাদেশি এভারেস্ট বিজয়ি হিসেবে নাম এসেছে এমএ মুহিত এবং নিশাত মজুমদারের। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সামাজিক গণমাধ্যম এবং পর্বতারোহীদের মধ্যে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বিষয়টি এখনো আদালতে বিচারাধীন রয়েছে কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলোতে মানুষ এর সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারের দাবি তুলেছে। মুসা ইব্রাহিম এভারেষ্টের চূড়ায় উঠেছিলেন কি ওঠেননি এ নিয়ে বিতর্কটা খুবই বিব্রতকর দেশে আর বাইরে। তার প্রদর্শিত ছবি নিয়েও কারসাজির বা সন্দেহের আঙুল উঠিয়েছে নেপাল মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা। মুসা প্রতারণা করেছেন নাকি সত্যিই উঠেছিলেন, সেটা সময় নির্ধারণ করবে।

কেন এভারেস্ট বিজয়? একুশ শতকে এভারেস্টে ওঠা কি খুব কঠিন কাজ? তাহলে পা হারানো, অন্ধ, ১৩-বছরের বালক কিভাবে ওঠে এভারেস্টে? বিস্মিত হচ্ছেন? দেখুন তাহলে তথ্য চিত্র কি বলে?: 
 
৭৭ বছর বয়সী নেপালি নাগরিক মীন বাহাদুর শেরচান বেছে নিয়েছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার পথ। নাম লিখিয়েছেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে। মাত্র ১৬ বছর বয়সি তেম্বা ছেরি শেরপা এভারেস্ট জয় করতে সক্ষম হন কিশোর হিসেবে। ২০০৬ সনে নিউজিল্যান্ডের ২-পা হারানো Inglis এভারেস্ট জয় করেন চমৎকারভাবে। হাটুর নিচ থেকে ডান পা কাটা Tom Whittaker এভারেস্ট জয় করেন ২৭ মে ১৯৯৮। ২০১২ সনে উত্তর প্রদেশের ২৬ বছরের অরুণিমা সাহা ট্রেনে কাটা পড়ে পা হারিয়েও এভারেস্ট জয় করেন সাহসের সাথে। ২০০৩ সনে বৃটিশ প্রতিবন্ধী Glenn Shaw এভারেস্ট জয় করে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেন। ২০০১ সনের ২৫ মে বিশ্বের প্রথম অন্ধ ব্যক্তি হিসেব এভারেস্ট জয় করেন Erik Weihenmayer. 
 
সবচেয়ে কম বয়সে এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড জর্দান রোমেরোর, ২০১১ সনে এভারেস্ট শীর্ষে পা রাখার বছরে তার বয়স ছিল মাত্র ১৩-বছর। তামায়ি ওয়াতানাবে সবচেয়ে বেশি বয়সী এভারেস্ট বিজয়ী নারী, তিনি এভারেস্ট জয় করেন ৭৩ বছর বয়সে।
সবচেয়ে বেশিবার এভারেস্ট শীর্ষে পা রাখার কীর্তি আপা শেরপার। তিনি ১৯৯০-২০১১ পর্যন্ত সময়ে এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছেন ২১ বার। স্বল্প সময়ের মধ্যে মানে ১-সপ্তাহে ২-বার মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণ করে গিনেস বুক অব রেকর্ডসে নাম লিখয়েছেন নেপালী নারী 'ছুরিম শেরপা'। আসলে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক এ এভারেস্ট বিজয়ে এখন এতো ক্যাম্প, সিড়ি, যোগাযোগ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যে, এটা এ সময় কঠিন কোন কাজ নয়ই একজন প্রত্যয়ি মানুষের কাছে। (সূত্র : ইন্টারনেট)

অতএব, এদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এভারেস্ট বিষয়ক নেতিবাচক কথা বলতেই হয়। কিছুকাল আগে বাংলাদেশের হিমালয়জয়ী মৃত খালেদ সজলের লাশ সরকারি খরচে দেশে আনার জন্য তার আত্মীয়স্বজনরা সরকারের কাছে ধর্ণা দেন। খবরে প্রকাশ, ২৮০০০ ফুট থেকে লাশ উদ্ধার ও দেশে আনতে কমপক্ষে ৬০-৭০ লাখ টাকা খরচের প্রয়োজন। কিন্তু নেপালের বাংলাদেশ Embassy চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি লাশ উদ্ধারে, যদিও অর্থ খরচ করে সরকার। এ প্রসঙ্গে আসল+ভুয়া হিমালয় বিজয়ি ৪+১ বাংলাদেশিদের প্রতি ‘যথাযথ সম্মান’ বজায় রেখে বলতে চাইছি, হিলারি-তিনজিং-এর সাহসি এভারেস্ট বিজয় এখন আর নেই ২০১৪ সনে। নেট ঘাটলে দেখা যায়, এখন নেপালের পেশাদার শেরপাদের সহযোগিতায় এ ‘বাণিজ্যিক কর্মসূচিতে’ বিশ্বের ল্যাংড়া-লুলা, অন্ধ-খোঁড়া, শিশু-বৃদ্ধ অনেকেই তথাকথিত ‘হিমালয় বিজয়’ করছেন প্রতিনিয়ত, যা ওখানে রীতিমত টাকার খেলা। কড়ি ফেলে সব কিনতে হয় ওখানে, এমনকি তালিকায় নাম ওঠানোর ফি-ও নাকি ৩০০০ ডলার। তা না দিলে নাম তোলার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি বেশি টাকা খরচে করলে নানাবিধ অসততার কথা এখন সর্বমহলে প্রচারিত।

সপ্তপদি সমস্যায় আক্রান্ত বাংলাদেশ। যেখানে হাসপাতালে পর্যাপ্ত ঔষধ নেই, সাভার ট্রাজেডির অনেককে কৃত্রিম হাত-পা’র ব্যবস্থা করা জরুরী, বস্তিতে থাকার মানবিক পরিবেশ নেই ইত্যাদি। বাংলাদেশিদের জন্য এ ‘সখের হিমালয় বিজয়’ কতটা যুক্তিযুক্ত তা এখন চিন্তার বিষয় এবং যখন আবার মৃত বিজয়িকে আনতে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা চান স্বজনরা। সুতরাং ‘ভবিষ্যত পর্বত বিজয়ি’দের অনুরোধ করবো, অপচয়মূলক এ কাজ বাদ দিয়ে, দেশের অনেক মৌলিক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসুন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আপনারা এ শক্তি ব্যবহার করতে পারেন, এখনও আহতদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসতে পারেন আপনারা। বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান, বাঙালির পাশে দাঁড়ান, দুর্নীতি আর দেশপ্রেমকে জয় করলে এদেশের মানুষ খুশি হবে, অনুপ্রাণিত হবে, গর্বিত হবে বিশ্ব আর বাংলাদেশে। এভারেস্ট বিজয়ের আউটপুট কি এই বাংলাদেশে ২০১৪ সনে? তা কি জানি কেউ?


[এভারেস্টজয়ী অন্ধ, খোঁড়া, ১৩-বছরের বালক, অরুণিমা সাহা এবং বর্তমান এভারেস্ট জয়ের পদ্ধতি চিত্রাকারে দেয়া হলো]


 





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন