শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মানুষের ঈশ্বর “দশরথ মানঝি” আর তাঁর “তাজমহল” নির্মাণ : ৬২

মানুষের ঈশ্বর “দশরথ মানঝি” আর তাঁর “তাজমহল” নির্মাণ

বিহারের হতদরিদ্র ভূমিহীন শ্রমিক দশরথ মানঝি। স্ত্রী ফালুগুনি দেবি। অসুস্থ্য হলে স্ত্রী হাসপাতালে নিতে পারেননি মানঝি, কারণ পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল পাথুরে পাহাড়। যে কারণে মাত্র ১-কিলোমিটারের সোজা পথ ঘুরতে হয়েছিল মানঝিকে ৭০-কিলোমিটার। আর এ পথ পেরুতে পেরুতে ফালগুনি দেবি ছেড়ে দেয় জীবনকে। যা প্রচণ্ড ধাক্কা দেয় দশরথ মানঝিকে। এরপর এ কাহিনির শুরু।

বিহারের গয়ার আত্তারি আর ওয়াজিরগঞ্জ ব্লকের মাঝে খাড়া দাঁড়িয়ে পাথুরে পাহাড়, যার সামনেই গহলৌর গ্রাম৷ গরিব এ গ্রামের মানুষকে শহরে যেতে হয় সামনের পাহাড় ডিঙিয়ে, যা পেরতে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ৷ কিন্ত্ত ফাল্গুনি দেবীর মৃত্যুই বদলে দিল গহলৌরের ভূগোল৷ পাহাড়ের বাধা অতিক্রম করে সময়মতো শহরের হাসপাতালে পৌঁছতে না পারায় পথেই মারা যান দশরথ মানঝির স্ত্রী ফাল্গুনি দেবী৷ এ মৃত্যুর ঘটনা ৫৪ বছর আগের৷ এরপরেই শুরু হয় এ গল্পের হতদরিদ্র শ্রমিক দশরথের হাতে৷ গ্রামের আর কাউকে যাতে অসুস্হ হয়ে পথেই না মরতে হয় তার জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খাড়াই পাহাড়কে কাটতে শুরু করলেন তিনি৷ সঙ্গী শুধু শাবল আর হাতুড়ি৷ একা হাতে দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনিকে নিত্যসঙ্গী করে পাথর ভাঙলেন দশরথ৷ তাঁর নাম হয়ে গেল ‘পাহাড়-মানব’৷ টানা ২২ বছর ধরে পাহাডের বুক খুঁড়তে খুঁড়তে একসময় বেরিয়ে পড়ল ফাঁক৷ সেই ফাঁককেই দশরথ ক্রমশ বানিয়ে ফেললেন পথ৷ লম্বায় ১১০ মিটার, গভীর ৭.৬-মিটার আর চওড়া ৯.১ মিটার৷ শহর থেকে বিচ্ছিন্ন্ গহলৌরের দূরত্ব কমে হল মাত্র ১৫ কিলোমিটার৷ একজন নিরক্ষর মানুষ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভারী কোনও যন্ত্রপাতি ছাড়াই পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়ে ফেললেন৷ এভাবে সম্পূর্ণ একার হাতের জোরে পাহাড় ভেঙে গ্রামবাসীর পায়ের কষ্ট কমিয়ে দিলেন তিনি৷ এমন নজির ইতিহাসে আর নেই৷ মানুষ কি না পারে এ পৃথিবীতে। মানুষের এ শক্তিই আসলে ঈশ্বর!

আরেকটু যদি বিস্তারিত বলতে চাই তাহলে বলতে হয়, বিহারের গাহলুর কাছাকাছি একটি গ্রামে ষাটের দশকে স্ত্রী ফাল্গুনি দেবীকে নিয়ে থাকতেন দশরাথ মানঝি। ১৯৬০ সালে মরণাপন্ন অবস্থা হলেও, কোনো রাস্তা না থাকার কারণে স্ত্রীকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি মানঝি। চিকিৎসার অভাবে ফাল্গুনি শেষ পর্যন্ত মারা গেলে মানঝি সিদ্ধান্ত নেন, ওই পাহাড়ই কেটে ফেলবেন তিনি। কারো সহায়তা না পেয়ে একাই হাতুরি এবং বাটালি নিয়ে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির কাজে নেমে পড়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ ২২ বছর দিনরাত পরিশ্রম করে ৩৬০ ফিট লম্বা, ৩০ ফুট উঁচু এবং ৩০ ফুট চওড়া রাস্তাটি নির্মাণ করেন তিনি।

একজন মানুষের পক্ষে কি পর্বতসম পরিবর্তন আনা সম্ভব এই পৃথিবীতে? হ্যা অবশ্যই। আর এর বড় প্রমাণ হলেন দশরথ মানঝি (১৯৩৪-২০০৭)। নিজের গ্রামের মানুষের অশেষ দুর্ভোগের নিরসন করতে খালি হাতে একাই যিনি একটি পর্বত খুঁড়ে তৈরী করেছিলেন রাস্তা। পেশায় দিনমজুর। সোজা দূরত্ব খুব অল্প হলেও পুরা পর্বতটাকে ঘুরে যেতে হয়, ফলে ১৫ কিলোমিটারের বদলে ৭০ কিলোমিটার পথ পেরুতে হয়। সরকারি বা অন্য কারো সাহায্যের অপেক্ষায় না থেকে, দশরথ নিজেই নামলেন হাতে কেবল হাতুড়ি আর বাটালি। পর্বতের পাথর একাই এবং কোনো ভারী যন্ত্রপাতি ছাড়া ভেঙে গড়তে শুরু করলেন রাস্তা। লোকে হাসলো, আর বললো, একজন মানুষের পক্ষে এটা করা অসম্ভব! দশরথ পাগল! দশরথ কিন্তু কাজ করেই চললেন, একাই, হাতুড়ি বাটালি দিয়ে নিজে নিজে একাকি। ‘মাউন্টেইন ম্যান’ হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত পেয়ে ২০০৭ সালে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান দশরথ।

সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন হলে ভোট দিবেন কাকে দশরথের রাস্তা? নাকি শাহজাহানের তাজমহলকে? ভারতের অনেকেই এখন দথশরথের পক্ষে ভোট দেবেন বলছেন পত্রিকা জরীপে। সম্রাট শাহজাহান ২২ বছর সময়ে, ২০ হাজার শ্রমিক খাটিয়ে জনগণের পয়সায় বানিয়েছিলেন তাজমহল। আর দশরথ কাজ করেছেন একাকি, জনগণের স্বার্থে পর্বত চূর্ণ করে বানিয়েছেন এই রাস্তা। শখের তাজমহলের চেয়ে এ নির্মাণ কি কম কখনো? তা কি হয়? দশরথ ঐ মানুষের প্রতিক, যারা কোন কিছু করার জন্য অন্যের ভরসায় বসে থাকেনা। দশরথ হতে পারে এ সমাজের এক অনন্য শিক্ষক। আমাদের সবার টিচার! অনন্য টিচার।

বিহারের পাহাড় কেটে, নিজ হাতে রাস্তা কেটে ‘মাউনটেইন ম্যান’ খেতাব অর্জনকারী দশরথ মানঝির ছেলে ভাগিরথ মানঝি এবং স্ত্রী বাসন্তি দেবীকে আর্থিক সাহয্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন বলিউডি অভিনেতা আমির খান এবং ভারতের সাবেক এমপি রাজেশ রঞ্জন ওরফে পাপ্পু ইয়াদব। টিভি শো ‘সত্যামেভ জয়েতে’-এর কাজে ভাগিরথদের গ্রামে গিয়েছিলেন শো-টির উপস্থাপক আমির খান। আর তখন তাদের পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরে তাদের সহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন আমির। ভাগিরথ এবং তার স্ত্রী আমিরকে তাদের দর্দশার কথা জানান। তারা জানান কীভাবে তারা অবহেলিত হয়েছেন। এমনকি সরকার থেকেও তারা কোনো সাহায্য পাননি। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমির তাদের সহযোগিতা করার নিশ্চয়তা দেন। ভাগিরথ এবং বাসন্তি তাদের এলাকার প্রাইমারি স্কুলে রান্না করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা দুপুরে বাচ্চাদের জন্য খাবার রান্না করেন। এ কাজের জন্য তাদের মাসে এক হাজার রূপি করে দেওয়া হয়। এ হচ্ছে পাহাড় মান দশরথের ছেলে ও ছেলেবউর কথা। সম্প্রতি অর্থের অভাবে ভালো চিকিৎসা করতে না পারায় মারা গেছেন মানঝির পুত্রবধূ।

যে পাথুরে পাহাড়টি কাটেন দশরথ তার নাম “গেহলুর পাহাড়”। এই মহতি সাহসি কর্মবীরের সম্মানে বিহার সরকার “গেহলুর থেকে আমেথি” পর্যন্ত যে রাস্তা নির্মাণ করেছেন তার নাম এখন ‘দশরথ মানঝি সড়ক”। ফিলম মেকার “কেতান মেহতা” এক আর্টিক্যালে মানঝিকে গরিবের শাহজাহান আখ্যায়িত করে তার পাহাড় কাটাকে আরেক “তাজমহল” বলেছেন। ২০০৬ সনে মানঝিকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দেয়া হয়। ফিলম মেকার “মনিষ ঝা” দশরথকে নিয়ে ছবি নির্মাণ শুরু করেছেন এবং মৃত্যুর আগে হাসপাতালে বসেই তিনি এ ব্যাপারে দশরথের আঙুলের ছাপ রেখে অনুমতি নিয়েছেন। বলিউড হিরো আমির খান তার বিখ্যাত টিভি সিরিয়লা ‘সত্যমেব জয়তে’- [Satyamev Jayate] অনুষ্ঠানে এ বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। আমরা কি এ প্রবন্ধটি পড়ে দশরথ মানঝি থেকে শিখতো পারবো কিছু? বাজাতে পারবো জীবনের জয়ধ্বনি? কবে? নাকি কেবল ইন্ডিয়ার নাম শুনলেই নাক সিটকাবো? আমাদের মাঝে কি একজনও দশরথ মানঝি সৃষ্টি হবে না এ বাংলাদেশে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন