শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

চরাঞ্চলের জেলে আর কিষাণের সন্তানদের নিয়ে আনন্দময়তার ঈদ আমার # ৯৫



চরাঞ্চলের জেলে আর কিষাণের সন্তানদের নিয়ে আনন্দময়তার ঈদ আমার

আমি বর্তমানে ঢাকা বসবাস করলেও আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা একটা অনুন্নত দ্বীপাঞ্চলে, যেখানের অধিকাংশ মানুষ জেলে ও কৃষক সম্প্রদায়ের অত্যন্ত গরিব। যারা রাতে ঘরে কেরোসিনের কুপি জ্বালায়, মাটিতে চাটাই বিছিয়ে ঘুমায়, আর নদীতে সাঁতরে স্নান করে নারী-পুরুষ, গরু-মহিষ একত্রে। এরা ফেসবুক, ল্যাপটপ, নেট এমন অনেক শব্দের সাথেই অপরিচিত এখনো। বিস্ময়কর ভাবে এদের ছোট শিশুরা এখন লাইন দিয়ে সকাল বেলা স্কুলে যায় সরকারি বই, বিস্কুট ইত্যাদি প্রদানের কারণে।

ঐ এলাকার মানুষ হলেও, আমরা ৪-ভাই এখন দেশে বিদেশে সম্মানজনক প্রফেশনে আছি বিধায়, আমাদের অবস্থা তাদের চেয়ে অনেক ভাল। মা-বাবার রীতি অনুযায়ী প্রতি বছর আমরা ৪-ভাই মিলে বড় সাইজের একটা ষাঁড় ঐ দ্বীপগ্রামে কোরবানি দেই, একসাথে ঈদ উৎযাপন করি, যদিও ব্যক্তিজীবনে আমি পশুহত্যা তথা কোরবানীর বিপক্ষে। কিন্তু তারপরো পরিবারের ঐক্য তথা মা-বাবার নির্দেশনা এখনো মেনে চলি সামাজিক রীতি হিসেবে। আমার মায়ের মৃত্যুর পর ব্যাগে মায়ের জমানো প্রায় ৩-লাখ নগদ টাকা পাওয়া গেলে, আমরা ৭-ভাইবোন মিলে সিদ্ধান্ত নেই যে, ঐ টাকায় গ্রামের শিশুদের জন্যে একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হবে, যাতে বিনে পয়সায় গরিব শিশুরা ভাষা, হিসাব ও ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করতে পারে। ঐ পাকা মক্তবে বর্তমানে ১৪৭-জন ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করছে- যাদের বই, খাতা, কায়দা সব আমাদের পরিবার থেকে সরবরাহ করা হয়।

বিগত ঈদে বাড়ি যাওয়ার প্রাক্কালে সিন্ধান্ত নেই যে, এবার ঐ ১৪৭-জন শিশুকে নিয়ে আমরা ঈদ উৎযাপন করবো। প্লান মোতাবেক ঈদের ২-মাস আগেই ১১৭ জন মেয়ে ও ৩০-জন ছেলের মাপ সংগ্রহ করি। পুরণো ঢাকায় কর্মরত আমার বর্ণিত গ্রামের জনৈক পোশাক ব্যবসায়ির মাধ্যেম মেয়েদের জন্যে লাল পাজামা+ওড়না+ প্রিন্টের জামা এবং ছেলেদের জন্যে ৩-সাইজের একই দাম ও ডিজাইনের পাজামা+পাঞ্জাবি+টুপি অর্ডার দিয়ে বানাই। তা সাধারণ গিফট বক্সে প্যাক করে ১৪৭-সেট ‘ঈদ পোশাক’ নিয়ে ঈদের ২-দিন আগে বর্ণিত গ্রামে পৌঁছাই আমরা। ঈদের আগের দিন বিকেলে সকল শিশুকে গ্রামের বাড়ির উঠোনে ডেকে ঈদের বর্ণিত গিফট ও সাথে ‘ঈদ হাদিয়া’ হিসেবে ৫০ টাকার একটি নতুন নোট দেই, যা ঢাকা থেকে আগেই প্লান করে সাথে নিয়ে যাই আমরা। আমাদের বর্ণিত এলাকায় ঈদের দিন গরুর ভুনা মাংস চালের রুটি দিয়ে খাওয়ার প্রথা প্রচলিত। ১৪৭-জনের জন্যে এতো রুটি বানানো জটিল বিধায়, প্রত্যেককে বিকেলেই ১-কেজি পরিমাণ চালের গুড়ো দিয়ে দেই, যাতে তারা ঐ চালের গুড়োর রুটি বানিয়ে নিয়ে আসতে পারে ঈদের দিন। রুটি বানানোর কারণে তাদের মাকেও তাদের সাথে নিয়ে আসতে বলি।

পরদিন নতুন জামা পরে ১৪৭-জনের অনেক শিশুই কুরবানীর খুঁটিনাটিতে অংশ নেয়। সবাই রুটি বানিয়ে নিয়ে আসে। তাদের সহযোগিতায় পুরো ষাঁড়টিকে (যার দাম ছিল ৭৬,০০০ টাকা) কেটেকুটে বাইরে বিশাল ‘তাফালে’ (এক শ্রেণির বড় পাত্র) পাক করার পর; ঐ ১৪৭-শিশু, তাদের ২-শিক্ষক এবং কয়েকজনের মা-বাবাকে বাইরে বিশাল লাইনে বসিয়ে খাওয়ানো হয়। এই খাওয়ানোতে আমাদের পরিবারের অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে কিন্তু অন্য বছরের তুলনায় বিগত ঈদে এ শিশুদের উপহার প্রদান, আর খাওয়ানোর কারণে যে আনন্দ আমি পেয়েছি, তা বোধ হয় কোন ঈদেই আর কখনো পাইনি।

আমাদের ধনিক শ্রেণিরা এরকম ঈদ উৎযাপন করতে পারেন তাদের নিজের এলাকার মানুষ তথা শিশুদের আনন্দ প্রদানের মাধ্যেম। কিন্তু আমরা কি এটা করি? বিশাল আকৃতির গরুটি কুরবানী দিয়ে, তার মাংসের বিশেষ অংশটি বিয়াই বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনকে পাঠিয়ে, নিজের ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রতিজনে ২/৩ কেজি গরুর মাংস খেয়ে ‘ঈদ উৎসব’ শেষ করি। এ হচ্ছে বাঙালি মুসলমানের “ঈদ উৎসব” পালনের সাধারণ রীতি। আমরা কি এ রীতির বাইরে বের হবোনা কখনো? কবে হবো?

ছবি পরিচিত :
১] ঈদের আগের দিন শিশুরা গিফট নিতে আমাদের বাড়ির উঠানে,
২] যারা পড়েনা এমন শিশুরাও গিফট নিতে আসে কিন্তু তাদের জন্যে ১৪৭ সেটের অতিরিক্ত পোশাক না থাকাতে, তাদের কেবল সান্ত্বনা হিসেবে ৫০/- টাকা করে দেয়া হয় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে,

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন