সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইসলামের নবী কি সাম্যবাদী (কমিউনিস্ট) ছিলেন না? # ১২৬

ইসলামের নবী কি সাম্যবাদী (কমিউনিস্ট) ছিলেন না? 
আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম চিন্তাবিদ ও সমালোচক ‘কমিউনিজম’ তথা সাম্যবাদকে ইসলামের এক নম্বর ‘শত্রু’ হিসেবে মনে করেন। পৃথিবীর প্রায় সকল মুসলিম সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রগুলো ‘সমাজতান্ত্রিক’ পদ্ধতির বদলে ‘ধনতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা অনুসরণ করে থাকে। আমাদের দেশসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশে ‘ওয়াজ-নসিহত’ আলাপ-আলোচনায় একজন সাম্যবাদীকে ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবে ‘গালি’ দিতেও বেশ পছন্দ করেন অনেকে। কেউবা আরো বাড়িয়ে একে ‘কুফরী’ মতবাদ বলতেও পিছনা হন না। বর্তমান চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার একটি হচ্ছে ‘ধনতান্ত্রিক’, অন্যটি ‘সমাজতান্ত্রিক’। ইসলামের নবী (স.)-এর জীবন, কর্ম ও শিক্ষা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, ‘ধনতান্ত্রিক’ অর্থ ব্যবস্থার চেয়ে তিনি ‘সমাজতান্ত্রিক’ ব্যবস্থাপনাকেই বেশী পছন্দ করতেন। তাঁর জীবনের দু’য়েকটি উদাহরণ এনে বিষয়টি ষ্পষ্টীকরণ করা যেতে পারে।

নবী (স.)-এর শাসনামলে মদীনার স্থায়ী বাসিন্দা মুসলমানগণ ‘আনসার’ এবং মক্কা বা অন্য এলাকা থেকে আগত বহিরাগত মুসলমানরা ‘মুহাজির’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আনসারগণ মদীনায় তাদের স্থায়ী ঘর-বাড়িতে বসবাস করলেও, মুহাজিরগণ সাধারণত মদীনা শহরের উপকন্ঠে তাবু বা অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করতেন। একবার প্রচন্ড এক ঝড়ে ‘মুহাজির’দের অস্থায়ী ঘর-বাড়ি উড়ে গেলে, নবী (স.) মদীনার স্থায়ী বাসিন্দা ‘আনসার’দেরকে তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এই বলে যে, ‘সে প্রকৃত ইমানদার/মুসলমান নয়, যে নিজের জন্যে যা পছন্দ করে, তা তার ভাইর জন্যে না করে’। এখানে ‘ভাই’ বলতে আনসারদের জন্যে বহিরাগত ঝড়ে নিঃস্ব প্রতিবেশী মুহাজিরদেরকে বোঝানো হয়েছিল। নবী (স.)এর  এ কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে ‘তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছল’ আনসারগণ সকলেই তাদের সম্পদ তথা খেজুরবাগান, উট ও ঘরের অর্ধেক সর্বহারা মুহাজিরদের জন্যে ছেড়ে দেন। কেউ কেউ তাদের একাধিক স্ত্রীদেরকেও ‘তালাক’ দিতে চেয়েছিলেন অন্যান্য সম্পদের মত। আমরা প্রায় সবাই কমবেশী জানি যে, নবী (স.) নিজের তরকারীতে একটু বেশী ‘ঝোল’ এ জন্যে দিতে বলেছেন যে, যেন তার থেকে কিছু অংশ তার প্রতিবেশীকে দেয়া যায়। একবার ‘বাহরাইন’ থেকে প্রচুর যুদ্ধলব্দ ‘গণিমাতে’র সম্পদ মুসলমানদের হস্তগত হলে, তা বণ্টনের জন্যে মদীনায় আনা হয়। যথারীতি তা বণ্টনের দায়িত্ব ছিল নবী (স.) এর উপর। 

এক তৃতীয়াংশ বায়তুল মাল, এক তৃতীয়াংশ আল্লাহর নবী ও এক তৃতীয়াংশ আহরিত সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করার কথা থাকলেও, ‘সাম্যবাদী’ নবী যখন বণ্টন শেষ করলেন, দেখা গেল নবীর নিজের ভাগ বা বায়তুল মালের জন্যে ‘একটি গমের দানাও আর অবশিষ্ট রইল না’। অর্থাৎ সব তিনি ‘সাম্যবাদী’ নীতিতে বণ্টন করে দিলেন নিজের ‘ভাগ’ না রেখেই। একবার সাহাবাদের নিয়ে কোথাও ভ্রমনের সময় একটি ‘গৃহপালিত গাধা’ রান্না করা হচ্ছিল। সংশিস্নষ্ট এলাকার কৃষকগণ এসে নবীর কাছে ‘আবদার’ করলো যে, ‘‘যে হারে গাধা নিধন করে খাওয়া হচ্ছে, অচিরেই ‘কৃষিকাজ’ ও ‘ভার বহনের জন্যে’ গাধার হয়তো আকাল দেখা দেবে’’। সামাজিক প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় রেখে নবী (স.) তাৎক্ষণিকভাবে গাধার মাংস ‘হারাম’ হিসেবে ঘোষণা করলেন। মদীনার যে ঘরগুলোতে মদীনার আনসারগণ বসবাস করতেন, নবী (স.) এর নিজস্ব বাসস্থান তাদের মতই খেজুর গাছের খুটি ও ছাউনি ও অনুরূপ পাথর-বালির উপকরণ দিয়ে তৈরী ছিল। বর্তমান ‘হোয়াইট হাউস’ বা ‘বাদশা ফাহাদের’ প্রাসাদের মত ছিলনা। তা ছাড়া নবী (স.) যখন কোথাও কোন অনুষ্ঠানে যেতেন, ঐ অনুষ্ঠানে পরিবেশনকৃত দুধ বা সরবত সাধারণত নবী (স.) প্রথম পান শুরু করতেন এবং একই পাত্র ধারাবাহিকভাবে ডান-থেকে বামে সকলের মধ্যে পরিবেশন করা হতো। কখনো উপস্থিত লোকজনের তুলনায় দুধ বা শরবতের পরিমান কম হলে, নবী (স.) তার মধ্যে পানি ঢেলে পরিমান বাড়াতেন, যাতে সকলে মিলে পান করতে পারেন। ভৃত্যদের ব্যাপারেও নবী (স.)- এর মতবাদ ছিল সাম্যবাদী, তিনি বলতেন ‘তুমি নিজে যা খাবে ও পড়বে, ভৃত্যকেও ঠিক একই খাবার ও কাপড় দিবে’। 

আবার অন্যত্র বলেছেন, ‘প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে যে পেট ভরে খায়, সে প্রকৃত মুসলমান নয়’। সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার মত তিনি ‘একচেটিয়া (মনোপলী) ব্যবসাকে ইসলামে অবৈধ ও অপরাধ বলেছেন’। আর পুঁজিবাদের প্রধান অস্ত্র ‘সুদ’ ইসলামী সমাজব্যবস্থায় ‘হারাম’ তা কে না জানে? তবে সমাজ ও ব্যক্তি উন্নয়নে ‘করজে হাসানা’ আবার ইসলামে উত্তম কাজ। একটি হাদিসে বলেছেন, ‘সুকর্ম হচ্ছে এটি, আপন পাত্র হতে যে তার ভাইর পাত্রে পানি ঢেলে দেয়’ এটি যে ‘সমাজতান্ত্রিক’ চেতনার কথা তা সাধারণ বুদ্ধিতেও বোঝা যায়। এ রকম আরো হাজারো উদাহরণ হয়তো দেয়া যাবে, যাতে সুষ্পষ্ট হয় যে, ইসলাম মুলত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থারই খুব কাছাকাছি। ‘কার্ল-মার্কস’ বা ‘লেনিন’ নবীর চেয়ে বড় ‘সমাজতন্ত্রী’ ছিলেন বলে উপর্যুক্ত উদাহরণসমুহে প্রমাণ মেলেনা। নবী (স.) শুধু সাম্যবাদী ‘তাত্ত্বিক’ কথাই বলেননি, বাস্তরে তার প্রয়োগও করেছেন। 

সে ক্ষেত্রে মুসলিম জ্ঞানী-গুণী পন্ডিত ভাইদেরকে বলবো, ‘ধনতান্ত্রিক’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ অর্থব্যবস্থার সমালোচনার সময় পুিজবাদের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপক্ষে কথা বলার আগে, মহানবী (সে.) এর কাজ ও তাঁর জীবন ধারা নিয়ে একটু চিন্তা করুন। সুষ্পষ্ট হবে তিনি কোন ধারার সমর্থক ছিলেন। নিচের হাদিসগুলো গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে নবী কতটুকু সাম্যবাদী ছিলেন- ‘‘নবী বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যখন কেউ কিছু খায়, তখন তা মোছার আগে সে যেন তার হাত চাটে কিংবা অন্য কাউকে দিয়ে চাটায় (বুখারী-৫০৫২); নবী ১-মুদ (প্রায় ১-কেজি) পরিমাণ পানি দিয়ে উযু ও ১-সা’ (প্রায় ৪-কেজি) পরিমাণ পানি দিয়ে গোসল করতেন (তিরমিযী-৫৬); মোমিন মুসলমানরা পরস্পর ভাইভাই ঘোষণার পর, নবী মদীনার সা’দ ও মক্কার আ. রহমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করলে, সা’দ তার সকল সম্পদকে ২-ভাগ করে একভাগ আ. রহমানকে দান করেন এবং ২-স্ত্রীর মধ্যে ১-জনকে আ. রহমানের জন্যে তালাক দিতে সম্মত হন (বুখারী-৩৪৯৮); খায়বর অভিযানকালে একজন কৃষক এসে বললো, মাংস খাওয়ার কারণে গৃহপালিত পশুগুলো (গাধা) নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, যা মালপত্র পরিবহণে ব্যবহৃত হয়, এরূপ ৩-বার বলার পর নবী গাধার মাংস হারাম ঘোষণা করলেন, যার প্রেিক্ষতে ডেকচিতে টগবগরত মাংসকে ফেলে দেয়া হয় (বুখারী-৩৮৭৯,৩৯০৩); আল্লাহ ও তার রসুল ছাড়া কেউ চারণভূমি সংরক্ষণ করতে পারবে না (বুখারী-২১৯৭); সারা বিশ্বের ধনাগারের চাবি আমাকে প্রদান করা হয়েছে (বুখারী-৩৩৩১); নবীর পড়ার চাদরটি (লুঙ্গী) এক ইহুদীর কাছে বন্ধক থাকা অবস্থায় নবী ইেন্তকাল করেন (বুখারী-৪১০৯); নবী বলেছিলেন, মুমিনদের মধ্যে কেউ ঋণ রেখে মৃত্যুবরণ করলে তা পরিশোধ করার দায়িত্ব আমার, আর যে সম্পদ রেখে যায় তা তার উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য (বুখারী-৪৯৭১); মুমিন এক উদরে খাদ্য গ্রহণ করে আর কাফের-মুনাফিক সাত উদরে খাদ্য গ্রহণ করে [বেশি খায়] (বুখারী-৪৯৯২-৩); নবী ময়দা দেখেননি, আটার জন্যে চালুনী ব্যবহার করেননি, সাধারণত যব পিষার পর ফুঁ দিয়ে পাওয়া আটাকে পানি মিশিয়ে খামির তৈরী করে খাওয়া হতো (বুখারী-৫০১০); আবু শুয়াইব নবীসহ ৫-জনকে দাওয়াত করলে ঘটনাক্রমে সেখানে ৬-জন উপস্থিত হলে নবী বলেন, আমাদের সাথে আসা অতিরিক্ত ১-জনকে তুমি প্রবেশ অনুমতি কিংবা চাইলে বাদ দিতে পারো। শুয়াইব বললেন, অনুমতি দিলাম (বুখারী-৫০৩১); নবী পোশাক হিসেবে চাঁদর পরতেন, তবে ইয়ামেনের ‘হিবারা’ চাঁদর অধিক পছন্দ করতেন (বুখারী-৫৩৮৪-৮,৫৬৫০); মৃত্যুকালে নবীর পরনে চাঁদর ছিল ও মৃত্যুর পর তাকে হিবারা চঁাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় (বুখারী-৫৩৮৯-৯১); মুসলিম অপর কোন মুসলিম রোগীকে দেখতে গেলে বেহেসেত্ম তার জন্যে ১টা ফলের বাগান তৈরি হয় (তিরমিযী-৯১১); পানি কখনো অশুচি হয়না (তিরমিযী-৬৫-৬), নবী গোসলের পর অযু করতেন না (তিরমিযী-১০৭); কবর পাকা ও কিছু লিখতে নবী নিষেধ করেছেন (তিরমিযী-৯৯০); একজোড়া জুতার বিনিময়ে বিয়েকে নবী অনুমোদন করেছেন (তিরমিযী-১০৪৯); 

নবী পানি বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন (তিরমিযী-১২০৮); প্রতিবেশি ঘরের দেয়ালের সাথে পিলার স্থাপন করতে চাইলে তাকে অনুমতি দাও (তিরমিযী-১২৯০); বিক্রয়যোগ্য বাড়ি ক্রয়ে প্রতিবেশি অগ্রাধিকার পাবে (তিরমিযী-১৩০৭); পতিত জমি আবাদ করলে আবাদকারী জমির মালিক হবে (তিরমিযী-১৩১৮); নবীর তোষকের ভেতরে ছিল খেজুর গাছের আঁশ (বুখারী-৬০০৬); নেতৃত্বের প্রার্থনা করো না (বুখারী-৬২৫৫); এক ক্রেতার উপর অন্য ক্রেতার দরাদরি করা হারাম (বুখারী-৬৪৭৯); ভিক্ষা করা আর নিজের মুখে আঘাত করা সমান (আবু দাউদ); দরিদ্র মুহাজিরগণ ধনীদের ৫০০-বছর আগে জান্নাতে যাবে (তিরমিযী-২২৯৩); দরিদ্র মুসলমান ধনীদের চেয়ে ৪০-বছর পূর্বে জান্নাতে যাবে (তিরমিযী-২২৯৭); নবী তার ঘরে আগামী দিনের জন্য কোন কিছু সঞ্চয় করে রাখতেন না (তিরমিযী-২৩০৪); দিনার ও দিরতামের দাসরা লানতপ্রাপ্ত (তিরমিযী-২৩১৬); দালান-কোঠা নির্মাণের ব্যয়ে কোন কল্যাণ নেই (তিরমিযী-২৪২৩); যে ব্যক্তি ১০-ওসক খেজুর কাটবে সে যেন মসজিদে একটি ছড়া ঝুলিয়ে রাখে (দাউদ-১৬৬২); যার ক্ষতি থেকে প্রতিবেশী নিরাপদ নয় সে জাহান্নামী (মুসলিম-৭৮); যে স্ত্রীলোক সোনার হার, সোনার কানপাশা ব্যবহার করে, কিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের হার ও কানপাশা পরিধান করানো হবে (দাউদ-৪১৯০)’’।

উপরের হাদিসগুলোর মধ্যে পুঁজিবাদ কোথায়? বরং নবীর জীবনাচারের সর্বত্রই দিপ্যমান সাম্যবাদী তথা কমিউনিস্ট সিস্টেম! সুতরাং মুসলমানদের উচিৎ পুঁজিবাদের পরিবর্তে সাম্যবাদ তথা কমিউনিস্ট সিস্টেমকে সমর্থন করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন