সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ভাষা রিলেটেড বিতর্ক-২ : প্রকৃত ‘অনুবাদ’ কখনো সম্ভব নয় # ১১৩

ভাষা রিলেটেড বিতর্ক-২ : প্রকৃত ‘অনুবাদ’ কখনো সম্ভব নয় 
প্রচলিত ধারণার বিপরীত চিন্তা : প্রকৃত অনুবাদ কখনো সম্ভব নয়
বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ভাষা সম্ভবত চার হাজারেরও বেশী। যার মধ্যে প্রবহমান ‘আধুনিক ভাষা’ মানে যে ভাষায় মানুষ লেখাপড়া, দাপ্তরিক কাজ, কম্পিউটার কম্পোজসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যা নানা অনুসঙ্গে ব্যবহার করে থাকে, তার সংখ্যাও শ’য়ের উপরে। ভাষা যেহেতু মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। আর নানাবিধ কারণে পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠী সৃষ্টি হওয়ার কারণে, মানুষের মত প্রকাশের পথকে সহজ ও বোধগম্য করার জন্যে ভাষার পর পরই আবার সৃষ্টি হয়েছে ‘ভাষার অনুবাদ’ বিদ্যা, যা বর্তমান বিশ্বের উন্নত-অনুন্নত সব দেশগুলোতে এখন অন্যতম ‘পাঠ্য’ হিসেবেও চি‎‎হ্নিত ও স্বীকৃত। আর অনুবাদ বিদ্যার এ সহজ কাজটি করে থাকে ‘অভিধান বা Dictionary। এখন বিশ্বের প্রায় সকল ভাষারই দ্বিভাষিক ‘অভিধান’ খুব সহজলভ্য। বর্তমানে ‘কথনমূলক অভিধান’ যা আরো সহজ করে দিয়েছে প্রাচীন পদ্ধতির পুস্তকাকারের অভিধান-কে। বিশ্বের জ্ঞানী-গুণি প্রায় সবাই অনুবাদের জন্যে এখন সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে অভিধানকে গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু আমরা কি একটুও চিস্তা করে দেখেছি কি যে, আসলে কোন ভাষারই ‘যথার্থ অনুবাদ’ বা Translate করা সম্ভব নয়! অর্থাৎ অনুবাদের মাধ্যমে কখনোই মূল ভাষাটির ‘প্রকৃত অর্থ’ প্রকাশ পায়নাবরং কখনো বিকৃত কিংবা বিভ্রান্তিকর অর্থ প্রকাশ করে। কথাটি অনেকের কাছে বিভ্রান্তিকর ও রহস্যময় হওয়ার কারণে কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে।

আমরা উদাহরণে আমাদের পরিচিতি বাংলা থেকে ইংরেজি ও আরবি ভাষা অনুবাদের ব্যাপারটি বোঝানোর চেষ্টা করবো, যেহেতু এই ভাষা তিনটির সঙ্গে মোটামুটি আমরা পরিচিত ।

প্রথমেই আলোচনা করা যাক ‘হরতাল’ শব্দটি নিয়ে। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ বা অনুবাদ hartal-strike । বাংলায় ‘হরতাল’ বোঝাতে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে ‘ঘোষিত দিনে’ (এবং তার পূর্ববর্তী রাতে যার শুরু) পিকেটিং, জালাও-পোড়াও, গাড়ি ভাংচুর, অফিস আদালতে যেতে বাঁধা, পুলিশের মারমুখী আচরণ অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলনের পরিবর্তে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে ঘরে আটকে রাখাকে বোঝায়। কিন্তু ইংরেজি strikeশব্দটি মানে হচ্ছে, বিশেষ কোন গোষ্ঠীর যৌক্তিক দাবীর পক্ষে শান্তিপূর্ণ স্বতস্ফূর্ত কর্মবিরতি বা অবস্থান। আবার বাংলায় ‘কৃষক’ বলতে মাথাল/গামছা মাথায় গ্রামীণ খেটে খাওয়া অত্যন্ত সাধারণ নিরক্ষর মানুষ বোঝায়, যারা পৈত্রিক পেশা হিসেবে কৃষিকে গ্রহণ করলেও, মধ্যযুগীয় ও আদিম যুগের মত এখনো অনুন্নত পদ্ধতি অনুসরণে কৃষি কাজ করছেন এবং অভাব যাদের নিত্যসঙ্গী। অপরদিকে নিউজিল্যান্ডে বা যুক্তরাজ্যে ইংরজি ভাষায় farmer বলতে বোঝানো হয়, কৃষিতে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রীধারী বিশাল খামারের মালিক, যিনি কিনা তার এক কৃষি খামার থেকে অন্য কৃষি খামারে হেলিকপ্টারে যাতায়াত করেন। উত্তর আমেরিকাতেও farmer বলতে বিশাল খামারীকে বোঝানো হয়, যিনি বা যারা বিশ্ব কৃষি বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, বিশ্বের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কমাতে পারে। এবার দেখা যাক বাংলা ‘খেজুর’ শব্দটি।যার মানে হচ্ছে এমন এক শ্রেণির বাংলাদেশি ফল, যার বিচিটি প্রায় ফলের সমান এবং শাস খুবই পাতলা/কম বিধায় ফলটি খুব একটা খাওয়া হয়না। অপরদিকে আরবি ‘তামুর’ (মানে বাংলা খেজুর) এমন একটি ফল, যার বিচিটি ফলের তুলনায় খুব ছোট, শাস পুরু ও মিষ্টি, সাইজে বাংলার প্রচলিত খেজুরের তুলনায় বেশ বড়। একই উদাহরণ আরবি ‌’তিন’ (জান্নাতী ফল) ও বাংলা ডুমুরের ক্ষেত্রে। একইভাবে আরবি ‘হোরমা’ মানে মহিলা, যে কিনা আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত থাকবে অনেকটা বস্তার মত এবং অন্য পর পুরুষের সামনে প্রকাশিত হওয়া বা স্বাধীন মত প্রকাশ করা যার পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপরাধ। কিন্তু বাংলা নারী বা মহিলা’ অর্থ আরবি ‘হোরমা’র মত নয়। ঠিক ইংরেজিwomen এর অর্থও আরবি ‘হোরমা’ বা বাংলা ‘মহিলা’ নামক পরাধীন জীবকে না বুঝিয়ে মানুষ প্রজাতির স্ত্রীলিঙ্গধারী একজন সচেতন স্বাধীন মানুষকে বোঝায়। একইভাবে বাংলায় ‘রাখাল’ মানে নদীর তীরে গরু ছেড়ে দিয়ে খালি গায়েআপনমনে বাঁশি বাজানো গ্রাম্য যুবাকে বোঝানো হলেও, ইংরেজি cowboy এর অর্থ কিন্তু বাঁশি বাজানো গরু রক্ষকের পরিবর্তে কোমরে পিস্তল গোজা পশ্চিমা হ্যাট মাথায় সাহসী ডাকু প্রকৃতির টেক্সাসি সাহসী তরুকে বোঝায়। আমরা যাকে ‘কমলা’ বলি আরবি ‘নারাঞ্জা’ বা ‘বোরতোগাল’ কিন্তু সেই কমলা নয়, এমনকি টাং উর্দু কেনু কিংবা ইংরেজি orangeএরও আছে ভিন্ন ভিন্ন রূপ, স্বাদ ও গন্ধ। একইভাবে মুসলমানগণ যে স্রষ্টাকে আল্লাহ বলে জানে, সে কখনো খ্রীস্টানদের ‘ঈশ্বর’ বা God এবং ইহুদীদের যিহোবা নন। এমনকি মুসলমানদের জিব্রাইল ও ইহুদী-খ্রীস্টানদের গেব্রিয়েল-এর বৈশিষ্ট্যও পৃথক। ইসলামী চিন্তার ফেরেস্তা ইংরেজি-ভাষি angel থেকে অবশ্যই ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। একইভাবে বাংলায় চরিত্র বলতে বিশেষ সেক্সুয়াল দূর্বলতা বা পরোকিয়া বোঝালেও, ইংরেজি character বলতে এইরূপ অর্থ বোঝায় না। এখানের ভাষায় ‘অধ্যাপক’ ‘শিক্ষক’ বা ‘ডাক্তার’ বলতে বাংলাদেশের মানুষ যা বোঝে, ইংরেজিprofessor, teacher or doctor মানে ইংরেজিভাষিক লোকেরা কিন্তু এর অর্থ আরো উচ্চ শ্রেণির তথা উচ্চ মার্গের বলে মনে করে থাকে। গণতন্ত্র বলতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে যা বোঝায় বা বাংলা ভাষিক মানুষেরা যা বুঝে থাকে, ইংরেজিভাষী দেশে democracy মানে কি তাই বোঝানো হয়? আবার ইংরজি ghost আর বাংলা ভুত কি একই শ্রণির অশরিরি আত্মা বা প্রাণি? বাংলাদেশী ক্রসফায়ার মানে যে অর্থ প্রকাশ করে, ইংরেজি cross-fire কি একই অর্থবোধক? বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ‘বস্ত্র বালিকা’ বলতে ১৪/১৫ ঘন্টা দৈনিক কাজ করেও সাপ্তাহিক ছুটিহীন, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বঞ্চিত এমন এক মহিলা শ্রমিক শ্রেণি বোঝায়, যারা তাদের বেতনাদি দিয়ে বস্তি এলাকায় থেকে কোন রকমে ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ন্যুনতম মানবিক সুবিধা বঞ্চিত গোষ্ঠী, পক্ষান্তরে এর ইংরেজি প্রতিশব্দ garments worker এর অর্থ পাশ্চাত্যে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। এভাবে বাংলাভাষায় গৃহকর্মী, কামার, চর্মকার, জেলে, গোয়ালা, কাঁঠাল, সাপুড়ে, মুরগী, গরু, ছাগল, লাঙল, জোয়াল, ধান, চাউল, রুটি, পিঠা, পায়েস ইত্যাদি শব্দের যে অর্থ বাংলা ভাষাভাষী গোষ্ঠী বুঝে থাকে, এই শব্দগুলোর প্রতিশব্দ হিসেবে ইংরেজি প্রতিরূপ যথাক্রমে house worker, blacksmith. shoemaker, fishermen, milkmen,Jackfruit, snake charmer, hen, cow, goat, plough, yoke, rice, bread, cake, coll এর অর্থ কিন্তু অবশ্যই কিছু না কিছু আলাদা।

সুতরাং উপর্যুক্ত উদাহরণে এটা ষ্পষ্টতর যে, কোন ভাষার প্রকৃত অনুবাদ কখনোই সম্ভব নয়, যেমন এক নয় ইংরজিcake আর বাংলা পিঠা কিংবা আরবি ‌‘খবুজ’ এর প্রতিশব্দ বাংলা ‘রুটি’ কিংবা জয়তুনের প্রতিশব্দ অলিভ বা জলপাই। অতএব রিয়েল বা প্রকৃত অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত ভাষাটির মূল শব্দ প্রয়োগেই প্রকাশিত হতে পারে আসল অর্থ, অনুবাদ বা বিকল্প শব্দে নয় কখনোই।

লেখকের ফেসবুক ঠিকানা : https://www.facebook.com/DrLogicalBangal

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন