শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

বাঙালি একটি "মেধাহীন জাতি" এ কথা বাঙালি কবে মানবে? : প্রবন্ধ # ৬৮


বাঙালি একটি "মেধাহীন জাতি" এ কথা বাঙালি কবে মানবে?
[ শিশু জিহাদ উদ্ধার পর্ব ]
:
বছর খানেক আগে "আমরা কি সত্যিই একটি মেধাহীন জাতি? [পর্ব-১-২]" শিরোনামে ২টি পোস্ট দিয়েছিলাম আমি (১ম পর্ব এখানে সংযুক্ত)। কিন্তু আমার ৯০% বন্ধু তার প্রতিবাদে বলেছিল যে, বাঙালি মেধাহীন এ কথা তারা মানেনা বরং খুবই মেধাবি। ঠিক কি অর্থে বাঙালি নিজের মেধাবি দাবী করে আমার কাছে বোধগম্য নয় কখনো। হাজারো ঘটনা আছে আমাদের মেধাহীনতার তারপরো গত ২৬.১২.২০১৪ 'জিহাদ' নামের ৪ বছরের যে মানব শিশুটি একটা কুপে পড়ে গেল, তাকে নিয়ে কি "মেধার" পরিচয়ই এদেেশের মেধাবিরা দেখালো?
:
দেশের বড় দুটো সংস্থার মহাপরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বড় বড় প্রকোশলীগণ মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের উপস্থিতিতে সারারাত নানাবিধ মেধার 'ভেলকি' দেখালো পুরো বিশ্ববাসীকে। একবার বলেন ২০০, ৩০০, আবার ৬০০ ফুট গভীরে জিহাদ নিমজ্জিত। একটা নতুন ক্যামেরার ক্যাবল আর পাওয়ার সেট করতেই মহাপ্রকৌশলীদের ৬০-৯০ মিনিট চলে গেল। বর্ণিত অত্যাধুনিক ক্যামেরাটিতে ব্যাঙ, টিকটিকি, মশার প্রজনন অঙ্গ পর্যন্ত খুঁজে পেলেও, হতভাগ্য জিহাদকে আর পেলনা তারা। তারপর এলো আরো ব্যক্তিবর্গ মহা অত্যাধুনিক++ ক্যামেরা নিয়ে। তাদের দৃষ্টির আড়ালেও জিহাদ পালিয়ে রইলো, যেমন নৌ-বাহিনীর রাডারে খুঁজে পেলনা কবছর আগে চাঁদপুরে মেঘনায় ডুবন্ত নাসরিন লঞ্চকে, আজও পাওয়া যায়নি নাসরিন। অথচ কত সব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আমাদের বাহিনিগুলোর !
:
কিন্তু মহাবিস্ময়করভাবে মীরপুরের তরুণ ৪ সাধারণ প্রকৌশলী আবুবকর, আবদুল্লাহ, শফিকুল ও রাহুল তাদের নিজ হাতে রড দিয়ে বানানো "ক্যাচার" দিয়ে যখন 'ক্যাচ' করলো স্বপ্নের জিহাদকে, তখনই প্রকৃত "মহামেধাবিদের মেধা" প্রকাশিত হলো পুরো জাতিই নয়, পুরো বিশ্বের কাছে। আর মন্ত্রীদয়সহ সকল মেধাবিরা এ মহামেধা প্রদর্শনের লজ্জায় একটুও্ লজ্জিত না হয়ে, স্বপদে বহাল রইলেন নিজেদের মেধার "কলের গান" বাজিয়ে যেতে! এ মেধাবিদের কথা ড. হুমায়ুন আজাদ তার বিবিধ লেখায় বলে গেছেন অনেক আগেই, রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, কিন্তু যা প্রমাণ হলো আরেকবার ২০১৪ সনে জিহাদের ঘটনায়।
:
এবার প্রথমে জানা যাক বিস্তারিত জিহাদ উদ্ধার কাহিনি এবং বাঙালির মেধা আর মেধাহীনতার ধারাবাহিক কিসসা। প্রথমে জিহাদ উদ্ধারের শেষ পর্ব :
--------------------------------------------------------------------------------------------------
জিহাদ ওরফে জিয়া। বয়স চার। এই বয়সে চাঞ্চল্যের কোনো কমতি ছিল না। শুক্রবার দুপুরের পর ছয় বছর বয়সী বড় ভাইয়ের সঙ্গে খেলতে বের হয়। একপর্যায়ে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি মাঠসংলগ্ন পরিত্যক্ত ওয়াসার গভীর নলকূপে পড়ে যায় জিহাদ। সে ওই কলোনির এ-৪১ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকত। আর ঘটনাটি ঘটে এ-৪০ নম্বর বাড়ির সামনে। জিহাদ পড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রথমে আবিষ্কার করে এ-৪০ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলার আট বছরের শিশু জাহিদা ইয়াসমিন পুষ্পিতা। এরপর অনেকেই জিহাদের কান্নার আওয়াজ এবং ‘ও মা বাঁচাও-বাবা বাঁচাও’ বলে চিৎকার শুনেছেন। শিশু জিহাদকে প্রাথমিকভাবে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন স্থানীয়রা। তারা রশি ফেলে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে এলে উদ্ধার তৎপরতা থমকে যায়। এরপরই শুরু হয় ওয়াসা, ফায়ার সার্ভিসসহ বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থার সমন্বয়ে রাতভর রুদ্ধশ্বাস অভিযান। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উদ্ধার অভিযান তদারকি করেন। তবে পাইপের ভিতর অত্যাধুনিক ক্যামেরা প্রবেশ করিয়েও তারা শিশু জিহাদের খোঁজ পাননি। ফায়ার সার্ভিসের সব প্রচেষ্টা নিষ্ফল হলে উদ্ধার অভিযানের দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টা পর গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযান স্থগিতের ঘোষণা দেন সংস্থার মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশু জিহাদকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে চারজনের দুঃসাহসিক একটি দল। ঘটনাস্থলেই তারা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হন। একপর্যায়ে আবু বকর সিদ্দিকের পরিকল্পনায় শাহ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, শফিকুল ইসলাম ও রাহুল দাস উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। তারা নিজস্ব তৈরি বিশেষ ধরনের স্ক্যাচার, জাল ও বর্শা ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের কিছু কর্মী তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। ফায়ার সার্ভিস কাজ স্থগিত ঘোষণার মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যেই তাদের সফলতা আসে। বিকাল ৩টার দিকে শিশু জিহাদকে পাইপ থেকে বের করে আনেন। মিরপুর থেকে ঘটনাস্থলে আসা আবু বকর সিদ্দিক দাবি করেন, তার বানানো খাঁচার সাহায্যেই জিহাদকে উদ্ধার করা হয়। তার ভাষ্য, গণমাধ্যমে শিশুটিকে উদ্ধার করা যাচ্ছে না দেখে শুক্রবার রাত ১২টায় তিনি ঘটনাস্থলে লোহার খাঁচা নিয়ে যান।
:
রাতে একবার খাঁচাটি ভিতরে ঢুকিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন উদ্ধার করা যায়নি। খাঁচাটি কিছুটা ভেঙে যাওয়ায় সারা রাত ধরে তিনি এটি মেরামত করেন। পরে আরও কয়েকজনকে নিয়ে আবু বকর সিদ্দিক দুটি খাঁচা ভিতরে ঢোকান। এরপর তারা দেখেন, খাঁচায় কিছু একটা আটকে গেছে। ধীরে ধীরে খাঁচাটি টেনে তোলা হয়। উদ্ধারের সময় জিহাদ অচেতন ছিল। তার চোখ বন্ধ ছিল। পরনে একটি প্যান্ট ছিল। শরীর কালো হয়ে গিয়েছিল। এভাবেই উদ্ধার হয় শিশু জিহাদ।আবদুল্লাহ, শফিকুল ও রাহুল দাবি করেন, তাদের বানানো বর্শার সাহায্যেই জিহাদকে উদ্ধার করা হয়েছে। আবদুল্লাহ জানান, তার বাসা মেরাদিয়া এলাকায়। তিনি এফএম রেডিওতে জিহাদের খবর শোনেন। শুক্রবার রাতেই শফিকুল ও রাহুলকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। তাদের সঙ্গে তিনটি বর্শা ছিল। বর্শাগুলোয় আংটা লাগানো ছিল। দুটো বর্শা নড়াচড়া করার জন্য ও একটি বর্শা টেনে আনার কাজের উপযোগী করে বানানো হয়। বর্শাগুলোর মধ্যে ক্যামেরা লাগানো ছিল।আবদুল্লাহর দাবি, ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়ার সময় তারা দড়ি বেঁধে বর্শাগুলো পাইপের মধ্যে ফেলেন। একবার চেষ্টাতেই তারা সফল হয়েছেন। প্রায় ২৩৫ থেকে ২৪০ ফুট নলকূপের গভীরে যাওয়ার পর বর্শাটি কোনো কিছুর সঙ্গে আটকে গেছে বলে তারা টের পান। ধীরে ধীরে ওপরে তোলা হয়। ১০০ মিটারের মধ্যে যখন বর্শাটি আসে তখন ক্যামেরায় বোঝা যায় শিশুটি সেখানে আটকে আছে। তার ভাষ্য, শুক্রবার রাত থেকেই বর্শা ফেলার সুযোগ খুঁজছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের বড় বড় কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা থাকায় তারা সেই সুযোগ পাননি। আগে ফেলতে পারলে রাতেই তারা জিহাদকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে পারতেন। শিশুটি হয়তো ওই পাইপ ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল। যদি পাইপটি কেটে ফেলা না হতো তাহলে শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করা যেত। কাটার ফলে শিশুটি নিচে পানিতে পড়ে গেলে সেখানেই সে মারা যায় বলে তার ধারণা।
:
এবার মেধাহিনতার কিসসা পর্ব : ১
--------------------------------------------------
আমরা কি সত্যিই একটি মেধাহীন জাতি? [পর্ব-১]
:
বাঙালি দেশপ্রেমিক ও মেধাবী বলে নানা ‘গল্পকথা’ আমরা শুনে এসেছি সেই
ছোটবেলা থেকেই। বিদেশে গিয়েও কোন কোন বাঙালি তাদের মেধার পরিচয় কখনো কখনো
দিয়েছেন বলে দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাঝে মধ্যে শোনা গেলেও, বাংলাদেশের
অভ্যন্তরের অনেক ঘটনা ও কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে আমাদের মেধা নিয়ে
সত্যি প্রশ্ন ও সংশয় জাগে। শুরু করি ঢাকা শহর থেকেই, তারপর জেলাশহর ও
গ্রামের দিকে যাব।
:
মেধাহীনতা ও অদক্ষতার কারণে ওভারব্রিজ বানাতে তার পিলারগুলো ফুটপাতে
বসিয়ে পথচারীর চলাচল রুদ্ধ করছি; প্রকাশ্যে রাজপথে ময়লার বিশাল ভাগাড়
বসিয়ে, ময়লা জমিয়ে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি ও পথচারীর চলাচলে বঁাধা দিচ্ছি;
সরকারি সকল অফিস কম্পিউটার-ইন্টারনেট থাকলেও পুরণো ফাইলিং সিস্টেমের বদলে
‘নন-পেপার’ ফাইলিং ব্যবস্থা করতে পারছি না; আদালতে একটি মামলার দ্রম্নত
মিমাংসার বদলে বছরের পর বছর ঘুরাচ্ছি; স্বাস্থ্যসম্মত বিয়ার বন্ধ রেখে
বিকল্পে বিশ্বস্বীকৃত ‘কাশির ঔষধ’ ফেনসিডিলকে ‘হট পানীয়’ হিসেবে ব্যবহার
করছি; সারাবছর চুরি ঘুষ দুর্নীতি করে ‘পাপ মোছনের জন্যে’ বিশ্ব ইজতিমার
‘আখেরী মুনাজাত’ কিংবা শোলাকিয়ার বিশাল ঐতিহাসিক ঈদের নামাজে অংশ নিয়ে
‘অন্যের অছিলায়’ জান্নাতে যাওয়ার চেষ্টা করছি; বিদেশী দামী পেপারে ছাপানো
নন জুনিসিয়াল স্টাম্পে খামোখা ৩-৪ ইঞ্চি যায়গা উপরের দিকে রেখে নষ্ট
করছি; আয়করের টাকা জমার চালানটি ব্যাংক জমা সিস্নপের ১০-গুণ সাইজে
বানাচ্ছি; ট্যাক্সি চালকরা যাত্রী থেকে মিটারের দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায়
করলেও তার প্রতিকার করতে পারছি না; রেল লাইনের দুপাশের জমিকে ব্যবহারের
বদলে নতুন ফসলি জমি নষ্ট করে সড়ক বানাচ্ছি; প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিকল্প বের
করতে পারছি না; কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে আলোকিত করতে পারছি না।
:
আসাদগেটে স্টিল স্ট্রাকচারে নির্মিত ওভারব্রিজ দিয়ে পার হওয়ার জন্যে
একদিন ব্রিজে উঠে দেখি, বৃষ্টির কারণে ব্রিজের উপরে হঁাটুপানি, মানে পানি
অপসারণের কোন ব্যবস্থা স্টিলের ওভারব্রিজে রাখা হয়নি। ঐ পানি প্রাকৃতিক
নিয়মে না শুকালে নাকি আর বিকল্প কোন পথ নেই। সরকারি চাকুরীর জন্যে
সিভিলসার্জন কর্তৃক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রদত্ত ‘ফিট’ সার্টিফিকেটের ভাষা
দেখে (সরকারী ফরম-৭৯০) আমার ‘আনফিট’ হওয়ার জোগার। তা হলো ‘‘--- অফিসে
নিযুক্তির জন্যে আমি উহাকে অযোগ্য বলিয়া মনে করি/করিনা’’। এ ছাড়া আয়কর
রিটার্নের ৮-পৃষ্ঠার ফরমে অনেক অপ্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া হলেও জরুরী অনেক
তথ্য প্রদানের ঘর নেই। এভাবে নানা সরকারি ফরম দেখলে দেখা যাবে তাতে
‘জ্ঞানের বহর ও প্রজ্ঞাশীলতা’ কাকে বলে?
:
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নির্মিত হচ্ছে অনেক প্রকারের জলযান। ঢেউ ও ঝড়
প্রতিরোধক জলযান আমরা কি এখনো নির্মাণ করতে পারি? বিদেশ থেকে আমদানী করা
ছোট ছোট ‘টাগবোট’ বা ‘সি-ট্রাক’ আমাদের নদীগুলোর ঢেউ ও কালবৈশাখী
মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারলেও, এদেশে নির্মিত বড় বড় দোতলা-তিলতলা বৃহৎ
আয়তনের বড় লঞ্চগুলো প্রতি বছরই ২/১ টি করে ডুবে যায়। যদিও বৃটিশদের
নির্মিত স্টিমার (রকেট) একশ’ বছরের মধ্যে একটিও ডুবেনি। আর নৌকা-ট্রলারের
কথা আর কি বলবো? নদীমাতৃক এদেশের নৌকা নির্মাণের ‘টেকনিক’ প্রায়
মধ্যযুগের। কিন্তু ‘মাদ্রাজ’ উপকুলের জেলেদের দেখেছি ভিন্ন ভিন্ন
টেকনিকের নৌকা বানাতে। কোন কোন নৌকার মাঝের ফাঁক দিয়ে ঢেউ এপার ওপার চলে
যায়, নৌকা ডোবে না। নৌকায় আলকাতরা বা ‘মেরামত’ দিতে হয়না মাদ্রাজীদের।
আমাদের ফেরিঘাটগুলোর কথা ধরা যাক। রো-রো বা ডাম্ব ফেরিগুলো সহজ-সরল পথে
ঘাটে ভেড়ার কোন ব্যবস্থা না করে, তাকে এমন এক জটিল পদ্ধতিতে ভেড়ার
ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে গাড়ি উঠতে ও নামতে এবং ফেরি ভিড়তে ও ছাড়তে অনেক
সময় নষ্ট করতে হয়।
:
শীতের সময় পদ্মার চরে ফেরিগুলো না ভিড়ে কয়েক মাইল
‘খাল’ কেটে ভেতরে ভেড়ার ও ঘোরানোর কোন যুক্তি আছে বলে মনে হয়না। দুর্ঘটনা
ঘটলে আমাদের ‘রেসকিউ’ ব্যবস্থাপনা কত দূর্বল তা অতীতে অনেকবার দেখার পরও
জাতি দেখলো সাভারের আমিন বাজার ব্রিজ থেকে পড়ে যাওয়া ‘বৈশাখী’ বাসটির
‘ট্রেস করতে’। পত্রিকায় প্রকাশ ৫৩-ঘন্টার উদ্ধারপর্বে ৪৩-ঘন্টাই গিয়েছে
বাসটি ‘খুঁজতে’। অথচ ১-ঘন্টার মধ্যে স্থলপথে সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ক্রেন
এবং পরবর্তীতে জলপথে হামজাকে আনা কি খুব অসম্ভব ছিল? আবার বাস উঠানোর পর
দেখা গেল, ৪০-জনের লাশ ‘হাওয়া’! ‘নিরাপত্তার নামে প্রায় সকল পোশাক
কারখানার কলাপসেবল গেট বন্ধ রাখার কারণে দেখা যায়, আগুন লাগার পর
শ্রমিকরা পুড়ে মরছে কিন্তু এর বিকল্প ঢুকছে না এ জাতির মাথায়!
সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আমরা কত অদক্ষ তার পরিচয় বিভিন্নভাবে
পেয়েছি। ‘আদমজির’ মত বিদেশিদের নির্মিত বৃহৎ জুটমিল পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে
বন্ধ করে দিয়েছি আমরা। আমাদের তৈরী আইন কানুনেও আছে অনেক জটিলতা। এই
জটিলতার কারণে অনেকে আইনের ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়, আবার অনেক নীরিহ লোক
আইনী জটিলতায় বছরের পর বছর কষ্ট পায়।
:
ফিস আদালতেও সুষ্পষ্ট দিক নির্দেশনা বা জবাব দিহিতা না থাকার কারণে কোন কাজ অতি দ্রম্নত হয়ে যায়, বার কোন কাজ বছরের পর বছর ঘুরলেও দায়ী ব্যক্তির কোন শাস্তি হয়না। আমাদের
অদক্ষতার অভাবে রাস্তাঘাটে ট্রাফিকের কি দুরবস্থা তা সবাই এখন কমবেশি
জানি। রাস্তার তুলনায় যানবাহন অত্যধিক হওয়া সত্বেও সকল মোড়ে রিক্সা
দঁাড়িয়ে থেকে ও পাবলিক বাসগুলো যাত্রী ওঠানামা করিয়ে কৃত্রিম যানজট
সৃষ্টি করলেও তার বিকল্প ট্রাফিক বিভাগ করতে পারছে না। অদক্ষতার কারণে
বাসভাড়া নিয়েও প্রতিদিন যাত্রী ও কন্ডাকটরের মধ্যে নিয়মিত বচসা ও
হাতাহাতি লেগে আছে। অদক্ষতা ও অপরিকল্পনার কারণে জনসংখ্যা হু হু করে বেড়ে
কিভাবে চোখের সামনে দেশটি বাস অযোগ্য হয়ে পড়ছে, তা বোধ হয় কাউকে চোখে
আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে না। অদক্ষতার জন্যেই বহুল আলোচিত রাজাকারদের
বিচারের জন্যে গঠিত ট্রাইবুনালের বিচারক স্কাইপিতে কথা বলে ধরা পড়ছেন
সাধারণ বালকের মতো। হায় দক্ষতা!! ছাত্র রাজনীতিকে আমরা আমাদের অদক্ষতার
কারণে সুপথে পরিচালনা করার পরিবর্তে কুপথে পরিচালনা করছি। অদক্ষতার
জন্যেই রাজাপুরের পা হারানো ইমনের কিংবা বিশ্বজিৎ হত্যার ব্যাপারে জন
অসমেত্মাষকে বুঝতে পারছি না কিংবা বিষয় দুটোর গ্রহণযোগ্য মিমাংসা করতে
পারছি না। একই ব্যাপারে ফাইল চালাচালি করে কিভাবে সরকারি অফিস আদালতের
সময় নষ্ট হচ্ছে এবং সিদ্ধান্তহীনভাবে ফাইল পড়ে থাকছে, তা তদন্ত করলে
আমাদের দপ্তরগুলোর অদক্ষতা দেখে জাতি লজ্জা পাবে। অদক্ষ ও মেধাহীন বলেই
‘র‌্যাব’ কথিত ‘ক্রস ফায়ারগুলোর’ জন্যে ‘একই টাইপের গল্প’ বলেছে অনেক
বছর, বিশ্বাসযোগ্য কোন নতুন গল্প বানাতে পারেনি জাতি ও বিশ্বের কাছে।
বিরোধীদলের অদক্ষতা ও মেধাহীনতার কারণে সরকার বিরোধী আন্দোলনে কেবল
ক্ষতিকর ‘হরতাল’ ছাড়া আর তেমন কিছুই ‘উপহার’ দিতে পারছে না। স্বাধীনতার
পর আমাদের ২/১টি চলচ্চিত্র ছাড়া ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ কোন চলচ্চিত্র নির্মিত
হয়েছে বলে জানা নেই। অথচ বিশ্বের অন্য দেশে শিক্ষা, জাতিগঠন, মনস্তাত্বিক
উন্নতিতে অনেক ভাল সিনেমা এমনকি ভারতেও নির্মিত হয়েছে। আমাদের নাটক,
গানগুলোতে জুগল প্রেমের উপাখ্যান দিয়ে ভরে ফেলা হলেও আমাদের জটিল সামাজিক
সমস্যা তথা শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, মৌলিক অধিকার, নৈতিকতা, মূল্যবোধ,
দেশের উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে তেমন গুরুত্বারোপ করা হয়নি। অদক্ষতা ও
মেধাহীনতার জন্যই আমাদের ছোট্ট আয়তনের দেশে অনেক স্কুল-কলেজ মাঠ,
স্টেডিয়াম, ঈদগাহ, প্যারেড স্কোয়ার বানিয়ে আমরা জমির অপচয় করছি অথচ
পরিকল্পনা থাকলে একই মাঠে একাধিক কাজ তথা ঈদের নামাজ, ক্রিকেট খেলা,
বাণিজ্য মেলা, বার্ষিক প্যারেড কিংবা জনসভা করা যেত।
:
অদক্ষতার নজির মিলবে
হাতির ঝিল প্রকল্পে, যেখানে ভেতরে অনেকগুলো আপাতত অপ্রয়োজনীয় ‘ওভারপাস’
বানানো হলেও রামপুরা টিভির সামনে ও কাওরান বাজার মোড়ে কোন আন্ডার বা
ওভারপাস করা হয়নি। একই ভাবে সরকারি দপ্তরগুলো একই স্থানের পরিবর্তে ঢাকা
শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিতে রেখে সময় ও অর্থের অপচয় করছি আমরা। বিদ্যুৎ,
গ্যাস, পানির কিভাবে অপচয় করছি ও প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারছি না তা এখন
আর কাউকে বলে দিতে হয়না। অদক্ষতা ও মেধাহীনতার কারণে গ্যাস শেষ করে
ফেলছি, আবার কয়লা উত্তোলন কিংবা ব্যবহারই করতে পারছি না। একটি মানুষের
দক্ষতা যাচাইয়ের জন্যে তার ভাষার পড়া, লেখা, বলা ও বুঝতে পারার দক্ষতা
যাচাই করার নাম হচ্ছে ‘পরীক্ষা’। অথচ আমরা অদক্ষতার কারণে
চাকুরীপ্রার্থীদের যে পরীক্ষা নিচ্ছি তাতে মূলত প্রকৃত মেধা যাচাই সম্ভব
নয়। রাজউকের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দেখলেও আমাদের অদক্ষতার
প্রমাণ পাবো। সরকারি কেনাকাটায় অদক্ষতার জন্যে পরবর্তী সরকারের সময়
নানাবিধ প্রশ্ন তোলা হয়। বহুতল এপার্টমেন্ট ভবন পরীক্ষা করলেও আমাদের
অদক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘আধুনিক’ বসুন্ধরা
সিটিতে আগুন লাগার সময় অদক্ষতার কারণে ‘বিশেষ লিফটটি’ চলেনি ও ‘হোস’ পাইপ
দিয়ে পানি বের হয়নি। ফল-ফসল উৎপাদনেও আমাদের দক্ষতার পরিচয় মেলেনা।
মালয়েশিয়ায় বারো মাস আম ফললেও এদেশে হয় শুধু এক সিজনে। একই প্রকারের হলেও
আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীরা এদেশের খেজুর গাছে সৌদি খেজুর ফলাতে পারেনি, যদিও
ভালুকার আবু তাহের নামের কৃষি শ্রমিক সৌদি অভিজ্ঞতায় তা এদেশে ফলানোর
চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের পিয়াজ, রসুন আয়তনে চীনের পেয়াজ রসুনের চেয়ে
অনেক ছোট ও কম ফলনশীল হলেও আমাদের কৃষিবিদদের দক্ষতায় তা বড়ো হচেছনা।
টেন্ডার ঘাপলা কিভাবে কমানো বা রোধ করা যাবে তার কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
আমরা বের করতে পারিনি। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি কমানোর জন্যে
আধুনিক কোন পদ্ধতি আমরা বের করতে পারিনি। দুদকও তেমন কোন চমৎপ্রদ
দৃষ্টান্তমূলক কাজ জাতিকে এখনো দেখাতে পারেনি, যদিও দুর্নীতি আমাদের পদে
পদে। খেলাধুলা, সঁাতার ইত্যাদিতে আমাদের অদক্ষতা এখন বিশ্বস্বীকৃত।
:
অদক্ষতার জন্যেই আমরা বর্তমান আধুনিক বিশ্বের অন্যতম প্রয়োজনীয় পণ্য
‘শপিং ব্যাগ’ বন্ধ করে দিলেও আমাদের নদী ও ড্রেনগুলো ‘শপিং ব্যাগে’
সয়লাব। আর যারা বন্ধ করেনি, তাদের দেশের ড্রেন ও নদীগুলো পলিথিনমুক্ত।
অদক্ষতা ও মেধাহীনতার কারণেই আমরা কর ফঁাকি দিচ্ছি ও ধরতে পারছি না,
জ্বীন ফকির জেঁাকের চিকিৎসা নিচ্ছি ও দিচ্ছি, প্রবাসীদের অর্জিত বৈদেশিক
মুদ্রা বিনিয়োগ করতে পারছি না, জাহাজ ভাঙা শিল্পে প্রতিনিয়ত প্রাণ
হারাচ্ছি, ভাষা বিজ্ঞানে দক্ষতা দেখাতে পারছি না, বিচারপতি নিয়োগ নিয়েও
প্রশ্ন তুলছি, এমপিওভুক্তিতে ক্রম বর্ধমান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, কুমীর
আমদানী করছি, বিদেশের জেলে আটক বাংলাদেশীদের ছাড়িয়ে আনতে পারছি না,
র‌্যাংকস ভবন বানাতে দিচ্ছি ও ভাঙছি কিন্তু হাতিরঝিলের বিজিএমইএ ভবন
ভাঙতে পারছি না। মেধাহীনতার কারণে হাতিরঝিলে ৫-৬টি আপাত অপ্রয়োজনীয় ব্রিজ
বানালেও, পদ্মায় একটিও পিলার স্থাপন করতে পারিনি, এমনকি সারারাত
পদ্মাপাড়ের ২-তীরে হাজার হাজার মানুষ প্রচ- ঠান্ডায় কিভাবে রাতে ফেরির
জন্যে অপেক্ষা করবে তার কোন ব্যবস্থা করিনি। বেতন-টিএ-ডিএ, পেনশন
প্রদানের নামে মানুষকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছি, সরকারি অর্থ লুটপাট করছি, হজ্ব
নিয়ে প্রতিবছর নানাবিধ কেলেঙ্কারী করছি, প্রকল্প থেকে রাজস্বখাতে
স্থানান্তরে নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি করেও পরবর্তীতে রাজস্বখাতে নিচ্ছি,
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে একটি জাতির মধ্যে কৃত্রিম নানাবিধ মত পার্থক্যের
সৃষ্টি করছি। এমনকি অদক্ষতা ও মেধাহীনতার জনেই আমরা এখনো নারকেল গাছে
ওঠার একটি আধুনিক পদ্ধতি ও নারকেল ‘কোড়ানোর’ একটি আধুনিক যন্ত্র বের করতে
পারিনি।
:
উপরের আলোচ্য চিন্তনগুলো একান্তই আমার নিজের। এ ক্ষেত্রে আমার চিন্তার
সাথে অন্য অনেকের ভিন্নতা থাকতেই পারে। স্বাগত জানাই তাদেরকে, যেন যুক্তি
দিয়ে তারা আমার ধারনাকে খন্ডণ করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন