শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশে ডাক্তারদের পেশা, বাণিজ্য, নৈতিকতা, প্রাইভেট প্রাকটিস প্রসঙ্গে # ৯৩


বাংলাদেশে ডাক্তারদের পেশা, বাণিজ্য, নৈতিকতা, প্রাইভেট প্রাকটিস প্রসঙ্গে

সাম্প্রতিক রোগির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বারডেম, রাজশাহি মেডিকেলসহ দেশের অনেকগুলো হাসপাতালে মানুষ ডাক্তারদের আক্রমনাত্মক আচরণ দেখে হতবাক আর বিস্মিত হয়েছে। ডাক্তারি পেশা অন্য সাধারণ পেশার মত কিনা, তা হয়তো হিউম্যান সাইকোলজি, হিউম্যান ইথিক্স, মেডিক্যাল ইথিক্স পড়ুয়া ডাক্তারগণ আমার চেয়ে শতগুণ ভাল বুঝবেন। তারপরো এ দেশের একজন ঋণাত্মক অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে লিখতে বাধ্য হচ্ছি। তার আগে লেখাটি পড়ে যদি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তের মত “মানবতাবাদি ডাক্তারগণ” কষ্ট পান, তবে ক্ষমা চাইছি আগাম। কারণ বিষয়টি সৎ আর নির্লোভ ডাক্তারদের জন্যে নয়, লেখাটি লেখা হয়েছে ভোগবাদি ফাঁকিবাজ ডাক্তারদের বিষয়ে!

ইতিবাচক নেতিবাচক অভিজ্ঞতা দেশে আর বিদেশে :
বছর কয়েক আগে আমার এক আত্মীয় ‘নেফ্রাইটিস’ (কিডনী সংক্রান্ত রোগ) এ আক্রান্ত হলে সরকারি হাসপাতালে আশানুরূপ চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হয়ে ঐ হাসপাতালের একজন প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধানের কাছে যাই ‘ভাল চিকিৎসার জন্যে’। তিনি তৎক্ষণাৎ একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তির পরামর্শ দেন ও নিজে অভিজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া সত্বেও, ঐ সময়ে কর্মরত বিভাগীয় প্রধানকেও ক্লিনিকে আমন্ত্রণ জানান ১,০০০ টাকা প্রতিটি ভিজিট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। ১০/১২ দিনের চিকিৎসায় আমার ক্লিনিকে বিল হয় ২,০০,০০০ টাকারও বেশী, যার অধিকাংশ বিভিন্ন টেস্ট বা পরীক্ষা সংক্রান্ত। নানা কষ্টে ঐ বিল পরিশোধ করে কোলকাতা যাই চিকিৎসার জন্যে।
ঐ সময় ৩৫-টাকা ভিজিটে (২০০১ সনে ছিল ৩৫, ২০০৫ সনে ৫০ এবং বর্তমানে ১০০ ভারতিয় রুপি) কোলকাতার ‘পিয়ারলেস হাসপাতালে’র কিডনী বিশেষজ্ঞ ড. দিপংকর ভট্টাচার্য ঘটনাক্রমে ঢাকার ‘বিভাগীয় প্রধান’কে তার বৃটিশ সহপাঠী বলে সনাক্ত করেন এবং আশ্চর্য হন যে, তিনি বর্ণিত রোগীকে যে সব টেস্ট করিয়েছেন, তার ৮০% তার রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ঢাকার ডাক্তার কেবলমাত্র টেস্টের ‘কমিশনের লোভে’ ও রোগীর টাকা খসানোর অসৎ মানসে ঐ টেস্টগুলো করিয়েছেন একজন মরণাপন্ন রোগীর।
পিয়ারলেসে ৩৫-টাকা ভিজিটের কিডনী বিশেষজ্ঞ ভারতীয় ৭০০ টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে কেবল তার ৩-টি টেস্ট করতে বলেন। মোট ৭৩৫ টাকায় তার চিকিৎসা শুরু হয় এবং ৬ মাসের ঔষধ কিনে বাংলাদেশে ফিরে আসি। পরবর্তীতে আরো ৫/৬-বার কোলকাতা যেতে হয় এবং সাকুল্যে ২০-২৫ হাজার টাকার মধ্যে আমার আলোচ্য রোগীর কিডনী চিকিৎসা সম্পন্ন হয় এবং তিনি এখন কিডনী রোগমুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ভাল আছেন।

উপরের ঘটনাটি আমার নিজের অভিজ্ঞতালব্দ। আমি বাংলাদেশের একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক ও দেশকে ভালবাসি। কখনোই চাইনা যে, বাংলাদেশের রোগীরা ভারত বা বিদেশে যাক চিকিৎসা করাতে। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অপশাসনে আমাদের দেশের অনেক মানুষকে তৈরী করেছে ‘লোভী-নৈতিকতাহীন একেকটা যন্ত্র-মানুষে’। তাইতো হাসপাতালের একজন ভোগি ডাক্তার যেমন নিজের বেতন ভাতায় সন্তুষ্ট নন, তেমনি হাসপাতালের একজন এমএলএসএস পর্যন্ত ধান্ধায় থাকেন উপরি কামাইয়ের, একজন সিএনজি ড্রাইভার সন্তুষ্ট নয় তার মিটারে প্রাপ্ত সঠিক হালাল ভাড়ায়। অতিরিক্ত হারাম ভাড়া আদায় না করতে পারলে তার মন ভরে না, মাথা ঠিক থাকে না, এমনকি লিফটম্যানও বখসিসের জন্য "স্যারের পেছনে" দৌড়াতে থাকে, যা সচিবালয়ে দৃশ্যমান প্রত্যহ।

বর্তমান নৈতিকতাহীন, অসৎ, লোভী মানস লালনকারী বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ। কিন্তু বিশেষ কোন মানুষ যতই অসৎ বা নৈতিকতহীন হোক না কেন, তাতে সাধারণের খুব একটা যায় আসেনা কিন্তু একজন ডাক্তার যদি হয় এই অসৎ গুণ গুলোর ধারক, তবে দেশের কি অবস্থা হবে? দেশের অধিকাংশ মানুষই এখন জানে যে, বাংলাদেশের ২-৪% হাতে গোনা সৎ ডাক্তার ছাড়া (যাদের ২/৪-জনকে আমিও জানি) অধিকাংশ ডাক্তারকে পেয়ে বসেছে নৈতিকতাহীন অসৎ বাণিজ্যিক মানসিকতায়। যে কারণে সরকারী হাসপাতালগুলো সাধারণ মানুষ ‘সেবা’ নামক বস্ত্তটি খুঁজে পান না খুব সহজে। ঐ ২-৪% সৎ ডাক্তারের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ডাক্তাররা স্বাস্থ্য বিভাগে চাকুরী করেন অন্যান্য সরকারী চাকুরের মতই কিন্তু একজন জজ যদিও আবদার করতে পারেন না যে, তিনি অফিস আওয়ারের পর আবার বিকেলে বা রাতে ‘প্রাইভেট প্রাকটিস’ করবেন কিন্তু ডাক্তাররা তা করেন বা করতে চান। যদি জজ বা জেলা প্রশাসক বা পুলিশ সুপার আলাদা কোন ‘প্রাইভেট প্রাকটিসে’ বসেন বিকেলে, তবে চিন্তা করুন, তাদের মূল পেশার কি হবে? আমার ধারণা, এই প্রাইভেট প্রাকটিসই হচ্ছে একজন ডাক্তারের লোভী তথা নৈতিকতাহীন মানসিকতার মূল কারণ।

রোগী ধরার দালাল নেই এমন ডাক্তারের সংখ্যা শুনেছি খুবই কম (অবশ্য সৎ ডাক্তারের কথা আলাদা)। নিন্দুকেরা বলে, কোন কোন ডাক্তারের দালাল তার অফিস আওয়ারের সময় সরকারী হাসপাতাল গুলোর আশেপাশে নাকি ফাঁদ পাতে, গ্রাম্য গরিব রোগীকে ভাগিয়ে নিয়ে যায় তার নিকটবর্তী চেম্বারে। মোবাইলে জানিয়ে দেয় ‘বস’কে, ফঁদে আটকানো রোগীর কথা। সরকারী হাসপাতালে রোগী দেখার এক ফাঁকে নাকি ঐ অসৎ ডাক্তার সাহেব ঠিকই এসে চেম্বারে দেখে যান তার প্রাইভেট রোগীদের। আবার লিখে দিয়ে যান বিশেষ ক্লিনিকে বিশেষ বিশেষ টেস্ট করানোর কথা। অফিস সময়ে চেয়ার খালি থাকলেও জবাবদিহিতার অভাব এখানে কম বিধায়, প্রায়ই সংবাদপত্রে খালি চেয়ারের ছবিসহ তা বের হয়। কারণ যারা ডাক্তারের এই সময়ের হিসাবটি নেবেন, তাদের তারা ঠিকই সার্ভিস দেন প্রাণপণে। নিন্দুকেরা বলেন, সরকারী কোন ক্ষমতাধর বড় কর্তা সরকারী কোন হাসপাতালে ভর্তি হলে, তাকে তারা কেবিনে সুন্দরভাবে ‘দেখভাল’ করেন, যাতে তাদের প্রমোশন কিংবা খাগড়াছড়ি বদলী না হতে হয়। কিংবা ঢাকা শহরে বছরের পর বছর অবস্থান কিংবা অব্যবস্থার প্রশ্ন কর্তারা না তোলেন প্রকটভাবে।

মধ্যবিত্তরা অনেকেই ডাক্তারদের এই চালাকী ধরতে পেরে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক নিদেনপক্ষে ভারত চলে যান। কেবল গ্রামের অত্যন্ত গরীব মানুষ, যাদের কোথাও যাওয়ার সঙ্গতি নেই, কিংবা যারা সহজে ধরতে পারেনা এইসব অসৎ ‘ধুরন্দর ডাক্তারদের কারসাজি, তাদেরকেই মনের মত করে ঠকান এই ডাক্তারগণ। ভুক্তভোগিরা বলেন, এটি এখন নাকি চন্দ্র সূর্যের মত সত্য যে, অধিকাংশ প্রাইভেট ক্লিনিকের সাথে অসৎ ডাক্তারদের নাকি থাকে কমিশন বাণিজ্য।

সরকারী হাসপাতালের সরবরাহকৃত ঔষধের কমবেশি ৫০% নাকি রোগীরা পায়না বলে অভিযোগ করেন রোগিরা। হয়তো চলে যায় নিকটবর্তী ফার্মেসীতে কিংবা অন্য কোথাও, জানিনা সঠিক। অথচ এখন এ খাতে সরকারের বরাদ্দ কিন্তু কম নয়। অপারেশনের ঔষধ ছাড়াও অনেক সময় সুই, সুতা, গজ-ব্যান্ডেজ সবই রোগীকে কিনতে হয় বাহির থেকে, যা রোগিরা বলেন অহরহ। এই অপকর্মে অন্যদের সাথে কমবেশী নাকি ডাক্তাররাও জড়িত থাকেন বলে কথিত আছে। এরপর সবচেয়ে বড় সত্য দেশের বড় বড় ডাক্তারদের সাথে রোগী দেখাতে করতে হয় ‘আগাম এ্যাপয়েন্টমেন্ট’। এই এ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে কখনো ১ সপ্তাহ আবার কখনো ২-মাসও লাগতে পারে। প্রত্যেক বড় ডাক্তারই তার অফিস সময়ে দেখা গোপনীয় প্রাইভেট রোগীর হিসাব বাদ দিলেও বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০/১১ টা পর্যন্ত কমপক্ষে গড়ে ৫০-জন রোগী দেখেন প্রত্যহ। গড়ে ভিজিট ৫০০ (কেউ ১০০০-১৫০০ পর্যন্ত নেন) টাকা করে নিলেও, দৈনিক তার আয় কমবেশি ২৫,০০০ টাকা। সে হিসেবে এই সমস্ত ডাক্তারদের আয়কর হওয়া উচিৎ বার্ষিক লাখ টাকার উপরে। কিন্তু উদাহরণে বর্ণিত অসৎ ডাক্তারদের কেউকেউ যখন বার্ষিক মাত্র ৪-৫ হাজার টাকা আয়কর দেন, তখন চিন্তা করতে হবে আসলে এসব ডাক্তাররা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন।

বছর কয়েক আগে যখন দেশের আয়কর সংক্রান্ত ব্যাপারে কড়াকড়ি ও রাঘববোয়ালদের ধরা শুরু হলো, তখন বেশকিছু নামকরা ডাক্তারকেই দেখা গেছে, তাদের ব্যাংকে রক্ষিত আয়কর না দেয়া লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে লাভ লোকশানের চিন্তা ভাবনা না করে কেবল চড়া দামে ‘শেয়ার’ কিনতে (যেহেতু শেয়ারবাজার আয়করমুক্ত)। যে কারণে ঐ সময় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় শেয়ারের দাম। পরবর্তীতে দেশ 'সেভ" হলে অসৎ ডাক্তারগণ শেয়ারবাজার থেকে হঠাৎ করে টাকা তুলে নিলে শেয়ার বাজারে মারত্মক ধ্বস নামে, বদনাম হয় বর্তমান সরকারের।

উপরের তথ্যগুলো বিশ্লেষণে দেখা যাবে, ২/৪ জন বাদে (কিছুটা বেশিও হতে পারে) বেশকিছু অসৎ ডাক্তার সরকারী অফিস সময়েও 'বিশেষ ব্যবস্থায়' প্রাইভেট রোগী দেখেন, নিজের সরকারী দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেন না, ফাঁকি দেন, রোগীদের প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা তথা প্যাথলজি পরীক্ষা করাতে পাঠান, বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানীর ঔষধ তাদের ব্যবস্থাপত্রে লেখার জন্যে ‘উপহার’ নামক বিশেষ ‘কমিশন’ খান, রাতে ওয়ার্ডে ছাত্রদের প্রাকটিক্যাল করানোর কথা থাকলেও, তা না করিয়ে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রাইভেট রোগী দেখেন, আধুনিক চিকিৎসা বিষয়ক স্টাডি করেননা, আয়কৃত অর্থের সঠিক আয়কর দেন না।

উপরে বর্ণিত অপ-সিস্টেমের পরিবর্তন হওয়া দরকার দেশের ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই। দেশ ও জনগণের স্বার্থে বর্ণিত ডাক্তারদের এই অপকর্ম, দায়িত্ব অবহেলা, লোভ, নিয়মিত স্টাডি, আয়কর ফাঁকি ইত্যাদি বন্ধের জন্যে নিম্নবর্ণিত কার্যাবলী গ্রহণের জন্যে বর্তমান জনগণের সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই। যা নিম্নরূপঃ

অন্যান্য সরকারী চাকুরের মত সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারগণ কোন প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন না। তারা বিকেলে ইচ্ছে করলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালেই ’প্রাইভেট রোগী’ দেখতে পারবেন (সুখের কথা বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নাকি তা শুরু হয়েছে)। ভিজিটের ৫০% পাবে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ও ৫০% ঐ হাসপাতাল। সরকারী চাকুরী করেনা এমন ডাক্তার ও অবসরে যাওয় ডাক্তারগণ প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন অবাধে কিন্তু তারা সরকারের সরবরাহকৃত ‘প্রেসক্রিপসন ফরম’ ব্যবহার করবেন ভ্যাট স্টাম্পসহ, যাতে আয়কর ফাকি দিতে না পারেন।

ব্যাপক অভিযোগ আছে, রোগীরা নাকি সরবরাহকৃত ঔষধ ও অন্যান্য সামগ্রী পাননা, তাই ঐগুলো হাসপাতালে সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে, ঐ বাজেটের টাকায় বিনা টিকেটে বা বিনামূল্যে রোগী ভর্তি ও টেস্ট, রোগীর খাদ্য, বিছানাপত্র ইত্যাদির মান বাড়ানো যেতে পারে। হাসপাতালে এমএলএসএস নিয়োগ বন্ধ করে কোন কোম্পানীকে ক্লিনিংয়ের দায়িত্ব দিলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। আপাতত এ পদ্ধতি চালু করে এর সুফল কুফল পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে।


আবার বলছি এ প্রবন্ধ কেবল অসৎ ভোগবাদি ডাক্তারদের বিষয়ে, দায়িত্ববান সৎ ডাক্তারদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা এ লেখকের বিদ্যমান।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন